ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে এক বছরে ২২ হাজার মামলা নিষ্পত্তি

মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়লেও জট কমেনি

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ২৯ মার্চ ২০২০

মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়লেও জট কমেনি

বিকাশ দত্ত ॥ বাবা-মাকে হত্যার অভিযোগে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ঐশী রহমানের সাজা কমিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করেছে হাইকোর্ট। যাবজ্জীবন কারাদ-ের সঙ্গে ঐশীকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদ- দেয়া হয়েছে। হত্যায় সহযোগিতার জন্য ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমানকে বিচারিক আদালতের দেয়া দুই বছরের কারাদ-ের রায় হাইকোর্টেও বহাল রাখা হয়েছে। একই বেঞ্চ বহুল আলোচিত গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে রেদওয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাইম দীপের দেয়া মৃত্যুদ- এবং জঙ্গী নেতা মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানীসহ অন্য ছয় আসামির বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ-ের সাজাই বহাল রেখেছে হাইকোর্ট। নির্মম কায়দায় শিশু রাকিব হাওলাদারকে হত্যার ঘটনায় দুই আসামি ওমর শরিফ ও মিন্টু খানের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানার রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। শুধু ঐশী, ব্লগার রাজীব ও শিশু রাকিব হাওলারদদের মামলায় নয় উচ্চ আদালতসহ বিচারিক আদালতগুলোতে মামলা নিষ্পত্তির হার বেড়েছে। আগের তুলনায় মামলার নিষ্পত্তির হার বাড়লেও জট কমেনি। বিচারক সঙ্কট, সাক্ষীদের গরহাজির এবং কিছু আইনজীবীর ভূমিকার কারণে দিন দিন মামলার জট বেড়ে যাচ্ছে। প্রধান বিচারপতির উদ্যোগের পাশাপাশি হাইকোর্ট অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয় বিচারাধীন মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ উপরোক্ত রায়গুলো প্রদান করেছেন। শুধু এ কয়টি নয় বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ গত এক বছরে প্রায় ২২ হাজার মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। উচ্চ আদালতসহ সারাদেশে যেখানে ৩৭ লাখ মামলা বিচারাধীন সেখানে এই বেঞ্চের এত সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি বিচারাঙ্গনে আশার আলো সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে উচ্চ আদালতসহ সারাদেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৩৭ লাখ। এর মধ্যে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ১২ হাজার ৬৮৫টি আর নিম্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ৩১ লাখ ৭২ হাজার ৪৩টি। অর্থাৎ মোট মামলার সংখ্যা ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭২৮টি। ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুপ্রীমকোর্টের পরিসংখানে এই তথ্য জানা গেছে। সুপ্রীমকোর্টের স্পেশাল অফিসার ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান জনকণ্ঠকে এ তথ্য জানিয়েছেন। এত মামলার মধ্যে সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে কয়েকটি বেঞ্চ তাদের মামলা নিষ্পত্তির হার অনেকাংশে বেশি। এর মধ্যে রয়েছে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমসহ আরও কয়েকটি বেঞ্চ রয়েছে। এই পাহাড়সম মামলা জটের মধ্যে এই মামলা নিষ্পত্তি করাটা হাইকোর্টে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে আইনজীবীরা মনে করেন। আইনজীবীদের অভিমত এ ভাবে যদি অন্যান্য বেঞ্চও মামলা নিষ্পত্তি করে, তাহলে উচ্চ আদালতে মামলা জটের পরিমাণ অনেকাংশে কমে যাবে। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চে এক বছর মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ২১ হাজার ৮শ ৩৪টি। ঐ বেঞ্চে অন্যান্য বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি মোঃ রিয়াজ উদ্দিন খান, বিচারপতি মোঃ কামরুল হোসেন মোল্লা। ২০১৯ সালের জানুয়ারি ৫০৩, ফেব্রুয়ারি ১০০০, মার্চ ১৫৮১, এপ্রিল ২৮১৬, মে ১৯৮৫, জুন ১২৭৭, জুলাই ৩২৮৩, আগস্ট ১৭২৮ সেপ্টেম্বর ৩১০ নিষ্পত্তি মোশন খারিজ ১৭০, অক্টোবর নিষ্পত্তি ৩১৯ মোশন খারিজ ১৭৪, অক্টোবর ২০৪৫, মোশন ৩৩৭, নবেম্বর ২৬২৭, মোশন ৪৫৯, ডিসেম্বর ১০০৫ মোশন খারিজ ২১২। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি একান্ত প্রয়োজন। এতে তাড়াতাড়ি মামলা নিষ্পত্তি হবে। সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। মামলা ফাইল হলে এটা মীমাংসা করা যায়। পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে। ক্রিমিনাল মামলাও এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। এ ব্যবস্থা না হলে বিচার ব্যবস্থা ধস নামবে। জনগণ দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচার পাচ্ছে না। এডিআরের ফলে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে মামলা করার প্রবণতা দূর হবে। আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম জনকণ্ঠকে বলেন, আদালতগুলোতে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। আরও বাড়লে ভাল হয়। এ ছাড়া আপীল ফাইলের পাশাপাশি জামিনের দরখাস্ত দেয়া হয়। অর্থাৎ একটি মামলার ফিতরে তিনটি মামলা থাকে। এর ফলে মামলার সংখ্যা বেড়ে যায়। তিনটি না করে একটি মামলা করলেই মামলার সংখ্যা কমে যাবে। সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী স্বপন রায় জনকণ্ঠকে বলেছেন, বর্তমানে প্রায় ৩৭ লাখ মামলা রয়েছে। মামলা নিষ্পত্তিতে বড় কারণ সাক্ষী না আসা। পুলিশ ঠিকমতো সাক্ষীদের হাজির করতে পারে না। অন্যদিকে দেওয়ানী মামলা নিষ্পত্তিতে বড় কারণ আইনজীবী। অনেক আইনজীবী মামলাটিকে টিকে রাখে। ফলে মামলা নিষ্পত্তি হতে যুগের পর যুগ পার হয়ে যায়। এই মুহূর্তে মামলা জট কমাতে নিম্ন আদালতে আরও বিচারক নিয়োগ করা প্রয়োজন। উচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতে প্রায় ৩৭ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে ২৩ হাজার ৬১৭, হাইকোর্ট বিভাগে ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮টি এবং অধস্তন আদালতে ৩১ লাখ ৭২ হাজার ৪৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে আপীল বিভাগে প্রারম্ভিক সংখ্যা ২২ হাজার ৫৯৬ এর মধ্যে দায়ের হয়েছে ২ হাজার ১শ’ ৬৮টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ১শ’ ৪৭টি মামলা। হাইকোর্টে প্রারম্ভিক সংখ্যা ৪ লাখ ৯০ হাজার ৮শ’, দায়ের হয়েছে ২৫ হাজার ৬শ’ ৩৬টি মামলা। প্রাপ্ত ও পুনরুজীবিত হয়েছে ৩৩টি মামলা। নিষ্পত্তি হয়েছে ২৭ হাজার ৪শ’ ১টি মামলা। অধস্তন আদালতে প্রারম্ভিক মামলার সংখ্যা ৩১ লাখ ২৭ হাজার ২শ’ ৪৩টি মামলা। এর মধ্যে দায়ের হয়েছে ৩ লাখ ৮০ হাজার ১৬টি মামলা। পুনরুজ্জীবিত হয়েছে ৮৮ হাজার ৬শ’ ৫টি মামলা। আর নিষ্পত্তি হয়েছে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৫শ’ ৪৫টি মামলা। আপীল বিভাগে দেওয়ানী মামলার মধ্যে দেওয়ানী পিটিশন ৮ হাজার ২৬৩টি বিচারাধীন রয়েছে। এ ছাড়া দেওয়ানী রিভিউ পিটিশন ১ হাজার ৩২৪, দেওয়ানী বিবিধ পিটিশন ৩ হাজার ৪৭৮টি , দেওয়ানী আপীল ২ হাজার ৪৬৮টি এবং কনটেম্পট পিটিশন ১৮৬টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ফৌজদারি মামলার মধ্যে ফৌজদারি পিটিশন ৩ হাজার ৫ ৯৬, ফৌজদারি রিভিউ পিটিশন ১৬০, ফৌজদারি বিবিধ পিটিশন ৩ হাজার ৯৩টি, ফৌজদারি আপীল ৮৪৩, জেল পিটিশন ১৬৩ এবং জেল আপীল ৪৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগে দেওয়ানী মামলা ৯৭ হাজার ৬১৬, ফৌজদারি ২ লাখ ৯২ হাজার ৪২৯টি, রিট ৮৭ হাজার ৮৫৩, এবং আদিম দেওয়ানী ১১ হাজার ১৭০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
×