ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাহী আদেশে মুক্তিকে ভাবছেন অসম্মানজনক

বিএনপির কিছু নেতা খালেদার স্বজনদের প্রতি নাখোশ

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ২৯ মার্চ ২০২০

বিএনপির কিছু নেতা খালেদার স্বজনদের প্রতি নাখোশ

শরীফুল ইসলাম ॥ নিজেরা রাজপথে আন্দোলন করে বা আইনী লড়াইয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে না পেরে এখন তার স্বজনদের প্রতি নাখোশ হয়েছেন বিএনপির কিছু নেতা। তারা সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার মুক্তিকে অসম্মানের বলে মনে করছেন। এ ব্যাপারে নিজেদের ব্যর্থতার কথা আড়াল করতেই তারা এ কৌশল নিয়েছেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। এদিকে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিরামহীন চেষ্টার এক পর্যায়ে বিএনপি নেতারা পিছু হঠায় স্বজনদের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় তা এখনও অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে। মূলত স্বজনদের ইচ্ছেতেই খালেদা জিয়ার বাসায় এখন চিকিৎসক ব্যতীত কোন বিএনপি নেতার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কিছুদিন দৌড়ঝাঁপ করে বিএনপি নেতারা এক পর্যায়ে থেমে যান। কিন্তু খালেদা জিয়ার স্বজনরা হাল ছাড়েননি। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে যে কোন মূল্যে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। কিন্তু এ বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেননি দলের কিছু নেতা। তারা খালেদা জিয়ার মুক্তির আগে থেকেই স্বজনদের চিঠি চালাচালি ও দৌড়ঝাঁপ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করতে থাকেন। কিন্তু তাদের এ আচরণে খালেদা জিয়ার স্বজনরা নাখোশ হলেও প্রকাশ্যে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে ভেতরে ভেতরে তাকে মুক্ত করার চেষ্টা জোরদার করেন। তাদের বিরামহীন চেষ্টায় খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন এক সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপার্সন কারাবন্দী হওয়ার পর দুই বছর দেড় মাস সময়ের মধ্যে তার মুক্তির জন্য দলের নেতারা তেমন কিছুই করতে পারেননি। দলের ক’জন নেতা তার মুক্তির জন্য নিজস্ব সীমাবদ্ধতার মধ্যে চেষ্টা করলেও কিছু নেতা এ বিষয়ে ছিলেন নীরব। কিন্তু তারা মাঝেমধ্যে চটকদার বক্তব্য দিয়ে নেতাকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য নেতারা হাল ছেড়ে দেয়ার পর স্বজনরা যখন মরিয়া হয়ে চেষ্টা শুরু করেন তখন দলের কিছু নেতা নেতিবাচক মন্তব্য করতে থাকেন। তারপরও চেষ্টা জোরদার করে স্বজনরা যখন সরকারকে রাজি করিয়ে নির্বাহী আদেশে মুক্ত করতে সক্ষম হন তখন বিএনপির কিছু নেতা বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখছেন না। তারাই এখন বলছে সরকারের নির্বাহী আদেশে তাকে মুক্ত করা নাকি অসম্মানের। তাদের এ আচরণে স্বজনরা নাখোশ হলেও কিছু বলছেন না। উল্লেখ্য, খালেদা জিয়ার মুক্তির পর তার স্বজনরাসহ বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা স্বস্তি প্রকাশ করলেও দলটির কিছু নেতা এ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। তবে স্বজনরা মনে করছেন, নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই তারা সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তির বিষয়টিকে অসম্মানের বলছেন। খালেদা জিয়া নিজে এ দলটির চেয়ারপার্সন, তিনি নিজে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তির বিষয়টি মেনে নিলেও কিছু নেতা কেন এ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করছেন তার কারণ খুঁজতে স্বজনরা তৎপর রয়েছেন বলে জানা গেছে। যারা শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়ার মুক্তিকে অসম্মানের মনে করছেন তারা বলছেন, তার মুক্তির বিষয়টির ফয়সালা হওয়া উচিত ছিল রাজপথে। তা না করে কেন স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকারের নির্বাহী আদেশে ৬ মাসের জন্য তাকে মুক্ত করা হলো। এর দায় বিএনপির স্থায়ী কমিটিকেই নিতে হবে। এভাবে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার বিষয়টিকে তারা বিএনপির ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমরা রাজপথের আন্দোলনে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারিনি। তবে সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা ঠিক হয়নি। আমাদের বিবেকের কাঠগড়ায় আমরা অপরাধী। গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে দলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলন করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এভাবে তাকে মুক্ত করা ঠিক হয়েছে কি না তা সময়ই বলে দেবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জনকণ্ঠকে জানান, যেভাবেই হোক চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মুক্ত হয়ে গুলশানের বাসায় অবস্থান করছেন। তার সুচিকিৎসার প্রয়োজনে মুক্তির প্রয়োজন ছিল। এখন তিনি নিজের মতো করে চিকিৎসা নিতে পারছেন। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। ইতোমধ্যেই তার শারীরিক অবস্থার সামান্য হলেও উন্নতি হয়েছে। শনিবারও গুলশানের বাসায় ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করেন। হোম কোয়ারেন্টাইন শেষ হওয়ার পর অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও জোরদার করবেন। এ পরিস্থিতিতে দলের কোন কোন নেতা খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রক্রিয়া নিয়ে যে প্রশ্ন তুলছেন তা নিয়ে দলের ভেতরে কথাবার্তা হচ্ছে। তবে খালেদা জিয়া নিজে এভাবে মুক্তির বিষয়টি মেনে নিলেও দলের ওই নেতারা কেন প্রশ্ন তুলছেন তা তারাই বলতে পারবেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার ৫ বছরের সাজা হয়। ওইদিন থেকেই পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী জীবন শুরু করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। পরে হাইকোর্ট তার সেই সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদ-াদেশ দেন। একই বছর ২৯ অক্টোবর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার ৭ বছরের সাজা হয়। কারাগারে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলে প্রথমে একবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) নিয়ে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আবার কারাগারে নিয়ে সে অনুপাতে চিকিৎসা দেয়া হয়। কারাগারে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা দিন দিন আরও বেশি খারাপ হতে থাকলে বিএনপি ও স্বজনদের পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তির জোর দাবি জানানো হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ও একটি লিখিত আবেদন করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়। এর পর গত বছর ১ এপ্রিল থেকে খালেদা জিয়াকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের প্রিজন সেলের ৬২১ নম্বর কেবিনে রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়। সেখানের চিকিৎসায় খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় স্বজনদের পক্ষ থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়ার দাবি জানানো হয়। এক পর্যায়ে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য মুক্তি চেয়ে স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেন খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেন তার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার, বোন সেলিমা ইসলাম ও বোনের জামাই রফিকুল ইসলাম। তারা খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছেও একটি আবেদন করেন। এর পরই খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি ত্বরান্বিত হয়। স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ দুর্নীতির মামলায় দুই বছর দেড় মাস কারাভোগের পর শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। মানবিক বিবেচনায় সরকারের নির্বাহী আদেশে ৬ মাসের জন্য দ-াদেশ স্থগিত রেখে ভাই শামীম ইস্কান্দারের জিম্মায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তির ২ শর্তের মধ্যে রয়েছে এই ৬ মাস বাসায় অবস্থান করেই চিকিৎসা নিতে হবে এবং তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এবং বয়স ও মানবিক বিবেচনায় ৪০১ ধারায় শর্তসাপেক্ষে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
×