ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সময়ের প্রবাহে বিশুদ্ধ পানির সংগ্রাম

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ৩০ মার্চ ২০২০

সময়ের প্রবাহে বিশুদ্ধ পানির সংগ্রাম

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য অনুযায়ী দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, উপকূল, পার্বত্য এলাকা, হাওরাঞ্চল, বরেন্দ্র এলাকা, চা বাগান ও দুর্গম এলাকায় নিরাপদ পানির ব্যাপক সংকট রয়েছে। ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর জনাব খাইরুল ইসলাম বলেন,“এসডিজির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাত্র ৫৬ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছেন”। দেশের মূলত মধ্যভাগ ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ৩১ জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছরই ১০-১৫ ইঞ্চি নিচে নেমে যাচ্ছে। পানির স্তর এক ফুট নিচে চলে গেলে বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ হয়। ১৯৬৮ সালে যখন বাংলাদেশে ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়, তখন সর্বোচ্চ ৫০ ফুট নিচে বসানো হতো। এখন ১৫০ ফুট নিচেও পানি মিলছে না। গত ৩৫ বছর ধরে বাংলাদেশের পানি নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথের তথ্য মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাবে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া, বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়া, নদী শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় সেচের পানির পাশাপাশি সুপেয় পানির পরিমাণও কমতে শুরু করেছে। বিএডিসির এক গবেষণা রিপোর্টে সরকারকে সতর্ক করে জানানো হয়েছেযে, এখনই ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় শিল্প ও সেচ কাজের জন্য মাটির নিচ থেকে পানি তোলা বন্ধ করা প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংকের সেচ বিষয়ক পরামর্শক ড. ইফতেখারুল আলমের মতে, বাংলাদেশ ভয়াবহ পানি সংকটে পড়তে যাচ্ছে । এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে। বাড়াতে হবে সেচ দক্ষতা।শিল্প প্রতিষ্ঠানের পানির পুনঃব্যবহারবারিসাইক্লিং বাধ্যতামূলক করতে হবে। সম্প্রতি ভূগর্ভস্থপানির অপচয় রোধে সেচযন্ত্র স্থাপনে সমন্বিত ক্ষুদ্র সেচ নীতিমালা-২০১৭’র খসড়া মন্ত্রিসভা বিভাগ থেকে অনুমোদন পায়। কৃষকদের ভূ-উপরিস্থ পানির অধিকতর ব্যবহারে সরকার কাজ করছে। বর্তমানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় পরিচালিত বাংলাদেশ গ্রামীণ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্প, ইউনিসেফ সাহায্যপুষ্ট পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও হাইজিন প্রকল্প এবং বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় পরিচালিত পল্লী পানি সরবরাহ প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে।উপরিভাগের পানির মাধ্যমে যেন পানির সমস্যা সমাধান করা যায়, এ বিষয়ে সরকার বেশ জোর দিচ্ছে। সরকার তৃণমূলে বিশেষ করে আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় উপরিভাগের পানি ও গভীর নলকূপের পানির মাধ্যমে নিরাপদ পানির সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। এ কাজে ব্যয় হবে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি প্রথম পরিলক্ষিত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৩ হাজার ৫৩৪টি এবং পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রায় ৫০ লাখ নলকূপের পানি পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষা কার্যক্রম ২৭০টি উপজেলায় পরিচালিত হয়। দেখা যায় যে প্রায় ২৯ শতাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ রয়েছে। এ জরিপের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে প্রায় ৩৮ হাজার ১১৮ জন আর্সেনিকোসিস রোগী চিহ্নিত হয়। এ ক্ষেত্রে প্রায় ১৪ লাখ ৪০ হাজার নলকূপ লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ পরিবারকে আর্সেনিকদূষণ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা হয়। আর্সেনিকের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এটা বর্ণহীন, গন্ধহীন, স্বাদহীন পদার্থ। পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া বোঝা অসম্ভব। এটা যে ছোঁয়াচে নয়, সেটাও সবাই জানেনা। আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহ একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। খাবারে ও পানিতে আর্সেনিকের প্রভাব কমানোর উপায় নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। যেমন ফিল্টার একটা টেকসই সমাধান। বাসাবাড়িতে খাওয়া ও রান্নার কাজে ফিল্টার ব্যবহার করলে আর্সেনিক ক্ষতি করতে করবে না। বাংলাদেশে আর্সেনিকের মান ৫০ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন)। বাকী পৃথিবীতে যেটা ১০ পিপিবি। এই সমস্যা প্রতিরোধে অনেক কাজ করতে হবে, লাগবে অর্থের জোগান।তবে পানিকে আর্সেনিকমুক্ত হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হলেও এটা স্থায়ী সমাথান নয়। আমাদের তাই ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানি ব্যবহারের কথা ভাবতে হবে। সরকারের বিভিন্ন সংশ্লিষ্টপ্রকল্পের সঙ্গে কাধ মিলিয়ে ২০০৯ সাল থেকে ‘প্রবাহ’নামের একটি প্রকল্পবাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পানি শোধনাগার প্লান্ট বসিয়ে বিশুদ্ধখাবার পানি সরবরাহের কাজ করেচলেছে | জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে সরকারের প্রচেষ্টাকে বলিষ্ঠ করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ 'প্রবাহ' প্রকল্পের মাধ্যমেঅসংখ্য মানুষের জন্য নিরাপদ খাবার পানির ব্যবস্থা করে যাচ্ছে | বিশুদ্ধ পানি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞজনেরা বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন; যেমন:সরকারি/বেসরকারিভাবেএমন প্রকল্প হাতে নিতে হবে যেন সর্বসাধারণসাশ্রয়ী মূল্যে বিশুদ্ধ খাবার পানি পেতে পারে;আর্সেনিকের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার জন্য গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে; এবং ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেবিকল্প পানির উৎস তৈরী করতে হবে। চলমান -
×