ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

করোনায় দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ৩১ মার্চ ২০২০

করোনায় দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ

বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত করোনা ভাইরাস আজ এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগে সমস্ত মানুষের যাপিত জীবনকে যে স্থবিরতা এবং বিপর্যয়ের আবর্তে ফেলে দেয় তেমন অবর্ণনীয় দুঃসময় কতদিন চলবে সে ধারণাও কেউ দিতে পারছে না। সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত অবস্থা দৈনিক খেটে মানুষের সীমাহীন দুরবস্থায়। বিশ্ব অর্থনীতির মরণপণ লড়াই ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আমদানি-রফতানির গতিহীনতায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চরম হুমকির মুখে। যার ভয়াবহ প্রভাব কৃষি-শিল্পে নিয়োজিত নিম্ন আয়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যথার্থ এক অশনি সঙ্কেত। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কর্মজীবনও আজ দুর্দশার কবলে। ইতোমধ্যে অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ করার নির্দেশ এসেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশ আজ এক অযাচিত, অনাকাক্সিক্ষত অবরুদ্ধের যাঁতাকলে। অবরুদ্ধতার এমন দুঃসময়ে কর্মচঞ্চল, মানুষের উপচেপড়া ভিড় আজ জনমানবশূন্যে এক মৃত্যুপুরী বললেও বেশি বলা হয না। ঢাকায় ২ কোটি মানুষের প্রতিদিনের কর্মবহুল জীবন, তীব্র যানজট যতই অস্বস্তিদায়ক হোক না কেন এমন নীরব, নিস্তব্ধতাও কারো কাম্য ছিল না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকলেও সেটাই যেন এক নিয়মমাফিক কর্মব্যস্ততার নিত্যসহনীয় চিত্র। জীবন কখনও আনন্দের জোয়ারে চির স্বস্তিদায়ক থাকে না। দুঃখ, বিষাদ, হতাশা, রোগ-ব্যাধি এসব মোকাবেলা করেই সাধারণ মানুষকে টিকে থাকতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর ভয়াবহ দুর্ঘটনাকে প্রতিনিয়ত সামলানো সাধারণ মানুষরা এভাবেই জীবনকে ধারণ করেছে, চালিয়ে নিয়েছে। সাময়িকভাবে বিধ্বস্ত হলেও কোন এক সময় স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতিও শুভ সঙ্কেতের মতো শান্তির ছায়া দিয়েছে। কিন্তু আজ আমরা কোথায় এসে দাঁড়ালাম? চারদিকে হতাশা, আশঙ্কা, বিপদ আর ভয়ঙ্কর দুর্যোগের হাতছানি। বিশ্বের কোথাও যেন আজ আর কোন নিরাপত্তা নেই। পশ্চিমা বিশ্বের মতো দুনিয়া রাজত্ব করা পরাশক্তিও আজ হতোদ্যোম, দিশেহারা এবং চরম সঙ্কটের মুখে। আর আমাদের মতো মাত্র মাথা তুলে দাঁড়ানো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামনে আরো কত মারাত্মক দুরবস্থা অপেক্ষায় আছে ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদে সারাদেশের যে চিত্র প্রতিভাত হয় তাতে কোন প্রাণ আছে বলে মনে করাও কঠিন। জন মানবশূন্য বিভাগীয় শহরের সড়ক-মহাসড়ক যা কোন অশতীপর প্রবীণ মানুষের স্মৃতিতে আছে কিনা সন্দেহ। আমরা ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো মরণপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়া সময়ের নির্ভীক যোদ্ধা। তবে আন্দোলন, লড়াই, সংগ্রাম যতই দুর্নিবার আর দুর্বীনিত হোক তার একটা সফল কিংবা ব্যর্থ পরিণতি থাকে। মানুষ ভাবতে পারে অবস্থার গতি প্রকৃতি, সময়ের যৌক্তিক সমাধান যা মানুষকে আশ্বস্ত করে সম্মুখ সমরকে বেগবান করে দেয়। জাতি হিসেবে আমরা অনেকটাই সফল। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা মুক্তি সংগ্রামের গোড়াপত্তনেও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছি। গোটা ’৬০-এর দশকে আমরা অপরাজেয় যোদ্ধার ভূমিকায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সাহসিক ও নির্ভীক প্রজ্ঞার অনমনীয় চেতনায় ’৭১-এর মুক্তির সংগ্রামকে আলিঙ্গন করতেও পিছপা হইনি। কিন্তু আজ আমরা কোন্ বিপাকে? সর্বাত্মক প্রচেষ্টা প্রয়োগ করেও কোন কূল কিনারা পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্বে বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুরোতে যে মাত্রায় করোনা ভাইরাস ব্যাপকতা এবং দ্রুততার সাথে সম্প্রসারণ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় তেমন দুরবস্থা থেকে কিছুটা ফারাকে থাকলেও আমরা চরম ঝুঁকিকে প্রতিনিয়তই সামলানোর চেষ্টা করছি। আমরা করোনা শনাক্ত রোগী নিয়েও খুব বেশি স্বস্তিতে নেই। কারণ সারাদেশে পরীক্ষা সংক্রান্ত কিট এবং আধুনিক ব্যয় বহুল বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা সামগ্রীরও ঘাটতি রয়েছে। ঢাকা ছাড়া এই মুহূর্তে বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও করোনা শনাক্ত করার প্রাসঙ্গিক ব্যবস্থাপনা প্রস্তুত হয়েছে এবং কার্যক্রমও শুরু হওয়ার আলামত মিলছে। অথচ এই মুহূর্তে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় বিদেশ ফেরত প্রবাসী বাঙালীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। অনেকেই করোনার স্বাস্থ্য বিধি মেনে হোম কোয়ারেন্টাইনেও যাননি বরে জানা যায়। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় করোনা শনাক্তের প্রয়োজন পড়লে এখনও তেমন নমুনা ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। তবে আমরা আশা করছি অতি শীঘ্রই দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিবহুল জেলাগুরোতেও শনাক্তকরণ সামগ্রী পৌঁছে যাবে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুরবস্থা মোকাবেলা করছে হতদরিদ্র, দুস্থ মানুষ। যারা দিন এনে দিন খায়। নিত্য শ্রম বিনিয়োগ যাদের জীবন চালানোর নিয়ামক শক্তি। ভারী যান থেকে শুরু করে মাঝারি ও ক্ষুদ্র যানের চালকেরা আজ নিঃস্ব, কপর্দকহীন। কর্ম জীবনের চরম দুঃসময়ে তারা শুয়ে বসে অলস সময় ব্যয় করলেও নিরাপত্তাহীনতার ব্যাপারটি অত্যন্ত কঠোরভাবে সামনে চলে আসে। প্রতিদিনের শ্রমিক সংখ্যাও একেবারে কম নয়। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে অবরুদ্ধ নগর, শহর, বন্দর এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিম্নবিত্তের মানুষ আজ চরম সঙ্কটের আবর্তে। কর্মহীন জীবনের খাদ্য সঙ্কট এক আবশ্যকীয় পর্যায়। এক সময় খাদ্য পণ্যের বাজার লাগামহীন হলেও এখন তা অনেকটাই সহনীয় শুধু নয় কমেও এসেছে। এখানে খাদ্য সামগ্রী বিক্রেতারাও অসহায় অবস্থায়। বিশেষ করে মাছ, মাংস, সবজি, ফলমূল বিক্রেতারা আজ জীবনের চরম ক্রান্তিকাল পার করছে। শঙ্কা আর আতঙ্ক ছাড়া সম্ভাবনার পথনির্দেশনাও কাউকে বিন্দুমাত্র আশান্বিত করতে পারছে না। সামনে দুর্ভিক্ষের মতো আরও এক মহাসঙ্কট হানা দেয়ার আশঙ্কাকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যাবে না। অন্যের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে মানুষ কিছুদিন সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু দীর্ঘ সময় তার নিজের রুজি-রোজগার ছাড়া চলাটাও দেশের সার্বিক পরিস্থিতির জন্য কোনভাবেই মঙ্গলজনক নয়। পরিস্থিতি অনুকূল হতে দীর্ঘসূত্রতার জালে পড়লে সাহায্য সহযোগিতায়ও স্থবিরতা নেমে আসতে সময় নেবে না। তবে এই মুহূর্তে সুশীল সমাজ সম্পদশালী মানুষ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠন হতদরিদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে অন্তত তাদের দৈনিক খাবারের ব্যবস্থাটুকু দেয়ার পরিকল্পনা শুরু করেছে। সক্ষম মানুষ এখন মানবিক মূল্যবোধের তাড়নায় অসহায় ও বিপর্যস্ত প্রান্তিক জনগণের পাশে দাঁড়াতে সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে এভাবে এত বড় দুর্যোগ খুব বেশি দিন সামলানো কঠিন হবে। প্রতিদিনের কর্মচঞ্চল, পেশানির্ভর জীবনকে ধরতে ব্যর্থ হলে পুরো পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ধারণা করা কঠিন। ইতোমধ্যে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা তার স্বরূপ জানান দিচ্ছে। যার প্রভাব পড়ে উদ্যোক্তা ও বিত্তশালীদের জীবনে। তার পরেও সমাজের বিশিষ্টজনের পক্ষ থেকে সময়োপযোগী পরামর্শ এবং দিকনির্দেশনা আসছে। তেমন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়াও এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি জরুরী। যেটুকু সময় সামাল দেয়া যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত হতদরিদ্র ও অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো নৈতিক ও মানবিক দায়বদ্ধতা। পোশাক শিল্প-কারখানায়ও নেমেছে এক অন্যাবশ্যক দুর্যোগ। প্রথমত চীন থেকে কাপড়ের জন্য যে কাঁচামাল আমদানি হতো তা বন্ধ হয়ে যায় বিশ্বের প্রথম সংক্রমণ এই বিরাট দেশটি থেকে। এরই মধ্যে পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে বিভিন্ন ধরনের তাদের চাহিদা মোতাবেক অর্ডারও দিয়ে যায়। কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলোও এখন করোনার ভয়ঙ্কর সংক্রমণে প্রতিদিন আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সম্প্রসারণকে অসহায়ভাবে মেনে নিতে হচ্ছে। ফলে তারা তাদের আমদানির সব আবেদন নাকচ এবং স্থগিত করে দিয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে রফতানির শিল্পের এই ধ্রুপদী পোশাক কারখানার ওপর। এবার বাংলাদেশকে এই শিল্পের ওপর লোকসানের মাশুল গুনতে হবে যা ইতোমধ্যে প্রকাশও পেয়েছে। প্রায়ই ২২ হাজার কোটি টাকার লোকসানে পোশাক শিল্পটি আজ এক দুঃসহ যাত্রাকে মোকাবেলা করছে। তার ওপর সামাজিক দূরত্বের কারণে পোশাক শ্রমিকদেরও কাজ থেকে ছুটি দেয়া হয়েছে। তারা ফের কবে তাদের কর্মে যোগ দিতে পারবে সেটাও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। এদের মধ্যে নারী শ্রমিকদের সংখ্যাও কম নয়। আবার বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে যে সব নারী শ্রমিক কাজ করে তাদেরও কোন বাসায় ঢুকতে নিষেধ করা হচ্ছে। সুতরাং সমাজের এক বিরাট সংখ্যক নারী শ্রমিক আজ কমৃহীনতার দুঃসহ আবর্তে পড়ে গেছে। তবে এটাও সত্য সবার আগে নিজেকে সুস্থ আর নিরাপদ রাখা অত্যন্ত জরুরী। এখানে সামান্য গাফিলতি ভয়ঙ্কর বিপদ ডাকতে সময় নেবে না। আপাতত করোনা ভাইরাসকে মোকাবেলায় নিজের ও চারপাশের নিকটজনের মঙ্গল সাধনই সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। লেখক : সাংবাদিক
×