ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনায় কাবু গার্মেন্টস ও শ্রমজীবী মানুষ

প্রকাশিত: ০৮:৩৯, ১ এপ্রিল ২০২০

করোনায় কাবু গার্মেন্টস ও শ্রমজীবী মানুষ

বিশ্বকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে নভেল করোনা। এ মুহূর্তে পৃথিবী নামক গ্রহটি করোনায় কুক্ষিগত হয়ে মুমূর্ষু পথে উপনীত হয়েছে। সারা পৃথিবী যখন করোনার করুণ খেলায় পরাজিত হওয়ার উপক্রম তখন বাংলাদেশও করোনা কারফিউ কোয়ারেন্টাইন কমপিটিশনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে করোনার আঘাত কঠিন পর্যায়ে না পৌঁছলেও বলা যায়, দেশ সর্বাবস্থায় সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। সর্বাগ্রে বিরাজ করছে অস্থিরতা। করোনার নিত্যনতুন খবরে মানুষ নেতিয়ে না পড়লেও সর্বদা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক ও হতাশার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। সর্বক্ষেত্রে করোনার ব্যাপক প্রভাব দেশব্যাপী এক অরাজক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। করোনা মোকাবেলায় জীবন পরিচালনে নানা বিধি-নিষেধ জারি করা হয়েছে। সেই সাবধানতা অবলম্বন করে পথচলা হয়তো সম্ভব। কিন্তু করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি কিংবা কর্মহীনতার কবলে পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষ দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যে ক্ষতির সম্মুখীন হবে তা কি পুষিয়ে উঠা সম্ভব? প্রয়োজন সর্বাত্মক সরকারী সহযোগিতা। যদিও আমাদের বহু সীমাবদ্ধতা রয়েছে তারপরও বৈশ্বিক মহামারী করোনা মোকাবেলায় দেশের অর্থনীতিতে বৃহৎ রসদ যোগানো পোশাক খাত ও করোনায় তালাবদ্ধ হওয়া নিম্ন আয়ের দরিদ্র ও হতদরিদ্র্য মানুষের জন্য বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। সবখানে পড়েছে করোনার নেতিবাচক প্রভাব, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সর্বক্ষেত্রে করোনার কমবেশি ক্ষতি হলেও ভয়াবহ ক্ষতির মুখোমুখি দেশের রফতানি শিল্পের সর্ববৃহৎ খাত গার্মেন্টস শিল্প। দেশের সর্বাধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা এই খাত করোনার বৈশ্বিক বিষময়তায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পতিত হওয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। প্রায় চল্লিশ লাখেরও বেশি শ্রমিকের কর্মনিশ্চয়তা এবং রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে দেশকে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেয়া এই শিল্প করোনাভাইরাসে টিকে থাকার জন্য মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এ সংক্রান্ত সংবাদ পত্রিকান্তরে ছাপা হচ্ছে। সম্প্রতি সময়ের খবর অনুযায়ী, প্রায় সব রফতানি আদেশ বাতিল করেছে বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। এ মুহূর্তে বাতিলের শিকার পোশাকের মূল্য আড়াই বিলিয়ন ডলার। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় ২১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। প্রতি মাসে গড়ে এই পরিমাণ মূল্যের পোশাক রফতানি হয়ে থাকে। দু-একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান রফতানি আদেশ বাতিল করেনি। এই ক্রেতাদের পোশাকই এখন উৎপাদনের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এগুলো বাদ দিলে বাকি কোন কারখানায় এখন আর কাজ নেই। নতুন কোন রফতানি আদেশও নেই। এছাড়া সর্বশেষ খবর অনুযায়ী তৈরি পোশাকের বায়াররা ২৬৭ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থের অর্ডার বাতিল করেছেন। এ বাস্তবতায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে শ্রমিকদের সুরক্ষায় দেশের সব তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছে এ খাতের উদ্যোক্তা ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ, আমেরিকা। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ফ্রান্স ও ইতালিতে জরুরী অবস্থা জারি হয়েছে। দেশগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এছাড়া পোশাক ক্রেতা বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন ব্র্যান্ড ঘোষণা দিয়ে বিভিন্ন দেশে তাদের বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। এতে করে মারাত্মক বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গর্বের পোশাক খাত। বিপদাপন্ন এ খাত নিয়ে সম্প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি গার্মেন্ট কারখানার জন্য করোনাভাইরাসের ধকল কাটিয়ে টিকে থাকা অসম্ভব। এ কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে বিপুল পরিমাণ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। যারা গার্মেন্ট খাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি এবং অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়তে পারে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ২টি সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রথমত, শ্রমিক অসন্তোষ রোধে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, বৃহৎ কারখানাগুলোর সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি গার্মেন্ট কারখানাগুলো অর্ডার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দরকষাকষি করে যাতে টিকে থাকতে পারে সে ব্যাপারে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বাণিজ্য ও শ্রম মন্ত্রণালয় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। দেশের সর্ববৃহৎ রফতানি খাত পোশাক শিল্প একটা বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর রুটি-রুজির সংস্থান করে চলেছে। যদি রফতানি আয়ের হিসাবটি বাদ দিয়ে শুধু ৪০ লাখ শ্রমিকের বেকারত্ব বরণের কথাটাই চিন্তা করি তাহলে বেকারত্বের এই দেশ কত্ত বড় ধাক্কা খেতে পারে তা অনুমান করা অত্যন্ত সহজ। গ্রামের দরিদ্র্য, অতি দরিদ্র্য পরিবারে স্বাচ্ছন্দ্যময়তার স্বপ্ন পূরণের পাশাপাশি পোশাক শিল্প দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত। সোনার ডিম দেয়া সেই হিরণ্যগর্ভ হংসের পরিচর্যা কিভাবে করলে ডিম ও হাঁস দুটোই অক্ষত থাকবে সেই পথ খুঁজে বের করতে হবে। করোনাভাইরাস ঠেকাতে পোশাক কারখানাগুলোকে লকডাউনের আওতায় আনার আগে সব শ্রমিকের বেতন-ভাতা নিশ্চিত এবং এ শিল্প টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সরকারকে এর উদ্যোক্তাদের বাড়তি আর্থিক প্রণোদনার পাশাপাশি সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কারণ মালিক না বাঁচলে শ্রমিক বাঁচবে না । আর শ্রমিক না বাঁচলে শিল্প টিকবে না। মালিক শ্রমিকের যৌথ প্রচেষ্টায়ই পোশাক শিল্প আজকের লাভজনক অবস্থানে পৌঁছতে পেরেছে। যার সুফল ভোগ করছে পুরো বাংলাদেশ। তাই সরকারকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে করোনাভাইরাসে বিপন্ন গর্বের পোশাক শিল্পকে বাঁচাতে হবে। নভেল করোনায় নতজানু পৃথিবী। পৃথিবীর ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। দেশের আমদানি-রফতানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, নিত্যকর্মসহ সকল ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে করোনাভাইরাস কর্তৃক সৃষ্ট কভিড-১৯। সর্বক্ষেত্রে করোনা মহাবিপদ ডেকে আনলেও সবচেয়ে বেশি বিপদে ফেলছে নিম্ন আয়ের মানুষকে। উচ্চ ও মধ্যবিত্তরা লকডাউনে থাকলে তাদের জীবন পরিচালনায় হয়তো তেমন সমস্যা হবে না। তারা অন্তত তিনবার পেটপুড়ে খাওয়ার সামর্থ্য রাখে। কিন্তু নিরুপায় অবস্থানে পতিত হবে দরিদ্র্য শ্রেণী অর্থাৎ নিম্ন আয়ের মানুষ। নিরাপদ জীবনের স্বার্থে সবকিছু লকডাউন করে দিলে দেশ হয়তো করোনা ঠেকাতে পারবে। তবে একদিন কাজে না গেলে যাদের উনুনে আগুন জ্বলে না, সেই অভাবী মানুষগুলোর অবস্থা কি হবে, সেটাই ভাবনার বিষয়। শহর-বন্দর, গ্রামগঞ্জ সবখানে নিত্য অভাব-অনটনে দিশেহারা এই মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবতে হবে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী যতটা না আক্রান্ত তার চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের অবস্থা এ রকম, ‘করোনাক্রান্ত হয়ে মরব, তার আগে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় না খেয়ে মরতে হবে।’ পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে রাজধানীর এক রিকশাচালক বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে করোনার আগেই না খেয়ে মরতে হবে।’ করোনার কবলে দিশেহারা দেশ ও মানুষ, এটা চরম সত্য। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য ধীরে ধীরে সব লকডাউন হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়া স্বল্প আয়ের মানুষগুলো পেটের দায় সারতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? খবরে প্রকাশ, ‘রিকশাচালকরা বেকার সময় কাটাচ্ছেন। অনেকে যাত্রী ডেকেও পাচ্ছেন না। আর ফুটপাথে ভাসমান দোকানিরা বিপাকে। তারা তেমন কোন ক্রেতা পাচ্ছেন না। অনেকে বাস ও ট্রেনে হকারি করলেও যাত্রী কম থাকায় বিপদে পড়েছেন। ক্রেতা না থাকায় সংসার চালানো এসব লোকের কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকে জোগালি ও ভবন নির্মাণের কাজ করতেন। সেটিও বেশির ভাগ জায়গায় বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকরা। ফলে কাজ ছাড়াই বেকার সময় কাটাচ্ছেন নগরীর হাজারও মানুষ।’ এ রকম অবস্থা রাজধানী শহর ঢাকায়। শুধু ঢাকাই নয়, দেশের সকল শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ সবখানে একই অবস্থা। একই প্রশ্ন- ‘কাজ না করলে খামু কী?’ এই মুমূর্ষু সময়ে এমন প্রশ্নের উত্তর একমাত্র সরকার ও বিত্তশালী মানুষেরাই দিতে পারবেন। এজন্য উভয় পক্ষকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। কারণ সময় যেমন তার অমোঘ রীতি অনুসরণ করে পথ চলে তেমনি দুর্যোগ সেই সময়কে সাক্ষী রেখে তার ভয়াবহতা ছড়িয়ে প্রলয় সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যায়। সেই প্রলয় মেনে নিয়ে তা মোকাবেলায় সামর্থ্যবান সকল পক্ষকেই এগিয়ে আসা দরকার। সেটা হতে পারে সরকার কিংবা ধনাঢ্য কেউ। করোনার কবলে পড়ে শ্রমজীবী অতি সাধারণ মানুষের মাঝে যে অতুষ্টি ভাব দেখা দিয়েছে তা নিয়ে ভাবতে হবে। পেটকাতুরে এই মানুষগুলোকে অভুক্ত অখুশি রেখে করোনা মোকাবেলা করলে সেটা অনেকটা জল দিয়ে জ্বর সারানোর চেষ্টা করা হবে বৈকি। করোনার আগেই না খেয়ে মরে যাওয়ার যে কথা উঠে আসছে শ্রমজীবীদের মুখে তা গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। এ বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে গিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলেছেন, ‘সারাদেশে অভাবী মানুষদের খাবার দিতে হবে। যেসব মানুষ দিন আনেন, দিন খান, তাদের হাতে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারকে তহবিল দিতে হবে। ঝুঁকি মোকাবিলায় ধনীদের ওপর বাড়তি করারোপ বা তাদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করতে হবে।’ [সূত্র : বা.প্র. ২৩.০৩.২০২০] এ মুহূর্তে মারাত্মক বিপদ বহন করে চলেছে কভিড-১৯ করোনাভাইরাস। এতে আক্রান্ত হওয়া যতটা না সহজ, তার চেয়ে মুক্তি পাওয়াটা বেশ কঠিন। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী বিশ্বে মোট আক্রান্ত প্রায় ৭ লাখ ৮৪ হাজার ৭১৬ জন, সুস্থ প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার ৯৩২ জন ও প্রায় ৩৭ হাজার ৬৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে মোট আক্রান্ত ৪৯ জন, সুস্থ ১৯ জন, ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। করোনাভাইরাসের এই বিপজ্জনক মুহূর্তে সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে তেমনি নাগরিক হিসেবে আমার আপনার সকলেরই আলাদা আলাদা দায়িত্ব রয়েছে। তবে সরকারের দায়িত্বটা বেশি থাকলেও এর ওপর দায়ভার চাপিয়ে করোনাভাইরাসকে কারও অবহেলা করা ঠিক হবে না। এ থেকে মুক্তি পেতে সকলকেই সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরী। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×