ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্নায়ুযুদ্ধ থেকে মুক্তি সংগ্রাম

প্রকাশিত: ০৮:০৪, ৩০ মার্চ ২০২০

 স্নায়ুযুদ্ধ থেকে মুক্তি সংগ্রাম

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার ঝাঁপিয়ে পড়ার পটভূমিকা তৈরি হয় যখন আমি ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান করি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হতে আমরা ১৫ জন বাঙালী রিক্রুট করাচী শহরের অদূরে কোরাংগী ক্রিকে অবস্থিত পাকিস্তান বিমান বাহিনী ঘাঁটির Technical Training Institute এ আগমন করি। সেখানে আরও ৭০ জন পাকিস্তানী (পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধী, বেলুচি) আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। আমরা সবাই পাকিস্তান বিমান বাহিনীর Technical Branch-এ শিক্ষানবিস হিসেবে প্রশিক্ষণ আরম্ভ করি। এখানে লক্ষ্য করলাম জনসংখ্যার তুলনায় প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বাঙালী প্রতিনিধিত্বের অনুপাত (৭০:১৫) অত্যন্ত বৈষম্যমূলক ও হতাশাব্যঞ্জক। মন বিগরিয়ে উঠল। যথারীতি আমাদের প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিলেন আমাদের General Service Training-এর শিক্ষক। তিনি অত্যন্ত কড়া ও কঠোর নিয়মানুবর্তী শিক্ষক হিসেবে আমাদের বিমান ঘাঁটিতে পরিচিত ছিলেন। প্রশিক্ষণকালে তিনি আমাদের (বাঙালীদের) খুব কড়াভাবে গুরুত্ব দিয়ে চুপি চুপি বলতেন ‘এই গরু চোরেরা- তোমরা কি এখানে (পশ্চিম পাকিস্তানে) ঘোড়ার ঘাস কাটতে আসছ। জাগো, শিখ, ঠিকভাবে কঠোর পরিশ্রম কর একদিন কাজে লাগবে’- এ উক্তি দিয়ে তিনি কি অর্থ করলেন কিছুই উপলদ্ধি করতে পারতাম না। তখন পর্যন্ত আমরা ওনাকে একজন প্রশিক্ষক হিসেবেই জানতাম। তার অধিক কিছুই জানতাম না। দীর্ঘদিন পর জানতে পারলাম তিনি এবং বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়’ অভিযুক্ত হয়ে ঢাকা সেনানিবাসে সামরিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহযোদ্ধা সার্জেন্ট জহুরুল হক পাকসেনা তত্ত্বাবধানে কারারুদ্ধ। সেখানেই এই দেশপ্রেমিক বীর বিমান সেনা বর্বর পাক নিরাপত্তা সেনা কর্তৃক কাপুরুষোচিতভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন। তার এই মর্মান্তিক হত্যাকান্ডে আমরা বাঙালী বিমান সেনারা বিশেষ করে যারা আমরা ওনার সরাসরি শিক্ষানবিস গভীরভাবে শোকাহত হয়েছি। আর তখনই আমরা উপলদ্ধি করতে পারলাম শিক্ষাকালীন সময়ে দেশপ্রেমিক এই বীর বিমান সেনা আমাদের তার দুরদর্শী উক্তি দিয়ে কি বোঝাতে চেয়েছেন। তার দুরদর্শিতা, দেশপ্রেম ও ত্যাগ আমাদের মনে চির অম্লান হয়ে থাকবে এবং আমাদের ভবিষ্যত কর্মতৎপরতায় প্রবল অনুপ্রেরণা যোগাবে। পাক সামরিক জান্তার এই ঘৃণ্য কুকর্ম চলমান ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানকে আরও বেগবান করে তোলে। যার ফলশ্রুতিতে সামরিক জান্তা বাধ্য হয়ে মিথ্যা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নেয় এবং বঙ্গবন্ধুসহ সবাইকে বিনা শর্তে মুক্তি দেয়। বিমান বাহিনীর ভাষা হলো ইংরেজী। তাই আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমও ইংরেজী। আমরা বাঙালীরা বরাবরই ইংরেজীতে ভাল ছিলাম। আমাদের বাঙালী শিক্ষকরা ইংরেজীতেই শিক্ষা দিতেন। আমাদের কোন অসুবিধা হতো না। কিন্তু পাকিস্তানী শিক্ষকরা শিক্ষা কার্যক্রমে তাদের দেশীয় শিক্ষানবিসদের সঙ্গে স্থানীয় ভাষায় বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতে কোন দ্বিধা করত না। কিন্তু আমরা যদি তাদের মতো করতাম তারা এটাকে আমাদের ক্ষেত্রে অপরাধ হিসেবে ধরে নিত। এটা Air Force Standing Rule বহির্ভূত। উর্দু ভাষার প্রাধান্যতা ও প্রবণতায় তারা ভাষাবৈষম্য সৃষ্টি করেছিল যা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহর বাঙালীদের ওপর একতরফাভাবে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার সঙ্গে মিল দেখা যায়। ভাষা-বৈষম্যের ইস্যুটি বাঙালী প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের আরও ক্ষুব্ধ করে যা প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনই বৈষম্য আচরণ তারা উপেক্ষা করে চলত। আরও অন্যান্য ক্ষেত্রে তারা আমাদের সঙ্গে অত্যন্ত আপত্তিকর বৈষম্যমূলক নীতি অবলম্বন করে চলত। রাজনৈতিক ইস্যুতে অনেক কিছু আসে। সামরিক বাহিনীতে কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার ভিতরে প্রতিবাদ করার কোন সুযোগ নেই। ক্ষোভ ও প্রতিবাদকে মনের মধ্যে সুপ্ত করে রাখলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম যে পাকিস্তানীদের কোন ভাবেই আমাদের ওপর Dominate করতে দেব না। এখানে সংখ্যায় আমরা যাই হই আমাদের মান ও মেধা দিয়ে তাদের Supersede করতে হবে। এই সংকল্প মনে নিয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষা কোর্স চালিয়ে যেতে লাগলাম। প্রথম বর্ষেই ব্যাচে আমি সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করলাম। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষেও আমি একই Position ধরে রাখলাম। প্রশিক্ষণ কোর্সের ৩টি শাখায়ই (General Service Training, Education, Trade) আমি সাফল্য তালিকায় শীর্ষে স্থান পেলাম। শেষ বর্ষে অর্থাৎ ৩ বছর ৩ মাস পর সমাপনী কুচকাওয়াজে (Apprentices Passing out Parade) আমি সর্বশ্রেষ্ঠ (All Round Best Apprentice) শিক্ষানবিস হিসেবে সাফল্য লাভ করলাম। প্রধান অতিথি Commodore M.A. Ayiz. of Pakistan Navy আমাদের সামরিক অভিবাদন গ্রহণ করলেন এবং আমাকে চৌকস ট্রফি (All Round Best Trophy) প্রদান করলেন। এবং এর পাশাপাশি, পাকিস্তান বিমান বাহিনী আমাকে PAF College of Acronautical Engineering a Degree Course এ যোগ্যতা অর্জনে সুপারিশ করলেন। এই জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানটি পাকিস্তান TV, The Daily Morning News এ ফলাও করে প্রচার হয়। একজন গর্বিত বাঙালী বিমান সেনা হিসেবে আমার মনোবল যথেষ্ট পরিমাণে বেড়ে যায়। আমার এই সাফল্য পাকিস্তানীরা সেদিন তাদের হিংসাত্মক মনোভাব প্রকাশ করারও কোন সুযোগ পেল না। আমার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছার প্রথম ধাপে উত্তীর্ণ হলাম। ১৯৬৫ সালেন ১৭ দিনের পাক-ভারত যুদ্ধ ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের জন্য একটি প্রয়োজনীয় শিক্ষা। কারণ সামরিক দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তান ছিল সার্বিকভাবে অরক্ষিত। সেই সময় ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করত এই প্রদেশে এমন কোন সামরিক শক্তি ছিল না সে আক্রমণ প্রতিহত করার। আমরা বুঝতে পেরেছি পাকিস্তানী শাসকরা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে কতটা দুর্বল করে রেখেছে এবং বহিঃশত্রুর দয়ার ওপর রেখে দিয়েছে। পাকিস্তানের বাজেটের অর্ধেকের বেশি অর্থ ব্যয় হয় প্রতিরক্ষা খাতে যার অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তান সুরক্ষার কাজে ব্যবহৃত হতো। অথচ এই অর্থের সিংহভাগই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে যোগান দিতে হতো। সার্বভৌম ও অখন্ড পাকিস্তানে এ ধরনের বৈষম্যমূলক ও দ্বৈতমান Double-Standard নীতি চলতে পারে না। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আধিপত্য হতে আমরা স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে পুনরায় পাকিস্তানী শাসকদের ঔপনিবেশিক ভাবধারার খপ্পর হতে ২৩টি বছর আমরা বাঙালীরা মুক্ত হতে পারিনি। রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বাঙালীদের শোষণের ও অধিকার হরণের চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। ক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী মন বার বার প্রতিবাধমুখী হয়ে ওঠে। সামরিক বাহিনীর কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার ভিতর থেকে প্রতিবাদ করার অবকাশ নই। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে আমার মধ্যে একটা স্নায়ুযুদ্ধের অবতাড়না হয়। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান দীর্ঘদিনের অধিকারবঞ্চিত বাঙালীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভেরই বহির্প্রকাশ। এই গণবিপ্লবে বাঙালী সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পূর্ণ সমর্থন ছিল। প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই আমরা বাঙালীর অবিসংবাদিত মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলাম। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের The Dawn, The Morning News খবরের কাগজের Landshide Victory for অধিসর শিরোনামে জোড়ালোভাবে প্রকাশ পায়। প্রফুল্ল মনের দৃঢতা অনেক বেড়ে যায়। আমাদের অধিকারের কথা বলার সুবর্ণ সুযোগ আমরা পেতে যাচ্ছি। ১৯৭১ এর মে/জুনের দিকে আমার ছুটি মঞ্জুর হয়। এই সুযোগকে আমি হাতছাড়া করতে চাইনি। যে স্নায়ুযুদ্ধ পাকিস্তান থেকে শুরু করেছি তাকে সময়ের প্রয়োজনে মুক্তিসংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ দিতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম। কালবিলম্ব না করে আমার গ্রামের আজিজ বেপারীকে (যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত-বাংলাদেশে আনা-নেওয়া করেন) নিয়ে সীমান্ত পার হওয়ার উদ্দেশে বাড়ি ত্যাগ করলাম। পথিমধ্যে আরও কয়েকজন ছাত্র-অছাত্র যুবক আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। আমার বয়স তখন ১৯। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কশবা হয়ে যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা রোডে টহলরত পাক বাহিনী আমাদের চলাচল আঁচ করতে পেরে বৃষ্টির মতো এলোপাতারি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আমরা ঈৎধষি করে কিছু দূরে এক কৃষকের বাড়িতে উঠলাম। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী। আমাদের আপ্যায়ন করল। আমার সঙ্গের বেসামরিক ভাইদেরকে সান্ত¡না দিলাম। ভোর হওয়ার পূর্বেই আমরা একটি শ্যালো নৌকা নিয়ে স্থলসীমান্তে পৌঁছলাম। মাধবপুর হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় পৌঁছলাম। সেখানে ‘জয় বাংলা ভবনে’ বঙ্গবন্ধুর নিকটতম ছাত্রনেতা ডাকসুর তৎকালীন ভিপি আ.স.ম আব্দুর রবের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে আগরতলার অদূরে সূর্যমনিনগর Military Holding Camp এ পাঠিয়ে দিলেন। আমার সঙ্গে কয়েকজন বেসামরিক যুবককে বেলোনিয়া মুক্তিবাহিনী ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিলেন। Military Holding Campwটি ছিল সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর লোকদের নির্ধারিত থাকার জায়গা। সেখানে সেনা বাহিনীর লোকের সংখ্যা ছিল বেশি আর নৌ ও বিমানবাহিনীর লোক খুব কম। হাতে গোনার মতো কয়েকজন। ইতোমধ্যে আরও কয়েকজন বিমান সেনা এলেন। ফ্লা: সার্জেন্ট সরকার। সার্জেন্ট ফজলুল হক, সার্জেন্ট আখতার, কপল আ: বর, সার্জেন্ট সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারীর সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয়। আমাদের কোন পেশাগত ইকুপমেন্ট ছিল না। তাই কোন কোন বিমান সেনা তাদেরকে Misfit করতে চায়নি। আমি পাক বিমান বাহিনীর General Servic Training এ যা শিখেছি তাই নিয়ে শত্রু মোকাবেলার জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। সদ্য ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে অপারেশনে চলে যাই। প্রথম দিকে বিক্ষিপ্তভাবে (Scattered Way) কিন্তু অবিরাম, যুদ্ধ চলতে থাকে। আমরা গেরিলা যুদ্ধের Hit and Run পদ্ধতিতে এ হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলা করতে থাকি। বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কথাশিল্পী, অসাধারণ মেধার অধিকারী সাহসী মুক্তিযোদ্ধা এম আর আখতার মুকুল যুদ্ধকালীন ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্মরণীয় ও জনপ্রিয় “চরমপত্র” অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে পুনঃ পুনঃ পাল্টা আক্রমণের যে সাহস ও প্রেরণা রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের যুগিয়েছেন তা আমাদের হৃদয় আজও প্রোথিত রয়েছে। তাঁর একক স্টাইলে বলা ‘মুক্তিবাহিনী বিচ্ছুগর ক্যাচ কামাইয়ের চোটে খান সেনাদের মাজা ভেঙ্গে গেছে’ আরও অনেক কথায় আমাদের এত অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যেও আমরা উল্লসিত ও উৎফুল্ল থাকতাম। সর্বান্তকরণে আমরা মহান এই ভাষাসৈনিক মুক্তিযোদ্ধার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। যুদ্ধশেষে বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দেই। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা যথারীতি পদোন্নতি পাই। ১৯৭২ এর প্রথমার্ধে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি, বাশার, পরিদর্শনে আসেন। তাঁকে আমরা ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করি। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিমান বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় একটি শক্তিশালী বিমান বাহিনী গড়ার প্রয়োজনীয়তার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। বঙ্গবন্ধুর জোরালো বক্তৃতায় আমরা উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের পেশাগত কাজে আত্মনিয়োগ করি। ১৯৭৩ এর অক্টোবরে আমি বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে অব্যাহতি প্রাপ্ত হই। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে পৃথিবীর সবচেয়ে বর্বর, ঘৃণ্য, নৃশংসতম হত্যাকান্ডের পর, ক্ষোভ ও ঘৃণায় আমি দীর্ঘদিনের জন্য বিদেশে চলে যাই। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘সনদ’ ও আমি সংগ্রহ করি নাই। আমি পশ্চিম জার্মানিতে পুনঃ একত্রিকরণের পূর্বে রাজনৈতিক আশ্রয় চাই। জার্মান ভাষা খুব ভাল করে শিখি এবং জার্মান পত্র-পত্রিকা (Dic Welt, Das Tagcblatt, Dic Frankfurter Rundshau) আগ্রহের সহিত পড়তে থাকি এবং জার্মানদের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ রক্ষা করে চলি। আকর্ষণীয় বেতনে একটি উপযুক্ত কাজও পেয়ে যাই। সময়ের অন্তরালে জার্মান সমাজের সঙ্গে একটি নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে তুলি। প্রসঙ্গক্রমে জার্মান পত্রিকার একটি সংবাদ আমাকে আকৃষ্ট করে। সেখানে নোবেল বিজয়ী জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট মন্তব্য করেন ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালীদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যে কোন জঘন্য কাজ করতে পারে।’ অন্য একটি পত্রিকা মন্তব্য করে ‘শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জনগণ তার কাছে এত প্রিয় ছিল যে, লুইয়ের মত তিনি এ দাবি করতে পারেন আমি-ই রাষ্ট্র।’ তাছাড়া আমি সুইজারল্যান্ডে, নরওয়ে এবং গ্রীসেও ছিলাম। যেখানেই বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে বিদেশীদের সঙ্গে আলোচনা হতো আমি অত্যন্ত আশ্চার্যান্বিত হইতাম তারা আমাদের মহান নেতাকে কত উর্ধে স্থান দিতেন। তিনি দেশের জন্য প্রচুর আন্তর্জাতিক সুনাম অর্জন করেছিলেন এবং বহির্বিশে এদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছিলেন। ইতিহাসের বর্বর, জঘন্য ও নির্মম হত্যাকান্ডকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যাপক ও তিক্তকণ্ঠে নিন্দা করেছিলেন। সেখানেই আমি গভীরভাবে অনুভব করি কি একজন মহান জন্মগত নেতা আমরা হারিয়েছি। এই মর্মান্তিক হত্যাকান্ড দেশের ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে ভীষণভাবে ক্ষুণ্ণ করেছিল। দীর্ঘদিন পর মুক্তিযোদ্ধাবান্ধব ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় আসলে আমি দেশে ফিরে আসি। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় দেশ শাসনে বলিষ্ঠ ও গতিশীল নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যার ফলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে এবং সরকার প্রতিনিয়ত মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণের জন্য সচেষ্ট রয়েছে। আমরা সেজন্য অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীও আমাদের মূল্যায়ন করছে। বিমান বাহিনী কর্তৃপক্ষ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিমান বাহিনী সদস্যদের মূল্যবান দলিলপত্র (আমাদের রেকর্ড) সযত্নে সংরক্ষণ করছে। যার জন্য দীর্ঘদিন পরে হলেও বিমান বাহিনী কর্তৃক সংরক্ষিত মূল দলিল পত্রের সমর্থনে মুক্তিযুদ্ধে আমার অবদানের স্বীকৃত সনদ’টি পাই। আমরা তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। জাতির শ্রেষ্ঠ ও বীর সন্তান আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে এবং অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত থেকে স্বাধীনতা বিরোধীদের যে কোন অপকর্ম ও ষড়যন্ত্রে শক্ত হাতে প্রতিহত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। সর্বশেষে মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং তাদের পবিত্র আত্মার মাগফিরাত কামনা করে লেখা শেষ করছি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, মহান মুক্তিযুদ্ধ অমর হউক। লেখক : প্রাক্তন কর্পোরাল ও মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী
×