ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এ যেন একাত্তরের বাংলাদেশ, লড়তে হবে একযোগে

প্রকাশিত: ১০:৪৬, ৩১ মার্চ ২০২০

এ যেন একাত্তরের বাংলাদেশ, লড়তে হবে একযোগে

সালাম মশরুর ॥ এ যেন একাত্তরের সেই বাংলাদেশ! শহর-নগর যেদিকে চোখ যায় সর্বত্র শুধু নীরবতা আর নীরবতা ! রাজধানীসহ সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন এবং জনমানুষের চলাচল নেই বললেই চলে। মানুষের মধ্যে অজান্তেই কাজ করছে মৃত্যুভয়! সারা দেশে একই চিত্র, একই আতঙ্ক! যাদের বয়স এখন পঞ্চাশ বা তার বেশি, তারা ভাবনার চোখ মেললেই দেখতে পান একাত্তরের সেই ভয়াল রূপ! বর্তমান প্রজন্ম ভাবতেই পারে কেমন ছিল একাত্তরের সেই মার্চ? আসলে এখনকার বিরাজমান আতঙ্কিত জীবনচিত্র সেদিনের সেই মার্চের মতোই! একাত্তরে গোটা জাতি লড়াই করেছে স্বাধীনতার জন্য। আর আজ লড়াই করছে জীবন বাঁচানোর জন্য একটি প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরুদ্ধে। যারা একাত্তরের ভয়াবহ যুদ্ধাবস্থা চোখে দেখেনি, তারা দেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বুঝে নিতে পারেন, সেদিনের পরিস্থিতি আসলে কেমন ছিল। সেদিনের ঘাতক ছিল হানাদার পাকিস্তানী সেনা, আর এখনকার প্রাণসংহারি ঘাতক ‘নোভেল করোনাভাইরাস’ নামের এক অদেখা ভয়ঙ্কর দানব। সংক্ষেপে এক বলে কোভিড-১৯। এর ভয় রাতারাতি আতঙ্কে রূপ নেয়ায় পাল্টে গেছে জনমানুষের প্রাত্যহিক জীবনের চালচিত্র! বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে দেশের জীবনযাত্রায় সৃষ্ট পরিস্থিতির আদল অনেকটাই একাত্তরের মতো। একাত্তরের পর্ব শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই, তখন আমরা যার যা হারাবার হারিয়ে ফেলেছি। অর্জন করেছি একটি মানচিত্র, একটি পতাকা আর একটি গর্বের ইতিহাস। আজ ২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষ দিন ৩১ মার্চ। এমন এক কঠিন সময়ে আমরা যে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছি, জানি না, আমাদের আগামী দিনগুলো কতটা সহনীয় হবে। আর কতটাই বা আমাদের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে! জানে শুধু ভবিতব্য! এটি বড় ধরনের জাতীয় সঙ্কট, সামাজিক সঙ্কট, শত বছরেও যাতে এমন সঙ্কট আর সৃষ্টি হতে না পারে। খুব কম সময়ই দেশের মানুষ দলমত নির্বিশেষে একটি সূত্রে এসে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়। জাতীয়ভাবে যখনই কোন সঙ্কটে মানুষ এক সারিতে দাঁড়ায় তখনই পথ চলতে সাহস তৈরি হয়। এতে কতটুকু অর্জন হবে সেটা বড় কথা নয়, মানুষ যখন নিজেদের মনোবলে বলীয়ান হয়। তখন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাতেই সফলতা আসে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রার্থনাও সৃষ্টিকর্তার করুণা লাভ করতে পারে। দুঃসময়ে সঠিক পথ ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ারও প্রয়োজন রয়েছে। এই মুহূর্তে আমরা মার্চ মাস অতিবাহিত করছি। ২০২০ সালের মার্চ মাস আমাদের জীবন-পঞ্জিতে ভিন্নরূপে অবস্থান করছে। একাত্তরের মার্চ মাসে বাঙালী জাতির জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। ২৫ মার্চ অপরেশন সার্চ লাইটের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাঙালী হত্যাযজ্ঞ। একাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক নির্দেশেই বাঙালী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে। শূন্য হাতে সেদিন জাতির কাছে যুদ্ধ জয়ের প্রধান শক্তি ছিল নিজেদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান। লড়াই করে স্বাধীনতা আনতে হবে, এই একটি ইস্যুর ওপর গোটা জাতি প্রাণ সঁপে দিয়েছিল। সেদিন মার্চ মাসের মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে জাতি জানত না কেমন যুদ্ধ হবে, কতদিন যুদ্ধ হবে, কী দিয়ে যুদ্ধ হবে। ছিল দৃঢ় মনোবল আর ঐক্যবদ্ধ অবস্থান। যুদ্ধ শুরু হলো, পুরো বাংলা অচল। গ্রাম শহর, সর্বত্র একই চিত্র। যারা যুদ্ধে গেল, তারা চলে গেল আর যারা দেশে রইল, তারা এখানে ওখানে মৃত্যুভীতি দূরে ঠেলে সুযোগের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। রাস্তাঘাট ফাঁকা, দোকানপাট হাটবাজার, মিলকারখানা বন্ধ। সেদিন এই দুঃসময় যুদ্ধ পরিস্থিতির খবর জানারও উপায় ছিল না তেমন। কোথাও একটি রেডিও থাকলে এটাই এক মাত্র অবলম্বন। কানের কাছে নিয়ে শুনতে হতো, কখন কোথায়, মুক্তিবাহিনী, হানাদারদের ওপর আক্রমণ করেছে, কোথায় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে কতজন হানাদার মারা গেছে। কোথায় কেমন যুদ্ধ চলছে। বাইরের দেশগুলো কে কি করছে। রাত দিন একইভাবে শহর শহরতলী ও গ্রামে লুকিয়ে থাকা বাঙালীদের নির্ঘুম সময় কেটেছে। সেদিন আমরা অসহায় ছিলাম, কিন্তু আমাদের দেশপ্রেম, আমাদের মনোবল, একে অপরের প্রতি ভালবাসা, সহমর্মিতা, মমত্ববোধ ছিল অসীম অটুট। যা ছিল তাই ভাগাভাগি করে খেয়েছি, কষ্ট দুঃখ ভাগাভাগি করে নিয়েছি। দুঃসময়ে কেউ কাউকে ফেলে যায়নি। মানুষের মানবতাবোধের কঠিন পরীক্ষা উদাহরণ হয়ে থাকে। একাত্তরের সেই দিনগুলো ঝলমল করে চোখে ভাসছে। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেছে। একাত্তরের ২৫ মার্চ আর ২০২০ সালের ২৫ মাচর্, ৪৯ বছরের ব্যবধান। প্রেক্ষাপট ভিন্ন কিন্তু চিত্র এক। শহরে শুনশান নিরবতা। ২০২০ সালের ২৭ মার্চ শুক্রবার শহরে একই নিরবতা। পরদিন ২৮ মার্চ একই অবস্থা। ২৯-৩০ মার্চ গ্রাম ও শহরতলীতে একই পরিস্থিতি। শুধু শহরের এখানে ওখানে কিছুটা যানবাহন ও ঘর থেকে জরুরী প্রয়োজনে বেরিয়ে আসা কিছু মানুষের চলফেরা চোখে পড়ে। সেদিনের থেকে আজকের যোগযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত। প্রযুক্তির উন্নয়নে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। সেদিন রেডিওতে কান পেতে শুনেছি পাকবাহিনী কোথায় কিভাবে পরাস্থ হচ্ছে। আর আজ টেলিভিশন, অনলাইন, ফেসবুক, মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সার্চ করে প্রতি মুহূর্তে খবর সংগ্রহ চলছে বাংলাদেশে নতুন আক্রান্ত আছে কিনা। কোয়ারেন্টাইনে কতজন আছেন। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় সময় যাচ্ছে। বিশ্বের কোন দেশের পরিস্থিতি কি। কোন দেশে কতজন মারা গেছে, আক্রান্ত হয়েছে। শত কষ্টের মধ্যে আজকের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) নিয়মিত ব্রিফিংয়ের উপস্থাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। সাধারণ মানুষ আইইডিসিআর-এর বক্তব্য শুনার জন্য প্রতিক্ষণ অপেক্ষায় থাকেন। সবাই ভাবেন হয়তো করোনা কমে যাচ্ছে, নতুন আক্রান্ত নেই, নতুন মৃত্যু নেই এই সংবাদ নিয়ে আইইডিসিআর- প্রতিনিধি আসবেন। সেনাবাহিনী মাইকিং করে জনসাধারণকে অযথা ঘোরাফিরা না করে বাসা বাড়িতে অবস্থান করার পরামর্শ দিচ্ছে। দূর থেকে সেনবাহিনীর গাড়ি আসতে দেখে আড্ডারত যুবকরা রাস্তা থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সেদিনও এমনিভাবে রাস্তায় পাক সেনাবাহিনীর টহল ছিল, কোথাও রাস্তায় মানুষ দেখলে ধরে নিয়ে গেছে নয়তোবা গুলি করেছে। আতঙ্ক নিয়ে কোন কারণে পথ চলতে গিয়ে এমনি নানান বিপদে পড়তে হয়েছে মানুষকে। আজ ভিন্ন পরিস্থিতি। আমাদের সেনাবাহিনী জনসেবায় মাঠে নেমেছে। জীবন বাঁচাতে মানুষকে সাহায্য করছে। ১৯৭১ সালের নগরীর চিত্র যারা দেখেননি,তারা ভাবতে পারেন, সেদিনটার চিত্র অনেকটা আজকের মতোই ছিল। জানি না আমরা এই মরণাপন্ন পরিস্থিতি থেকে কবে পরিত্রাণ পাব। গোটা বিশ্ব আজ মরণব্যাধি করোনার কাছে অসহায় গেছে। বিশ্বের সেরা শক্তিধর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চীনের প্রধান মন্ত্রীর সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার কথা বলেছেন। দেশে আজ জীবন যুদ্ধ চলছে। একাত্তর সালে এদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে একবার এক ছায়াতলে দাঁড়িয়েছিল। অর্জন করেছিল বিজয়। সেটা দিয়েছিলেন মহান আল্লহতায়ালা। আর আজ আবার মানুষ এক হয়েছে, ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছে। জীবন বাঁচানোর জন্য। মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে জীবন বাঁচানোর প্রার্থনা করলে নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা মানুষকে সাহায্য করবেন। এই ক্রান্তিকালে একে অন্যের প্রতি সহানুভূতির হাত প্রসারিত করা প্রয়োজন। শুধু নিজের সুবিধা ও জীবন নিয়ে ভাবলে হবে না। আপনার ঘরে খাবার মজুদ, পাশের ঘরে কেউ উপোস কিনা দেখা প্রয়োজন। আপনার ঘরে প্রচুর খাবার সত্ত্বেও যদি আপনার কাছের কেউ না খেয়ে কষ্ট করে তাহলে আপনি নিজেকে কিভাবে ক্ষমা করবেন। যে খাবার আপনি মজুদ করেছেন, সেটা পুরোটা আপনি খেতে পারবেন এরই-বা নিশ্চয়তা কোথায়। বিপদের দিনে ধৈর্য ধারণ ও সত্যের পথে অবস্থান নিতে হবে। মহামারী করোনা নিয়ে আজ এই সময়ে এক শ্রেণীর মানুষ বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। সত্য মিথ্যা কাহিনী তৈরি করে পোস্ট দিচ্ছে। এসব রটনা থেকে বিরত থাকা উচিত।
×