ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে দেশে নানা পদক্ষেপ;###;যেখানে বেশি পরীক্ষা সেখানে মৃত্যুহার কম;###;পরিস্থিতি দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আরও অন্তত ১৫ দিন

অস্ত্র ছাড়াই যুদ্ধ ॥ করোনায় মহাসঙ্কটে গোটা বিশ্ব

প্রকাশিত: ১০:৩৭, ৩১ মার্চ ২০২০

অস্ত্র ছাড়াই যুদ্ধ ॥ করোনায় মহাসঙ্কটে গোটা বিশ্ব

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পক্ষ থেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক অতি মহামারী হিসেবে ঘোষণার পর বিভিন্ন দেশ তা প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ চলছে। বিভিন্ন দেশে জারি করা হয়েছে জরুরী অবস্থা। কোথাও চলছে কার্ফু। কোন কোন দেশ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সবকিছু লকডাউন করেছে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে এখন বলতে গেলে বিচ্ছিন্ন গোটা বিশ^। চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া এই ভাইরাস ছড়িয়েছে প্রায় ২০০ দেশে। নানা রকম প্রতিরোধের মুখেও এখন পৃথিবীজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সোয়া সাত লাখ মানুষ। নিহত ৩৪ হাজারের বেশি। কোন প্রতিষেধক নেই। তবুও আক্রান্ত ও মৃত্যুহার ঠেকাতে মরিয়া গোটা বিশ^। এই যুদ্ধে মহামারী রোধে দেশে দেশে রীতিমতো যুদ্ধ চলছে। বলা চলে করোনার বিরুদ্ধে অস্ত্র বিহীন যুদ্ধ চলছে। যার প্রতিপক্ষ অদৃশ্য। আর অদৃশ্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চলছে তুমুল লড়াই। যে লড়াইয়ে রক্তপাত নেই। যেন সমরাস্ত্রের ঝনঝনানি। তবে অদৃশ্য প্রতিপক্ষের শক্ত আঘাতে প্রাণহানি আছে। যা চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। চলমান এই যুদ্ধ বাংলাদেশসহ বিশ^বাসী কতটা জয় করতে পারবে সেটাই দেখার বিষয়। দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলো এই যুদ্ধ চালাতে গিয়ে কাবু হতে চলছে। সমরাস্ত্র, অর্থ, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, গবেষণা কোন কিছুই করোনাকে জয় করতে পারছে না। উল্টো সবাইকে চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে কোভিড-১৯। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্ববাসীর নজর, গবেষণা, প্রতিরোধ ব্যবস্থা, চিকিৎসা সবকিছুই এখন করোনা কেন্দ্রিক। পৃথিবীকে মহাসঙ্কটের মুখে ফেলেছে এই ভাইরাস। স্থবির করে দিয়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। অচল হতে বসেছে বৈশি^ক অর্থনীতি। তাই এই মহামারী ঠেকাতে সব দেশ রীতিমতো করোনা বিরোধী তৎপরতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও করোনা প্রতিরোধে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে চলছে নানামুখী কার্যক্রম। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় নানা উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারী পর্যায়ে ওষুধ আবিষ্কার নিয়েও গবেষণা চলছে। দ্রুত সময়ে রোগ নির্ণয় পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এ পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪৯। এরমধ্যে ১৯ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। এর বাইরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সর্দি, কাশি নিয়ে কয়েকজন মারা যাওয়ার খবর রয়েছে। একাধিক ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করে স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে মৃত ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত ছিল না। তবে সরকারী ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে চিকিৎসা সেবা নিয়ে যেমন দুশ্চিন্তা রয়েছে তেমনি আতঙ্ক যেন কাটছেই না। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে, সাধারণ চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া। প্রাইভেট চিকিৎসা সেবাও কমে গেছে। সর্দি, কাশি নিয়ে হাসপাতালে এলে ভর্তি করা হচ্ছে না। অন্য রোগীদের চিকিৎসাও তেমন হচ্ছে না। আতঙ্কে ছুটিতে বাড়ি চেলে গেছেন অনেক ডাক্তার ও নার্স। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে টেস্ট টেস্ট এ্যান্ড টেস্ট। অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ করতে হলে আগে সন্দেহভাজন আক্রান্ত ব্যক্তির পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। যত বেশি পরীক্ষা করা সম্ভব হবে তত নিরাপত্তা ঝুঁকি কমবে। তাই বেশি বেশি পরীক্ষা করার তাগিদ দেয়া হয়েছে ডব্লিউএইচও এর পক্ষ থেকে। বিশে^র অন্যান্য দেশ বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মেনে কাজ করলেও দেশে করোনা চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্ট নয় আন্তর্জাতিক মহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। স্বাস্থ্য সেবার মান, কোন কোন হাসপাতালে চিকিৎসা হবে এ নিয়ে আছে চরম অব্যবস্থাপনা। তাছাড়া জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোর হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলোতে করোনা ইউনিট খোলা হলেও চিকিৎসক ও নার্সদের নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসার নিরাপত্তা সরঞ্জাম। নেই প্রশিক্ষণ। পরীক্ষা কেন্দ্রও সীমিত। কিট নিয়েও আছে সঙ্কট। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের সামনে করোনা প্রতিরোধে নানামুখী চ্যালেঞ্জ থেকেই যাচ্ছে। তবে প্রতিরোধ যুদ্ধ থেমে নেই। নোভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) নমুনা পরীক্ষা করতে সারাদেশে নতুন ১৭টি ল্যাব স্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সোমবার করোনাভাইরাস সংক্রমণের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে যুক্ত হয়ে তিনি এই কথা জানান। দেশে কোভিড-১৯ পরীক্ষায় পর্যাপ্ত টেস্ট কিট রয়েছে কিনা তা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে সংশয় প্রকাশ করা হলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, কিটস আর পরীক্ষার অভাব নাই, পিপিইওর অভাব নাই- এমন তথ্য দিলে জনগণ আশ্বস্ত হয়। তাছাড়া আইইডিসিআর বিভিন্ন নম্বর দিয়ে হটলাইন খুলেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই এখানে ফোন করে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরামর্শ চাচ্ছেন। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করে এসব নম্বরে লাইন না পাওয়ার। আবার কেউ বলছেন বেশিরভাগ নম্বর বন্ধ দেখানোর কথা। কখনও পাওয়া গেলেও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা লক্ষণ শুনে করোনা নয় বলে আশ্বস্ত করেন। এরপরও রোগী মারা যাওয়ার খবর বের হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। করোনা রোধে ইতোমধ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। লকডাউন নৌ-সড়ক-রেলপথ-সহ অভ্যন্তরীণ আকাশপথের যোগাযোগ। বন্ধ মার্কেট, বিপণিবিতান। বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের স্বেচ্ছায় ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। মাঠে নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী। সব প্রকার ধর্মীয়, সামাজিক অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে। এর বাইরে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গ্রামে গ্রামে করোনা সচেতনতায় চলছে মাইকিং। একাধিক ব্যক্তি একসঙ্গে চলতে বারণ করা হচ্ছে। করোনা প্রতিরোধে বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, পরিষ্কার থাকা, গণপরিবহন ব্যবহার কম করা, রুমাল, টিস্যু বা কনুই ধরে হাঁচি দেয়াসহ সাবধানতার জন্য নানা রকম পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। চলছে লিফলেট বিতরণ। সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে দোকানে দোকানে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে কেনাকাটার জন্য বৃত্ত করে দেয়া হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা ইস্যুটি সবচাইতে বেশি প্রচারের চেষ্টা চলছে। তবে প্রয়োজনীয় সময়ে সরকার করোনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা তা বোঝা যাবে আগামী অন্তত ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই। আবার এ রোগ নিরাময়ে সুনির্দিষ্ট কোন অসুধ নেই। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখলেও উন্নত স্বাস্থ্য সেবার সরঞ্জাম একেবারেই অপ্রতুল। এতকিছুর পরও প্রতিদিন বাংলাদেশসহ গোটা বিশে^ বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। গত দুই মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে আসা প্রবাসীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় লাখ। অথচ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করে বলছেন, প্রবাসীরাই দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণে মূল বাহক। ঝুঁকি। তাছাড়া সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশ ইতালিসহ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী দেশে প্রবেশ করেছেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে প্রবাসীদের থেকেই ছোঁয়াচে করোনা ছড়িয়েছে। তাই প্রবাসীদের যেমন সতর্ক থাকা উচিত, তেমনি পরিবারের সদস্যদের সতর্ক থাকতে হবে। সর্বোপরি সরকারী ব্যবস্থাপনা কঠোর না হওয়া পর্যন্ত করোনা নিয়ন্ত্রণ চ্যালেঞ্জ হবে। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, যারা বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে ফিরেছেন তাদের বেশিরভাগ অবাধে চলাফেরা করছেন। তাদের পর্যবেক্ষণ ও সঠিক তদারকি একেবারেই হচ্ছে না। ফলে সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়ছে। সর্বোপরি এখনও এ রোগ বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলছেন চিকিৎসকরা। আইইডিসিআরের তথ্য মতে, এ বছরের ২১ জানুয়ারি থেকে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের শারীরিক স্ক্রিনিং শুরু হয়। দেশে প্রথম করোনা আক্রান্তরা ইতালি ফেরত এবং তাদের স্বজন। গত ৮ মার্চ এ তথ্য জানায় আইইডিসিআর। এর এক সপ্তাহ পর সরকার ১৬ মার্চ দুপুর থেকে যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপের বাকি দেশগুলো থেকে দেশে যাত্রী প্রবেশ বন্ধ ঘোষণা করে। আইইডিসিআর জানিয়েছে, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) অত্যন্ত ছোঁয়াচে, যা শরীরে ১৪ দিন সুপ্ত থাকতে পারে। এই ভাইরাস যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেশে ফেরা ব্যক্তিদের নিজ নিজ বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো যেসব দেশে ভয়াবহ আকারে করোনা ছড়িয়েছে সেসব দেশ থেকে কতজন দেশে প্রবেশ করেছে এর সঠিক কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে যত মানুষ এসেছে এর সিকি ভাগই কোয়ারেন্টাইনে নেই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন থেকে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের উৎপত্তি হলেও অন্যদেশে চীনের থেকে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণেই অনেক দেশ আক্রান্ত ও মৃত্যুহার কমাতে পেরেছে। কিছু দেশ এখন করোনা রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিলেও তা হয়েছে বিলম্বে। তাই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে নীরবে। বাড়ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে লাশের সারি। জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতি দশ লাখে ইতালিতে মারা যাচ্ছেন ১২৪ জন, স্পেনে ৭৮ জন, ইরানে ২৫ জন, ফ্রান্সে ২০ জন, যুক্তরাজ্যে সাতজন করে। অন্যদিকে জার্মানিতে দশ লাখে মৃত্যুর অনুপাত দুই দশমিক চার আট। যেই চীন থেকে এই ভাইরাসের উদ্ভব সেখানে দুই দশমিক তিন ছয় জন। বাংলাদেশেও আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক। বিভিন্ন দেশে মৃত্যু হারের এই পার্থক্যের বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কোন দেশে কতজন মারা যাচ্ছেন তা নির্ভর করছে জনসংখ্যায় বয়সের অনুপাত, দেশগুলোর স্বাস্থ্য সেবার সক্ষমতা আর সর্বশেষে কতজনকে পরীক্ষা করা হচ্ছে তার উপর। শেষেরটির উপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সংস্থাটি। আন্দ্রেয়াস ব্যাকহাউস নামের একজন জার্মান অর্থনীতিবিদের হিসেবে ইতালিতে করোনায় আক্রান্ত মানুষদের গড় বয়স ৬৩ বছর, জার্মানিতে তা ৪৫। জার্মানির তুলনায় ইতালি অল্প বয়সের নাগরিকদের করোনা পরীক্ষার আওতায় কম আনছে, এই পরিসংখ্যান অনেকটা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। ইতালির গণমাধ্যমগুলোতেও এই সংক্রান্ত খবর প্রকাশ হয়েছে। সেখানে অনেক সম্ভাব্য রোগীই করোনা পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। এমনকি যারা মারা যাচ্ছেন তাদেরও অনেকে পরীক্ষার আওতায় আসছেন না। অন্যদিকে ঠিক বিপরীত চিত্র দক্ষিণ কোরিয়াতে। দেশটি কমপক্ষে তিন লাখ জনগণের করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা করেছে। তার মধ্যে নয় হাজার জনের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। বড় আকারে পরীক্ষার উদ্যোগের কারণে তারা সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই নিয়ন্ত্রণে রাখতে সফল হয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কোন দেশের স্বাস্থ্যসেবা কতটা সক্ষম সেটিও বড় ভূমিকা রাখছে। করোনাভাইরাসে সঙ্কটাপন্ন রোগীদের বাঁচাতে প্রয়োজন কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্র। হাসপাতালগুলোতে থাকতে হবে পর্যাপ্ত শয্যা আর নিবিড় পর্যবেক্ষণের যন্ত্রাদিও। এসব সুবিধা যেসব রোগীরা পাবেন তাদের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, না পেলে থাকে মৃত্যু ঝুঁকি। ইতালিতে জনসংখ্যা মোট ছয় কোটি। সেখানে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার সময় হাসপাতাগুলোতে নিবিড় পর্যবেক্ষণ শয্যার সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার। অন্যদিকে আট কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে জার্মানিতে এই ধরনের শয্যা আছে ২৮ হাজার। এই সংখ্যা শীঘ্রই দ্বিগুণ করার প্রক্রিয়াও চলছে। প্রতি লাখ মানুষের বিপরীতে জার্মানির হাসপাতালগুলো আইসিইউ শয্যা সুবিধা আছে ২৯টি আর যুক্তরাষ্ট্রে ৩৪টি। যেখানে ইতালিতে রয়েছে ১২টি আর স্পেনে ১০টি। শেষের দুই দেশেরই মৃত্যু হার অন্য দেশগুলোর চেয়ে তুলনামূলক বেশি। কিন্তু উল্টো চিত্রও আছে। প্রতি লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে নিবিড় পর্যবেক্ষেণ সুবিধা সংবলিত শয্যার সংখ্যা মাত্র দশটি দক্ষিণ কোরিয়াতেও। কিন্তু তারপরও মৃত্যু হার তারা এক ভাগের নিচে নামিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, খুব দ্রুত সংক্রমণের হারও কমিয়েছে। যা সম্ভব হয়েছে হোম কোয়ারেন্টাইনের কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার মধ্য দিয়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডাক্তার মুজাহেরুল হক বলেন, করোনাভাইরাস এর ধরন অনুসারে এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা যায় তাতে বয়স্ক জনগোষ্ঠী ও অন্যান্য অসংক্রামক রোগ যাদের রয়েছে তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন। ফলে সব পরিবারের এদিকে নজর রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইইডিসিআর এর পরিচালক ডক্টর মীরজাদী সেবরিনা ফ্লোরা বলেন, আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত ল্যাবরেটরি টেস্ট অনুসারে যে কয়জনের করোনাভাইরাসজনিত মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে- তাদের সবার যেমন বয়স ছিল ৭০ বছরের উপরে বা কাছাকাছি আবার তাদের প্রত্যেকেরই আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের অসংক্রামক রোগের জটিলতা ছিল। এমনকি এখন যারা হাসপাতলে আছেন যাদের কয়েকজন এই দুই ক্যাটাগরিতে আছেন। যদিও যে ১৫ জন সুস্থ হয়ে গেছেন তাদের মধ্যেও কয়েকজনের আগে থেকে অন্য রোগের জটিলতা ছিল। তারা এখন করোনাভাইরাস মুক্ত, তবে তাদের আগের রোগের নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। জানা গেছে, জার্মানিতে এই রোগে খুব অল্পসংখ্যক মানুষই মারা যাচ্ছে। করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত জার্মানিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৫৬ হাজারের কিছু বেশি। এদের মধ্যে মাত্র ৪০৩ জন মারা গেছেন। অর্থাৎ মৃত্যুর হার ০ দশমিক ৭২ শতাংশ। বিপরীতে ইতালিতে মৃত্যুর হার ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। সেখানে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। স্পেনে এই হার ৮ শতাংশ। বৃটেনে জার্মানির চেয়ে ৩ গুণ কম মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু মারা গেছে জার্মানির দ্বিগুণ। প্রাথমিক পর্যায়েই ব্যাপকহারে তরুণদের পরীক্ষা করানোই জার্মানির এই নিম্ন মৃত্যুহারের অন্যতম কারণ। ফ্রাঙ্কফুর্টের করোনাভাইরাস পরীক্ষাগারের পরিচালক মার্টিন স্টার্মার বলেন, মূল বিষয় হলো, আমরা কত বেশি ও কাকে কাকে পরীক্ষা করছি। সাধারণ অর্থে বলতে গেলে, ইতালির মতো যেসব দেশ পরীক্ষা করে কম এবং যারা খুব বেশি অসুস্থ তাদেরই কেবল পরীক্ষা করতে চায়, তাদের মধ্যে মৃত্যু হার বেশি।
×