ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ছয় বছরেও জট খোলেনি মাওলানা ফারুকী হত্যারহস্য

প্রকাশিত: ১০:২৭, ২৯ মার্চ ২০২০

ছয় বছরেও জট খোলেনি মাওলানা ফারুকী হত্যারহস্য

শংকর কুমার দে ॥ সুপ্রীমকোর্টের জামে মসজিদের খতিব ও একাধিক বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকা-ের রহস্যের জট ছয় বছরেও খোলেনি। তদন্ত ক্রমেই ডিপ ফ্রিজের ভেতরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ হত্যাকা-ের পেছনে উগ্র-কট্টরপন্থী জঙ্গী গ্রুপের দিকেই সন্দেহের তীর। জামায়াত ও ছাত্র শিবির এ হত্যাকা-ের পেছনে মদদ দিয়েছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হত্যাকা-ের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়ায় বারবার আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় নিচ্ছে তদন্ত সংস্থা সিআইডি। তদন্ত সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করার জন্য নির্ধারিত তারিখ ছিল গত ১৫ মার্চ। তদন্ত সংস্থা সিআইডি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারায় আবারও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য ঢাকা মহানগর হাকিম শাহিনুর রহমান নতুন এ দিন ধার্য করেছেন ২৩ এপ্রিল। ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের ১৭৪ নম্বরের ভাড়া বাসায় খুন হন টেলিভিশনে ইসলামী অনুষ্ঠান উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী। ওইদিন এশার নামাজের পর আনুমানিক ৬ থেকে ৭ যুবক ফারুকীর বাসায় প্রবেশ করে এবং কিছু সময় পর তার স্ত্রী ও এক ছেলেসহ তিন স্বজনের হাত-পা বেঁধে পৃথক কক্ষে আটকে রেখে ফারুকীকে গলা কেটে হত্যার পর দুষ্কৃতকারীরা পালিয়ে যায়। ওই ঘটনায় তার ছেলে ফয়সাল ফারুকী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ৮-১০ জনকে আসামি করে শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক শাইখ মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যাকা-কে পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকা- হিসেবে উল্লেখ করেছেন তদন্ত সংস্থা। মাওলানা ফারুকীর হত্যাকা-ের সঙ্গে আরও চারটির মিল রয়েছে। ফারুকী হত্যাকা-সহ পাঁচটি হত্যাকা-ের প্রেক্ষাপট এক ও অভিন্ন। এর আগে যে চারটি হত্যাকা- ঘটেছিল, সেগুলোর পুনরাবৃত্তিই ঘটেছে মাওলানা ফারুকীর বেলাতেও। তাদের ধারণা, ইসলামের নামে উগ্র ও কট্টরপন্থী জঙ্গী গ্রুপের হাতেই তার মৃত্যু ঘটেছে। ফারুকী হত্যাকা-ের ঘটনায় মামলার তদন্তে এজাহারে যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের ১৭৪ নম্বরের বাসায় সন্ধ্যার পর বাসায় দুইজন অতিথি আসেন। তারা তার (ফয়সাল) বাবার সঙ্গে হজে যাওয়ার বিষয়ে কথা বলেন। এ সময় তার বাবা ড্রয়িং রুমে বসা ছিলেন। পরনে ছিল লুঙ্গি আর সাদাকালো স্ট্রাইপের পাঞ্জাবি। মাথায় ছিল পাগড়ি। এরপর ওই দুইজন জানান, তাদের আরও কয়েকজন বড় ভাই আছেন, যারা হজে যেতে চান। ফয়সাল বলেন, এর কিছুক্ষণ পর তারা দরজায় নক করে। আব্বা দরজা খোলার পর ৭-৮ জন লোক পিস্তল এবং রামদা, চাপাতি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। ওই সময় পরিবারের ৫ জন সদস্য বাসায় ছিল। প্রথমে সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এবং পরে সবার হাত-পা ও চোখ বেঁধে ফেলে। ওই ড্রয়িং রুম থেকে তার বাবাকে পাগড়ি দিয়ে গলা বেঁধে টেনে হিঁচড়ে ডাইনিং রুমে এনে টেবিলের নিচে গলা কেটে হত্যা করে তারা পালিয়ে যায়। তার রক্তের প্রবাহে গোটা রুম ভেসে যায়। ডাইনিং রুমের ফ্রিজ ও মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখা যায়। এ ঘটনার দুদিন আগেও ওই দুইজন বাসায় এসে কথা বলে গেছেন বলে জানান তিনি। মামলার বাদী ফারুকীর ছেলে ফয়সাল ফারুকী বলেছেন, আমার আব্বা ধর্মের কথা বলতেন, সত্যের কথা বলতেন। আব্বার কথা যারা অপছন্দ করতেন তারাই এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে। তার দাবি, ধর্মীয় কারণেই তার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকা-টি পরিকল্পিত। সত্যের কথা বলার কারণে আব্বাকে বিভিন্ন সময় মোবাইল ফোনে হুমকিও দেয়া হয়েছে। হত্যার পর খুনীরা বাড়িতে লুটপাট চালিয়েছে। বাসার আসবাবপত্র তছনছ করেছে। এ সময় বাসার সবার কাছে জানতে চাওয়া হয়, অর্থকড়ি, স্বর্ণালঙ্কার কোথায় আছে। এসব খোঁজার জন্য সবকিছু এলোমেলো করা হয়। তদন্ত সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, খুনীরা ঘটনাটি ডাকাতি হিসেবে সাজানোর অপচেষ্টা চালিয়েছিল হত্যাকারীরা। সে লক্ষ্যে তারা হত্যাকা- সম্পন্ন করার পর ডাকাতির নাটক করেছে। ঘরের আসবাবপত্র এলোমেলো করেছে। হত্যাকা-ের আগে ঢাকার কাওরানবাজার ট্রেড সেন্টারে ইসলামী অনুষ্ঠান উপস্থাপকদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশের সব টিভি চ্যানেলের ধর্মভিত্তিক অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও আলোচকরা উপস্থিত হন, যার সংখ্যা ছিল ২২। আলোচনা চলাকালে একজন প্রস্তাব করেন, যারা ইসলামী অনুষ্ঠান করেন তাদের নিয়ে একটি সংগঠন করার জন্য। ওই বক্তা বলেন, মুফতি ইব্রাহীম ও ফারুকী সাহেব অনুষ্ঠানে একে অপরের বিরুদ্ধে যেভাবে কথা বলেন, সংগঠন করা হলে আমরা হয়তো তাদের একটি প্ল্যাটফর্মে আনতে পারব। তখন উপস্থিত আরেক জন বলেন, ফারুকীর পক্ষে দালালি করবি না। এখানে ফারুকীর শেরেকি-বেদাতি চলবে না। তাকে প্রতিহত করার জন্য আমরা সবাই একত্রিত থাকলে তাকে (ফারুকী) মেরে ফেলা যাবে। এগুলোকে বাদ দিয়ে কীভাবে কমিটি করা যায়, তা করো। এ সময় ওই বক্তার বক্তব্যকে সমর্থন করেন উপস্থিত আরও কয়েকজন। পরবর্তীতে ফারুকীকে বাদ দিয়ে কামাল উদ্দিন জাফরীকে প্রধান উপদেষ্টা, আরাকান উল্লাহ হারুনী এবং খালেদ সাইফুল্লাহ বকশিকে সদস্য সচিব করে ৩৪ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ফারুকী সাহেবকে কার্যনির্বাহী কমিটিতে রাখার প্রস্তাব উঠলেও রাখা হয়নি। ফারুকী হত্যাকা-ের পেছনে এসব ঘটনা মদত পেয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বেসরকারী স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের উপস্থাপক শাইখ নুরুল ইসলাম ফারুকী ১৯৫৯ সালের ২৪ নবেম্বর পঞ্চগড় জেলার বড়শ্বশী ইউনিয়নের নাউতারী নবাবগঞ্জ গ্রামে আলহাজ মাওলানা জামশেদ আলীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাওলানা ফারুকী সংসার জীবনে দুই বিয়ে করেন। তার দুই সংসারে ২ মেয়ে ও ৪ ছেলে রয়েছে। মাসুদ এবং দুই মেয়ে আগের সংসারের। তার প্রথম স্ত্রী রাজধানীর মালিবাগ এলাকায় থাকেন বলে জানা গেছে। ঘটনার সময় তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে রাজবাজারের বাসায় ছিলেন। তিনি কয়েকটি বই লিখেছেন বলে তার পরিবার থেকে জানানো হয়। তার বইগুলো সুফিজমভিত্তিক। সবশেষে ‘মারেফুল হারামাইন’ নামের বইটি লিখেছেন। বইগুলোতে তিনি ইসলামের আদি বা অবিকৃত রূপ মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন বলে তার ভক্তরা জানান। তদন্ত সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, হত্যাকা-ের ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করার পর হত্যা রহস্য উদঘাটনে তিন ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের’ থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। পুলিশ সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে হত্যা রহস্য উদঘাটনে কাজ শুরু করেছে বলে তদন্ত সংস্থার দাবি। সিআইডি তদন্তে নামার আগে পুলিশ, ডিবি ও গোয়েন্দা সংস্থা ও তদন্ত করেছে। ফারুকী হত্যার ঘটনায় ধর্মীয় মতবাদের ভিন্নতাকেই মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করে তদন্তের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এই হত্যাকা-কে আগের আরও চারটি হত্যাকা-ের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও। ফারুকী হত্যাকা-ে সঙ্গে উত্তরায় ফল ব্যবসায়ীর হত্যাকা- যেটা জঙ্গীরা ঘটিয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। জঙ্গীরা ঘটিয়েছে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে হত্যাকা-ের ধরন ও নমুনা, রাজধানীর গোপীবাগে ছয় খুন ও ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন হত্যাকা- একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এসব হত্যাকা-ের ধরন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রায় একই রকম হওয়ায় হত্যার কারণও প্রায় একই বলে মনে করছেন উর্ধতন কর্মকর্তারা। রাজধানীর উত্তরায় এক ব্যক্তি জঙ্গী সংগঠন থেকে চলে এসে ভাল হওয়ার চেষ্টা করেন এবং ফলের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু জঙ্গী সংগঠনের অন্য সদস্যরা তাকে হত্যা করে। একই ঘটনা ঘটে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতেও। সেখানেও পুরনো জঙ্গী সদস্যকে একই কায়দায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মিরপুরের কালশীতে ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন ধর্মীয় মতবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় তাকে হত্যা করে জঙ্গীরা। ঠিক একই ধরনের হত্যাকা- হয় রাজধানীর গোপীবাগে। ভিন্ন ধর্মীয় মতবাদ প্রকাশ করে নিজেকে ‘ইমাম গাজ্জালী’র প্রতিনিধি দাবি করায় এই ছয় খুনের ঘটনা ঘটানো হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চ্যানেল আইয়ের ইসলামিক অনুষ্ঠান ‘কাফেলা’ ও ‘শান্তির পথ’র উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকা-ের ছয় বছর পরও জড়িতদের চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশের একাধিক তদন্ত সংস্থা। তদন্তের অগ্রগতি হিসেবে তিন বছরে শুধু একটা ধারণা কথা বলছে মামলাটির তৃতীয় তদন্ত সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। তাদের ধারণা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকা-ে জড়িত জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের-জেএমবি সিøপার শেল। ছয় বছরের তদন্তে নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকা-ের খুনীরা গ্রেফতার না হওয়ায় হত্যারহস্য ক্রমেই জট পাকাচ্ছে। তদন্ত ক্রমেই চলে যাচ্ছে ডিপ ফ্রিজে।
×