ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গ্রামীণ অর্থনীতিতে টেকসই বিনিয়োগ অপরিহার্য

প্রকাশিত: ১১:২৯, ২৯ মার্চ ২০২০

গ্রামীণ অর্থনীতিতে টেকসই বিনিয়োগ অপরিহার্য

ইতালির রাজধানী রোমে আইএফএডির ৪১তম পরিচালন পর্ষদ সভায় উদ্বোধনী ভাষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূর করতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ একটি বিবেচ্য বিষয় যা অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা ছাড়া অর্জন সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয় যার জন্য একটি ব্যাপকভিত্তিক টেকসই গ্রামীণ অর্থনীতি প্রয়োজন। এখানে বিনিয়োগ বলতে প্রধানমন্ত্রী উন্নয়ন সহযোগীদের আরও বেশি করে বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসতে বলেছিলেন। স্থিতিশীল দারিদ্র্য বিমোচন নিশ্চিত করার জন্য শুধু শহর নগর নয়, গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগও একটি বিবেচ্য বিষয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা ছাড়া এই অর্জন করা সম্ভব নয়। এর অংশ হিসাবে বাংলাদেশ ও ইফ্দ. দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ছয়টি জেলায় অবকাঠামো উন্নয়ন ও বাজার সম্প্রসারণে ৯২ দশমিক ০৩ মিলিয়ন ডলারের একটি ঋণচুক্তি সম্পাদন করে চলছে। যার মাধ্যমে ৩ দশমিক ৩০ কোটি মানুষ উপকৃত হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিককালে দেশের দারিদ্যের হার ২০ দশমিক ৩ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৯ শতাংশে নেমে এসেছে যার মধ্যে দেশের গ্রামাঞ্চলের অবস্থার উন্নতি শহরের তুলনায় বেশি। এখনও দেশের মোট জনসংখ্যা ৫৬ শতাংশ গ্রামে বসবাস করে কিন্তু ক্রমাগতভাবে গ্রামের সংখ্যা কিংবা গ্রামীণ অর্থনীতির অবয়ব ক্রমেই কমে আসছে অব্যাহতভাবে নগরায়নের কারণে। একটি তথ্যে দেখা যায় যে, এক শতাংশ হারে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে যার সিংহ ভাগই হলো শিল্পায়ন ও বসতি স্থাপনের কারণে। বর্তমানে মাথাপিছু জমির পরিমাণ এক ডেসিমেলের নিচে চলে এসেছে বিশেষত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ও প্রকৃতি সৃষ্ট দুর্যোগে। গ্রামীণ জনপদে বসতি স্থাপন কারিরা উন্নতর জীবন ধারণের জন্য শহরে চলে আসছে ক্রমাগতভাবে। এখন গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে সকল মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে তাদের মধ্যে পদ্মা সেতু ছাড়া আর সব প্রকল্পেই দাতা গোষ্ঠীর অবদান রয়েছে যার ফল গ্রামীণ অর্থনীতিতে বসবাসকারী জনগণ পাচ্ছে। সময়ের আবর্তে দেখা যাচ্ছে যে, দাতাদের বিনিয়োগ ক্রমশই কমছে যা বর্তমান বছরে মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) মাত্র ১০ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার ৩ শতাংশে নিয়ে আসার চিন্তা ভাবনা চলছে বিশেষত স্বনির্ভর অর্থনীতির কথা চিন্তা করে। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে আমরা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি হিসেবে এরই মধ্যে অনেক অগ্রগতি সাধিত করেছি বিশেষত অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি উদীয়মান অর্থনীতির তালিকায় স্থান পেয়েছে সত্যি কিন্তু স্থায়িত্বশীলতার জন্য আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে এই দেশটির। এখন উন্নয়নে বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই সত্যি কিন্তু বিগত কয়েকবছর যাবত বেসরকারী বিনিয়োগ স্থবির হয়ে গেছে যা জিডিপির মাত্র ২৩ শতাংশ। ্এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অপর্যাপ্ত অবকঠামো, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও জমির স্বল্পতা। আবার শহর গ্রামের তুলনামূলক বিচারে গ্রামের অবস্থা খুবই করুণ যা বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে মোট ব্যাংক শাখার সংখ্যা ১০৪৬৭টি যার মধ্যে ৫০৬৯টি গ্রামে এবং ৫৩৯৮টি শহরে রয়েছে। অর্থাৎ অগণিত গ্রামীণ শাখাই গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মুখ্য মাধ্যম। বিনিয়োগের সিংহভাগ আসে গ্রাহকদের সঞ্চয় আমানত থেকে সেখানে দেখা যায় শহরে ও গ্রামের শাখার সঞ্চয়ের হার যথাক্রমে মোট সঞ্চয়ের ৮২ দশমিক ০ শতাংশ ও ১৮ দশমিক ০ শতাংশ। বিগত দশ বছরে দেশে ৩০০০ ব্যাংক শাখা খোলা হয়েছে এই নীতিমালায় কোন শহরে যদি একটি শাখা খোলা হয় তা হলে গ্রামে দুটি শাখা খুলতে হবে। আমরা যদি বিনিয়োগের চিত্র বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যায় যে, মোট বিনিয়োগের মাত্র ১০ দশমিক ২৪ শতাংশ গ্রামীণ অর্থনীতিতে হয়ে থাকে যা দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন কতটুকু সম্ভব? আবার যদি বিভাগ ওয়ারী বিনিয়োগ চিত্র দেখি তা হলে পাওয়া যায় শহর-গ্রামে বিনিয়োগ চিত্রে ঢাকা বিভাগ সর্বোচ্চ এবং বরিশাল বিভাগ সর্বনি¤েœ রয়েছে। আরও তথ্যে দেখা যায় ঢাকা বিভাগে মাথাপিছু বিনিয়োগ ৬১,০৩৬ টাকা এবং বরিশাল বিভাগে মাত্র ৫৬৭০ টাকা যা আঞ্চলিক বৈষম্যের একটি উজ্জ্বল চিত্র। এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সাম্প্রতিক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে এবং সরকারী অর্থায়নে ব্যাংক ঋণের ব্যবহার কমাতে উদ্যোগী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কাজেই এই প্রেক্ষাপটে আমরা যদি গ্রামীণ অর্থনীতিতে কেবল দাতা সংস্থা কর্তৃক বিনিয়োগ কিংবা এর মাধ্যমে উন্নয়নের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে যে উন্নয়ন সহযোগীরা তাদের মডেলের মাধ্যমে একটি সময়ের আবর্তে কাজকরে দেয়। কিন্তু চুক্তি মোতাবেক কাজ সমাপনান্তে সরকারকেই তার প্রাতিষ্ঠানিক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিতে হয়। আবার সেগুলো যদি বিনিয়োগ প্রকল্প হয় তখন ঘূর্ণায়মান তহবিল হিসাবে সেগুলো কাজ করে থাকে। কিন্তু দেশ স্বাধীনতার ৪৯ বছরের অভিজ্ঞতা বলে দিচ্ছে, যে গতিতে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল তা হয়ে উঠেনি কেবল উদ্যোক্তা সৃষ্টির দৈন্যতার কারণে। কারণ এই ধরনের অনেক বৈদেশিক সাহায্য পোস্ট প্রকল্প মেয়াদ শেষে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে রূপ নিয়েছে যেমন আর.ডি ১০ প্রকল্প বর্তমানে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন, ক্ষদ্র কৃষক উন্নয়ন প্রকল্প যেমন ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, যেমন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ইত্যাদি। কিন্তু তাদের কার্যক্রম গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কি সুফল নিয়ে এসেছে তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক প্রায় ৮৬ লাখ গরিব পরিবারকে ক্ষুুদ্র ঋণের মাধ্যমে তাদের কর্মক্ষমতার উন্নয়নে অবদান রাখছে যার সবটুকুই প্রায় বিনিয়োগ কর্মসূচী যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এখন তাদের স্থায়িত্বশীলতার অবস্থাটা কি হবে যদি গ্রামীণ ব্যাংক তাদের ঋণ সহায়তার দরজাটি বন্ধ করে দেয়। গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বড় খাত হলো শস্য উৎপাদন, পশু পালন, মৎস্য খামার তৈরি, বনায়ন ইত্যাদি। কিন্তু সনাতনী কায়দায় পরিবারভিত্তিক কৃষি কাজে বিনিয়োগের তেমন খুব একটা সুযোগ থাকে না প্রথাগত ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে। আবার গ্রীন হাউসভিত্তিক কৃষি কাজের অপূর্ব সুযোগ থাকলেও উদ্যোক্তা পাওয়া দুষ্কর অপরদিকে বিনিয়োগ প্রাপ্তির রাস্তাটিও খুব সহজতর নয় অথচ চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডীয়া, মালয়েশিয়া বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষি কাজ করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যা আমরা পাড়ছি না। কেন? কারণ একটাই উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে না কিংবা আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা আমাদের এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করতে বিরত থাকছে। তারপরও গ্রামীণ অর্থনীতিতে কিছুটা রূপান্তর এসেছে মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এবং বাজারে এখন যে মাছের কেনাবেচা চলছে তার সিংহভাগ চাষকৃত মাছ, প্রাকৃতিক জলাশয় যেমন হাওড়, বাঁওড়, বিল ইত্যাদি থেকে নয়। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে তেমন সফলতা আসছে না কেবল উদ্যোক্তার অভাবে তাও বলা যাবে না। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারী খাতে সহায়ক নীতিমালার অভাব। পশু খাদ্যের অত্যধিক মূল্য, ওষুধের অপর্যাপ্ততা, ঘাস চাষের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে অদক্ষতা, গুঁড়া দুধ আমদানি ইত্যাদির কারণে পশু সম্পদ খাতটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে গ্রামীণ অর্থনীতিতে আশানুরূপ অবদান রাখতে পারছে না। এ সকল সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সময়মতো উদ্যোগ গ্রহণ ও তার সফলতার চিত্র আমরা চ্যানেল আইয়ের মাটি মানুষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অবহিত হয়ে থাকি। আমাদের দেশে ব্যবসা প্রশাসনে ডিগ্রী নিয়ে উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী হয় না কিংবা একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হতে স্বপ্ন দেখে না। এটা আমাদের ব্যবসা প্রশাসনে শিক্ষক-শিক্ষা-প্রশিক্ষণের দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই নয় যা কেবল মজুরি নির্ভর চাকরিবান্ধব, স্বনিয়োজিত কর্মবান্ধব নয়। আমাদের ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে যেতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১০ দশমিক ০ শতাংশে উন্নীত করার প্রয়োজন রয়েছে যা কেবল গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিচালিত গ্রাম্য পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমেই সম্ভব যার বেশির ভাগ খাদ্য পণ্যের সঙ্গে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তার সম্পর্ক রয়েছে। এখন আমাদের সময় এসেছে বহুমাত্রিক চিন্তা ভাবনা করার এই সকল বিষয়গুলোতে যেমন এক, আমাদের নিবিড় চাষবাস বিশেষত কৃষিযান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমেই করতে হবে এবং এই দায়িত্বটি সনাতনী কৃষকের দ্বারা পালন সম্ভব হবে না। তাই কৃষি উদ্যোক্তাকে এগিয়ে আসতে হবে প্রশিক্ষিত হয়ে। শস্য কিংবা সবজি উৎপাদনে গ্রীন হাউস ভিত্তিক খামার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যার মাধ্যমে সারা বছরই সবজি সরবরাহ ভোক্তাদের মাঝে করা যাবে। কৃষি পণ্যের ব্যবসা হতে হবে একটি সুসংগঠিত শিল্প যেখানে একদিকে থাকবে উৎপাদন এবং অন্যদিকে থাকবে বিপণন। সরকারের অর্থায়ণে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অনেক গ্রাম্য হাটবাজার তৈরী হলেও তাদের সঠিক রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে তেমন স্থায়িত্ব পায় না যা প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতা মাত্র, তৃতীয়ঃ গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরে ষাটের দশকে সমবায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বিপণনের ক্ষেত্রে এবং সমবায় সমিতিগুলোর ভূমিকা তখন দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু সমবায়ভিত্তিক দুগ্ধশিল্পের প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরেও সারাদেশে তাদের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে পারেনি। আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে দুগ্ধ উৎপাদনকারীও জাতীয়ভাবে খুব যে রেকর্ড পরিমাণ দুগ্ধ খামারের মাধ্যমে উৎপাদন করতে পেরেছে তাও বলা যাচ্ছে না। আশির দশকে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষি ব্যাংক তার পশুপালন শাখার মাধ্যমে দুগ্ধখামারীদের অর্থায়নে এগিয়ে এসেছিল কিন্তু সে সকল খামার লাভজনকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি উপকরণ খরচ ও উৎপাদিত দুধের মূল্যের ব্যবধানের কারণে। এখানে প্রশ্ন আসে প্রযুক্তির এবং কেবল তরল দুধ বিক্রি না করে তা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে যদি দুগ্ধজাত দ্রব্য বাজারজাতকরণ করা যেত তাহলে লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি দেখা যেত। সর্বশেষে বলা যায় বিনিয়োগ অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এবং এই ধারাকে যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধরে রাখা যায় তাহলে গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি পাবে এবং টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে।
×