ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাস ও বিশ্ব অর্থনীতি

প্রকাশিত: ১১:২৯, ২৯ মার্চ ২০২০

করোনাভাইরাস ও বিশ্ব অর্থনীতি

করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ববাণিজ্যে তো বটেই, প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশেও। আর প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) মৃতের সংখ্যা। চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ২০০৩ সালে পৃথিবীতে আতঙ্ক তৈরি করেছিল সার্স। চীন থেকে উদ্ভূত হয়েছিল সার্স। ওই রোগে ৮ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল, মারা গিয়েছিল ৭৭৪ জন। সেই সময়ে বৈশ্বিক জিডিপির ৪ শতাংশ আসত চীন থেকে। তখনই বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্তত ৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলার ক্ষতি হয় বলে অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছিলেন। আর গত বছর বৈশ্বিক জিডিপিতে চীনের অবদান ছিল ১৬ শতাংশ। সুতরাং সার্সের তুলনায় বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব হবে আরও বিধ্বংসী। করোনাভাইরাস আতঙ্কে একের পর এক নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। বন্ধ হয়ে গেছে স্টেডিয়ামের খেলা থেকে শুরু করে বড় বড় সব বৈশ্বিক আয়োজন। স্কুল, কলেজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কমে আসছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞার কারণে লোকসানে পড়ছে বিশ্বের এয়ারলাইন্সগুলো। ঋণ খেলাপী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে বড় বড় প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিনই ধস নামছে প্রধান সব শেয়ারবাজারগুলোতে। জেপি মর্গান, বলছে পরপর আগামী দুই প্রান্তিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দেবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে। চলতি বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০১৯ সালের চেয়ে অর্ধেক কমে যাবে, জানিয়েছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডি। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে দুই দশমিক সাত ট্রিলিয়ন ডলারের লোকসান ঘটাবে, যা গোটা যুক্তরাজ্যের জিডিপির সমান। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান মন্দায় পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, বিশ্বে করোনাভাইরাস আক্রমণের কারণে অধিকাংশ বড় কোম্পানির কারখানায় উৎপাদন স্থগিত রাখা হয়েছে। আরও দুই মাস উৎপাদন বন্ধ থাকলে বিশ্ব প্রযুক্তিপণ্যের বাজারে বড় বিপর্যয় দেখা দেবে। করোনাভাইরাস আতঙ্কে বাতিল হয়ে গেছে প্রযুক্তি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আয়োজন মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস (এমডব্লিউসি)। প্রতি বছর এ আয়োজনেই নতুন প্রযুক্তিপণ্যের সঙ্গে পরিচয় করে দেওয়া হতো দুনিয়াকে। এমডব্লিউসির আয়োজক জিএসএমএ কর্তৃপক্ষ, করোনা ভাইরাসের বিস্তারজনিত চরম উদ্বেগজনক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি স্পেনের বার্সেলোনায় অনুষ্ঠিতব্য এমডব্লিউসির আয়োজন বাতিল করে দেয় । বিশ্ব অর্থনীতির জন্য করোনাভাইরাস ইতোমধ্যে মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে। চলতি বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা- যা হবে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর সর্বনিম্ন বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি। বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। চীনা লুনার ইয়ার উপলক্ষে প্রতিবছরই এ সময়ে পর্যটনমুখর থাকে চীনের হোটেল আর পর্যটন কেন্দ্রগুলো। পরিবারের টানে দেশে আসেন চীনারা। বিভিন্ন দেশ থেকে নতুন বছর উদযাপন করতে আসেন পর্যটকরা। যাত্রীসেবায় তাই ব্যস্ত থাকে এয়ারলাইন্সগুলো। কিন্তু এ বছরের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে ফিকে হয়ে গেছে উৎসবের আনন্দ। ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের উহান প্রদেশতো একরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে ব্যবসাবাণিজ্যে। চীন থেকে এখনও কাঁচামাল আমদানি না হওয়ায় তৈরি পোশাকসহ রফতানিমুখী বিভিন্ন খাতের পণ্য উৎপাদন নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানি হয় এমন দেশগুলোতেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় রফতানিতেও এর প্রভাব পড়েছে। এয়ারপোর্টের কাছেই এই এলাকায় প্রায় ৬০টির মতো কাঁকড়া ও কুঁচে প্যাকিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ১০/১২টি সেন্টার চালু আছে বাকি সব বন্ধ। যেগুলো চালু আছে সেগুলোতেও কাঁকড়া নেই বললেই চলে। কারণ কাঁকড়া ও কুঁচের ৯০ শতাংশই রফতানি হয় চীনে। চীনের ক্রেতারা কেনা বন্ধ করাতে এখন তাদের রফতানি বন্ধ। জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মাসে চীনা নববর্ষের কারণে কাঁকড়া ও কুঁচের চাহিদা বেশি থাকে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, চীন থেকে যদি সারাবিশ্বে কাঁচামাল রফতানি ২ শতাংশও কমে যায়, তাহলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতি হবে ৫০ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশে ক্ষতি হবে ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি। এর আগে বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে রফতানির ১৩টি খাতকে চিহ্নিত করেছে, যেগুলো করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতির মধ্যে পড়তে পারে। বলা হয়েছে এসব খাতে ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। খাতগুলোর মধ্যে আছে প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এছাড়া ওষুধ শিল্প, পাট সুতা, ইলেক্ট্রনিক্স, সামুদ্রিক মাছ, প্রসাধনী ইত্যাদি। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এসব খাতের পণ্য উৎপাদনের জন্য কমবেশি নির্ভর করেন চীন থেকে আনা কাঁচামাল কিংবা যন্ত্রাংশের ওপর। এর মধ্যে সবার আগেই আছে বাংলাদেশের রফতানির মূল খাত তৈরি পোশাক। কারণ ইতোমধ্যেই এই খাতের অনেক কারখানা কাঁচামালের সঙ্কটে পড়েছে কিংবা পড়তে যাচ্ছে। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ফলে এ খাত যদি সঙ্কটে পড়ে তাহলে দেশের পুরো রফতানি খাতই সঙ্কটে পড়বে বলে মনে করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রফতানি আয় এমনিতেই পড়তির দিকে। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কমেছে চার দশমিক সাত নয় ভাগ। অব্যাহতভাবে কমছে পোশাক রপ্তানি। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এই পণ্যটির প্রধান বাজার। করোনাভাইরাসের কারণে সেখানকার বাজারে এরইমধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতালিতে মানুষ ঘর থেকেই বের হতে পারছে না। যেখানে ১৪৩ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে বাংলাদেশ গত বছর। ধীরে ধীরে একই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে গোটা ইউরোপে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও। বাংলাদেশের পোশাক রফতানির ৬২ ভাগ আসে ইউরোপ থেকে আর ১৮ ভাগই যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকা শক্তি রফতানি ও রেমিট্যান্স। রফতানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়া বা কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। অন্যদিকে প্রবাসীরা টাকা পাঠানো কমিয়ে দিলে তাদের পরিবার দেশে আগের মতো খরচ করতে পারবেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা বাণিজ্যে। কমে যাবে বেচাকেনা। চাহিদা কমে গেলে ভোক্তা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে।
×