ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রকিবুল হাসানের পরামর্শে পার পেয়েছিলেন জাভেদ মিয়াঁদাদ;###;জাকিয়া তিশা

‘সেই অনুভূতি ভোলার নয়’

প্রকাশিত: ১১:০৪, ১ এপ্রিল ২০২০

‘সেই অনুভূতি ভোলার নয়’

দেশের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচের স্মৃতি তো ভোলার নয় কখনোই। ম্যাচটির অনেক কিছুই এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে রকিবুল হাসানের। এখনও মনের অজান্তে হেসে ওঠেন একটি ঘটনা মনে পড়লে। সেই ম্যাচে তার পরামর্শ কাজে লাগিয়ে লঙ্কান দর্শকদের তোপ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন পাকিস্তানের কিংবদন্তি জাভেদ মিয়াঁদাদ। সেই দিনের ৩৪ বছর পূর্ণ হয়েছে মঙ্গলবার। ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ, শ্রীলঙ্কায় এশিয়া কাপের ম্যাচে পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। সেটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক গৌরবময় অধ্যায়ের সাক্ষী রকিবুল। ‘জয় বাংলা’ স্টিকার লাগিয়ে পাকিস্তানের হয়ে ব্যাট করতে নামার সাহসিকতা থেকে শুরু করে ২২ গজে নানা কীর্তি, ইতিহাসের নানা পাতায় তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একটি রেকর্ডও আছে, যেটি তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবেন না আর কেউ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বলের মুখোমুখি হওয়া! শক্তিশালী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ম্যাচ হেরেছিল ৭ উইকেট। তবে ৯৪ রানের পুঁজি নিয়েও পাকিস্তানকে ৩২ ওভার পর্যন্ত ম্যাচে রাখতে পেরেছিল বাংলাদেশ, সেটিও কম নয়! বিডিনিউজকে রকিবুল শোনালেন তার সেই ইনিংস ও ম্যাচের নানা গল্প। উঠে এলো জাভেদ মিয়াঁদাদকে নিয়ে মজার সেই ঘটনাও। বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচটি খেলেছি, প্রথম বলের মুখোমুখি হয়েছি, সেটি তো এক জীবনের পাওয়া। ওই অনুভূতি কখনোই ভোলার নয়। পাকিস্তান তখন দারুণ শক্তিশালী দল। শ্রীলঙ্কাও বিশ্ব ক্রিকেটের উঠতি শক্তি, আমাদের জন্য কঠিন দল। একটা আক্ষেপ ছিল, ভারতের সঙ্গে সেবার খেলার সুযোগ হয়নি। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে রাজনৈতিক ঝামেলায় ভারত সেই টুর্নামেন্টে খেলেনি। আমাদের ম্যাচটি ছিল মোরাতুয়াতে, কলম্বো থেকে ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে। পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণ তখন দুর্দান্ত। আমাদের বিরুদ্ধে ওরা নেমেছিল পেস ব্যাটারি নিয়ে, ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, জাকির খান ও মঞ্জুর এলাহি। সঙ্গে ছিল লেগ স্পিন জাদুকর আব্দুল কাদির। উইকেট একটু সফট ছিল। আগের রাতে বৃষ্টির কারণে উইকেটে আর্দ্রতা ছিল। সেখানেই টস হেরে আগে ব্যাটিংয়ের চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছিল আমাদের। ওয়াসিম আকরাম তখন দারুণ গতিময় বোলার। আর ইমরান তো ইমরানই। আমি অবশ্য ভড়কে যাইনি। পাকিস্তান আমল থেকেই বড় বড় ফাস্ট বোলারদের খেলেছি। ওপেন করার চ্যালেঞ্জ নিতে তাই পিছপা হইনি। প্রথম বলটিও আমিই খেলতে চেয়েছি। আমি সবসময় চাইতাম, নিজেকে দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে। এখনকার অনেক ক্রিকেটারকে দেখি, শর্ট বল খেলতে গেলে গায়ে লাগে বল। অথচ সুনীল গাভাস্কার, হানিফ মোহাম্মদের কখনও বল লাগেনি গায়ে। কারণ টেকনিক। বল থেকে চোখ না সরানো। আমারও কখনও বল গায়ে লাগত না। সাহস নিয়ে খেলতাম। যাই হোক, প্রথম ওভার করেছিলেন ইমরান। প্রথম বলটি ছিল স্টাম্পের একটু বাইরে আউটসুইঙ্গার। আমি না খেলে ছেড়ে দিয়েছিলাম। উইকেট সহায়ক ছিল পেসারদের জন্য, ইমরান-আকরাম খুব ভাল বোলিংও করছিল। আমার সঙ্গে ওপেন করেছিল নোবেল (নুরুল আবেদীন)। ইমরানের আউট সুইংয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে আউট হলো নোবেল। তিনে নেমে লিপু আউট হলো আকরামের বলে। শার্প ইনসুইঙ্গার ছিল, যতদূর মনে পড়ে। লিপু দেরি করে ফেলেছিল বুঝতে। আমিও খুব বেশি রান করতে পারিনি (১৪ বলে ৫)। জাকির খানের বলটি একদম শেষ মুহূর্তে সুইং করেছিল, আমার গ্লাভসে আলতো ছুঁয়ে কিপারের হাতে যায়। একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। মাঠে সেদিন অনেক দর্শক হয়েছিল, ৩-৪ হাজার তো হবেই। অন্তত ৯৫ ভাগ দর্শক সমর্থন করছিল আমাদের। শ্রীলঙ্কানরা সবাই জাভেদ মিয়াঁদাদের ওপর ক্ষেপে ছিল। এজন্যই আমাদের সমর্থন করছিল। ঘটনা শুনেছিলাম ইমরানের কাছ থেকে। ১৯৭১ সালে অনুর্ধ-১৯ পাকিস্তান চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার সময় থেকেই ইমরানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। এই এশিয়া কাপের সময়ও একসঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। এশিয়া কাপের ঠিক আগেই, শ্রীলঙ্কায় টেস্ট সিরিজ খেলেছে পাকিস্তান। সেখানেই এক ম্যাচে মিয়াঁদাদ আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু করেছিল। গ্যালারি থেকে দর্শক দুয়ো দিয়েছিল বা কিছু বলেছিল। মিয়াঁদাদ ব্যাট নিয়ে গ্যালারিতে উঠে গিয়েছিল মারতে। ওই ঘটনা ওখানকার পত্র-পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর সবাই মিয়াঁদাদের ওপর খেপে ছিল। হোটেল থেকে বের হতে পারত না, লোকে নানা কথা বলত। দোকানে-টোকানে গেলে বা ঘুরতে গেলে লোকে কথা শুনিয়ে দিত। ইমরানই আমাকে বলেছিল এসব। আমাদের সঙ্গে ম্যাচেও মিয়াঁদাদ যখন ব্যাটিংয়ে নামে, দর্শক সমানে দুয়ো দিয়ে যাচ্ছিল। আমি কাছেই ফিল্ডিং করছিলাম, শর্ট কাভারে। আমাকে দেখে বলল, দেখো তো, পাবলিক এরকম করলে খেলা যায়। আমি তো যেখানেই খেলতে যাই, ঘটনা কিছু ঘটিয়ে ফেলি। এখানে এরকম অবস্থা হবে, ভাবতেও পারিনি। আমি তখন তাকে বুদ্ধি দিলাম, কান ধরে উঠবস করো, হাতজোর করে মাফ চাও। কাজ হতে পারে, নাও হতে পারে। মিয়াঁদাদ তখনই পিচে ব্যাট রেখে কান ধরে ওঠবস করল, মাফ চাইল। তাতে কাজ হলো ম্যাজিকের মতো। দর্শক এরপর তালি দিতে থাকল। ম্যাচ আমরা হেরেছিলাম স্বাভাবিকভাবেই। তবে লড়াই খারাপ করিনি। আমাদের সবার জন্যই স্মরণীয় অভিজ্ঞতা সেই ম্যাচ।
×