ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রবিনদের কেউ বলে টোকাই, কেউ বলে কুলি

প্রকাশিত: ১০:২৭, ৩০ মার্চ ২০২০

 রবিনদের কেউ বলে টোকাই, কেউ  বলে কুলি

রশিদ মামুন ॥ রবিন, এই শহরে ওর কোন হোল্ডিং নাম্বার নেই। কেউ বলে টোকাই কেউ বলে কুলি। বেসরকারী সংস্থা আর সরকারের দফতরের নথিতে রবিনদের পরিচয় পথশিশু অথবা ছিন্নমূল মানুষ। রবিনের অফিস-বাসা সবই রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। দিনে রাতে এখানে অসংখ্য মানুষ আসেন। রবিনরা তাদের মালামাল ট্রেনে তুলে দেয়, নামিয়ে দেয়। রবিনের ভাষায় মাল টানি সেখান থেকে যা পাই তাই দিয়ে চলি। অন্যদের অফিসের মতো রবিনের সেই অফিস এখন বন্ধ। অফিস বন্ধের পর ছুটি নিয়ে কেউ বাড়ি গেছেন অথবা ঢাকায় ঘরের মধ্যে সুরক্ষিত রয়েছেন। কিন্তু রবিনের সেই বাসা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন যেখানে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতকে উপেক্ষা করে মশার সঙ্গে, ট্রেনের হুইসেলের সঙ্গে, কু ঝিক ঝিক শব্দ আর অসংখ্য মানুষের হট্টোগোলের সঙ্গে যুদ্ধ করে একটু ঘুমাতো, সেখানেও তো তালার ওপর তালা ঝুলছে। অফিস বন্ধ বাসায়ও, তাই তালা ঝুলছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে হাত ধোয়া মাস্ক পরা তো দূরের কথা মানুষকে ঘরে থাকার যে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে তার থেকে বহু দূরে রবিনদের অবস্থান। রবিনদের ঠিকানা পথ, সেই পথেই পড়ে রয়েছে। ফেরা যাক রবিনের গল্পে বাড়ি কুমিল্লায় মা নেই। বাবা তাই থেকেও নেই। কিভাবে রবিন এই স্টেশনে জানতে চাইলে বলল মা মারা যাওয়ার পর বাবা তাকে এখানে ফেলে গেছেন। ঠিক কত দিন আগের ঘটনা এটি মনে করতে পারল না। দেখে মনে হয় বয়স বছর বারো, এর বেশি নয়। তবে রবিন যেহেতু বুঝতে পেরেছে তাকে ফেলে যাওয়া হয়েছে তখন সে নিশ্চই খুব ছোট ছিল না। তবে সেসবের কিছুই খুব একটা মনে নেই রবিনের। চটপটে চেহারায় ক্ষুধায় মলিনতা জমেছে। রেলস্টেশনে পানি নেই তাই গোসল হয়নি কয়েকদিন দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রবিনকে ফেলে যাওয়ার চিত্র যদি মনে করিয়ে দিতে গিয়ে বলি একদিন তোর বাবা। সে বলতে শুরু করলো ‘আব্বা একদিন আমারে ঢাকায় নিয়ে আসছিল। এরপর এই কমলাপুরে বসায়ে রাইখ্যা চইল্যা গেছে’ নিঃসন্দেহে এই পিতা পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম পিতাদের একজন। যে তার শিশু বাচ্চাকে ফেলে গেছে মমতাহীন শহরের কোটি মানুষের ভিড়ে। হয়তো এই পিতা মন ভোলাতে ভোলাতে তার শিশু সন্তানকে শহরে নিয়ে এসেছিল। শিশুটির মন তখন নতুন শহর দেখার আনন্দে নেচে উঠেছিল। এরপর এই স্টেশন চত্বরে শিশুটিকে বসিয়ে রাখার আগে বাবা নিশ্চয়ই বলেছিল খবরদার কোথাও যাবি না। আমি তোর জন্য এটা নিয়ে আসছি ওটা নিয়ে আসছি আরও কত কি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বাবা অনেক কিছু নিয়ে ফিরে আসবে বসেও ছিল রবিন। কিন্তু বাবা আর ফেরেনি। অনেকক্ষণ থেকে গেলে শঙ্কা জাগলে এ প্ল্যাটফর্ম থেকে ও প্ল্যাটফর্মে ঝাপসা দুই চোখ বাবাকে খুঁজে ফিরেছে। কিন্তু বাবা আর তাকে খোঁজেনি। খুঁজলে ছোট্ট এই জায়গায় রবিনকে পাওয়া যেত অবশ্যই। এরপর রবিন হয়তো চিৎকার করে কেঁদেছিল। আর এখানের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করেছিল। আজ সেই পরিবেশও তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে নতুন এই বাস্তবতায়। সেখানে রবিনের খাবার নেই। শুধু কি রবিন, না। বিজয়, রামেল, আব্দুল্লাহ, রাকিবদের মতো অনেকেই একই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। যাদের কারোই এই শহরে কোন হোল্ডিং নাম্বার নেই। এরা সবাই খেতে চায় এরা সবাই খেয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে এদের খাবারও বন্ধ হয়ে গেছে। পথে মানুষের আনাগোনা কম। কেউ স্টেশনের এদিকে রিক্সা থেকে নামলেই মনে করছে কিছু পাওয়া যাবে। একঝাঁক শিশু দৌড়ে আসছে। খেতে পাই না বলে হাত পাতছে। কেন কেউ কোন খাবার দেয়নি এমন প্রশ্নে রাকিব বলল একটা গাড়ি আসে। বড় মানুষগুলো হাত বাড়ায় হট্টোগোল করে কেউ পায় কেউ পায় না এভাবে চলে যায়। পুরো বিষয়টি একটি পদ্ধতির মধ্যে নিয়ে না এলে এই শিশুদের পক্ষে খাবার পাওয়া সম্ভব নয়। কর্মহীন মানুষ যারা প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আয় করত যা দিয়ে কেবল এক দিন বা দুদিন চলে তারাও এখন বেকার। ফলে খাবারের খোঁজ তারাও করছেন। আর ক্ষুধার যন্ত্রণা যেহেতু রবিন বা রাকিবদের মতো ওদেরও তাই ছোট্ট হাতগুলো ছাপিয়ে বড় ক্ষুধার্ত হাতগুলো খাবার খাবলে নিচ্ছিল। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী দরিদ্র মানুষের চলার দায়িত্ব নেয়া হয়েছে। দেশের অনেক জায়গাতে প্রশাসন থেকে চাল ডাল বিতরণ চলছে। কিন্তু ঢাকায় যারা একেবারে পথে পড়ে রয়েছে তাদের খবর রাখছে না কেউ। ওকে চাল ডাল দিলেই তো আর হবে না ওদের তো রান্নার জায়গাও নেই। ঢাকার বাইরে অন্য জেলাগুলোতে জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকে গরিব মানুষকে ঘরে ঘরে চাল ডাল পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। শুধু প্রশাসন নয়, ঢাকার বাইরে সংসদ সদস্যরাও একই কাজ করছেন। ঢাকার জেলা প্রশাসক আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খানের কাছে এ ধরনের কোন উদ্যোগ রয়েছে জানার জন্য ফোন করা হলে তিনি সাড়া দেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তার উত্তর মেলেনি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন সাধারণ ছুটিতে ঢকার বাইরে চলে গেছেন অনেক লোক। যাওয়ার সময় এদের প্রধান বাহনের একটি ছিল ট্রেন। আবার ছুটি শেষ হলে এরা ফিরে আসবেন। তখন এসব শিশুরা যাত্রীদের সংস্পর্শে যাবেন। এভাবে তারা আবার নতুন যাত্রীদের সংস্পর্শে যাবেন। সঙ্গত কারণে এদের বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। যার কিছুই করা হয়নি। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলন, শিশু অধিকার আইন অনুযায়ী শিশুদের সুরক্ষা দেয়া সরকারের দায়িত্ব। সেই সুরক্ষার মধ্যে অবশ্যই স্বাস্থ্য সুরক্ষাও রয়েছে। সরকারের উচিত এসব দিকে নজর দেয়া। একই সঙ্গে বেসরকারী সংস্থা এবং সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন। ব্যক্তি উদ্যোগে কেউ কেউ কিছু উদ্যোগ নিলেও সেগুলোর মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। ফলে এক জায়গাতে সাহায্য পেলেও অন্য জায়গাতে কেউ কিছু পাচ্ছে না। পথ শিশুদের মধ্যে কেউ মাদক গ্রহণ করে উল্লেখ করে বলেন এ ধরনের শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। সঙ্গত কারণে তারা করোনা আক্রান্ত হলে বিপদ ঘটতে পারে। শিশুদের নিয়ে কাজ করে আসা সংগঠন খেলা ঘরের সাধারণ সম্পাদক প্রণয় সাহা বলেন, আমরা কিছু বস্তিতে গিয়ে দেখেছি তাদের খাবার নেই। আবার তারা সব প্রতিরোধমূলক নির্দেশনাও মানছে না। আমরা কিছু হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করেছি। কিন্তু আমাদের সকলকে খাবার দেয়ার সামর্থ্য নেই। তারপরও আমরা তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করছি। জানতে চাইলে মহিলা এবং শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী রওশন আক্তার বলেন, আমাদের যেসব শেল্টার হোম রয়েছে সেখানে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা যেন বাইরে না আসে। তাদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পথ শিশুদের সবাই এই শেল্টার হোমে থাকে না। যারা বাইরে রয়েছে তাদের বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়া হবে কি না জানতে চাইলে বলেন, এ বিষয়ে আমার কাছে কোন খবর নেই। আমি কথা বলে দেখছি।
×