ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনার সামনে নিষ্প্রভ অসহায় বিশ্ব

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ২৯ মার্চ ২০২০

করোনার সামনে নিষ্প্রভ অসহায় বিশ্ব

করোনার উৎপত্তিস্থল চীনে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন কমে এলেও বেড়ে চলেছে বিশ্বের সর্বত্র। করোনার কারণে অচল হয়ে পড়েছে সব কিছু। বিশ্বের বড় বড় চিকিৎসা বিজ্ঞান ও চিকিৎসককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এ ভাইরাস যেন দিনকে দিন আরও জোরালো হয়ে উঠছে। করোনার কারণে যে চীন ২ মাসেরও বেশি সময় ধরে অনেকটা একঘরে হয়েছিল সেই দেশটির ওপরই এখন নির্ভর করতে হচ্ছে অনেক দেশকে। চিকিৎসা সরঞ্জাম, মাস্ক এবং অভিজ্ঞ মেডিক্যাল টিম দিয়ে করোনা আক্রান্ত অনেক দেশকে সহযোগিতা করছে চীন। তারপরও বেড়েই চলেছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। প্রতিদিনই নতুন নতুন দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর কথা জানা যাচ্ছে। এই ভাইরাসের আক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়া, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও আফ্রিকার দেশগুলোতে। করোনার বিস্তার রোধে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন বলেছেন, রবিবার মধ্যরাত থেকে তার দেশে আসা প্রায় প্রত্যেককে অবশ্যই সেলফ-আইসোলেট হতে হবে। গত শনিবার এক সাংবাদিক ব্রিফিংয়ে এ ঘোষণা দেন তিনি। বলেন, করোনা প্রতিরোধে তার সরকারের নেয়া এ নতুন পদক্ষেপ নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীদের জন্যও প্রযোজ্য হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ছাড় পাবেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা। কারণ, সেখানে এখন পর্যন্ত এ ভাইরাস হানা দেয়নি। অন্যদিকে আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল অংশজুড়ে করোনা ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। আল-আরাবিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে যেন অনেকটা বেঁচেই যাচ্ছিল দুঃখ-দুর্দশায় বিপন্ন আফ্রিকা। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়লেও এ মহাদেশটিকে অনেকটা ছাড় দিয়ে চলছিল করোনা। কিন্তু এবারে ওই অঞ্চলের দিকেও থাবা বাড়াতে শুরু করেছে এ ভাইরাস। এরই মাঝে আফ্রিকার ১৯টি দেশ এতে আক্রান্ত হয়েছে। গত কয়েক দিনে কেনিয়া, ইথিওপিয়া, সুদান, মৌরিতানিয়া ও গিনি নিজেদের দেশে করোনা আক্রান্তের ব্যাপারে নিশ্চিত করেছে। এর আগে মরক্কো, তিউনিসিয়া, মিসর, আলজেরিয়া, সেনেগাল, টোগো, ক্যামেরুন, বুরকিনা ফাসো, কঙ্গো, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, আইভরি কোস্ট, ঘানা, গেবনেও করোনা প্রবেশ করে। যদিও বেশিরভাগ দেশেই এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দশের নিচে এবং আক্রান্তরা বেশিরভাগই বিদেশী অথবা বাইরে ভ্রমণকারী। করোনা ছড়িয়ে পড়া রোধের চেষ্টায় আক্রান্ত ও সন্দেহভাজনদের এখন পর্যন্ত দ্রুত পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হলেও, এর প্রকোপ বেড়ে গেলে আফ্রিকার মতো বিপন্ন একটি মহাদেশ তা কীভাবে মোকাবিলা করবে এ নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ও ইয়েমেন ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের ১৩টি দেশে করোনা প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে আছে সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, লেবানন, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্দান। এসব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ইরান। এরপরই আছে বাহরাইন ও কুয়েত। এছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্রের তীর্থভূমি ব্রিটেনের রাজতন্ত্রকে সেদেশের জনগণ আশীর্বাদের বটবৃক্ষ মনে করে। সেই ব্রিটেনের রানীও শত বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। কানাডার জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মানবতাবাদী জাস্টিন ট্রুুডো কোয়ারেন্টাইন থেকে তার জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। চীনের পর করোনার ভয়াবহতা দেখা দিয়েছে ইতালিতে। সেখানে লাশের মিছিলের সামনে নিস্তব্ধ মানুষ, নিস্তব্ধ রাষ্ট্র অসহায়। ইসলামী রাষ্ট্র ইরানের অবস্থাও করুণ। প্রকৃতির এই অভিশাপ থেকে কে ধনী রাষ্ট্র কে গরিব রাষ্ট্র কিংবা কোনটা ইসলামিক রাষ্ট্র অথবা কোন দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ খ্রীস্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ, হিন্দু নাকি মুসলমান সেটি দেখছে না। মরণ আঘাত ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানব জাতির ওপর আঘাত হেনেছে। মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষার এই লড়াইয়ে মুসলমানদের পবিত্র স্থান আল্লাহর ঘর কাবাঘর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সব মসজিদে নামাজ বন্ধ হয়ে গেছে। দেশে দেশে সব গির্জা, মন্দির বা ধর্মশালায় সমাগম বা প্রার্থনা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তাবৎ শিক্ষাঙ্গন বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। চীনের ভয়াবহতা দেখে ইতালি যেমন উদাসীনতা দেখিয়ে এখন একের পর এক লাশের সংখ্যা গুনছে আর শোকার্ত হৃদয়ে ক্রন্দন করছে সেখানে ইরানের ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যেও শোকের মাতম চলছে। প্রকৃতির এই আঘাত রুখে দাঁড়ানোর লড়াই গোটা পৃথিবী কার্যত সংঘবদ্ধভাবে করছে। করোনার ভয়াবহতায় মুখ থুবড়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। কার্যত অচল পৃথিবী থেমে গিয়ে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে এখন মুখোমুখি। মানবতার লড়াইয়ে মানুষের জীবন রক্ষায় গোটা বিশ্ব এখন এক মোহনায় মিলিত। বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা লড়ছেন জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যারা একসময় যুদ্ধের হুঙ্কার দিতেন, চাইলেই যে কোন দেশ আক্রমণ করে দখল নিতে পারতেন তারাও এখন করোনাভাইরাসের সামনে নিষ্প্রভ, অসহায়। চীনের উহান থেকে করোনাভাইরাস ভয়ঙ্কর মূর্তি নিয়ে বিশ্বের ১৭৭টি দেশকে আক্রান্ত করেছে। পরাক্রমশালী রাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়া এই ভয়াবহ ভাইরাসের চিকিৎসা আবিষ্কার না হওয়ায় কেবল সচেতনতা, আইসোলেশন আর কোয়ারেন্টাইনেই আটকে আছে। নীরব, নিথর হয়ে গেছে একেকটি রাষ্ট্রের রাজপথগুলো। জরুরী অবস্থা, লকডাউন একের পর এক ঘোষিত হচ্ছে। নীরব, নিথর হয়ে গেছে পৃথিবীর দিবারাত্রি সরগরম থাকা একেকটি শহর, নগর ও পর্যটনস্থল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, শপিং মল বন্ধ ঘোষণা করে দেশে দেশে খাবার আর ওষুধের দোকান ছাড়া কেবল হাসপাতালের ফটক খোলা রেখেছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে। প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। দেশে দেশে জরুরী অবস্থা জারির পাশাপাশি মসজিদে নামাজ আদায়েও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের কারণে এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কানাডার তিন প্রদেশে জারি করা হয়েছে জরুরী অবস্থা। সৌদি আরবে মক্কার মসজিদুল হারাম ও মদিনার মসজিদুল নববী ছাড়া সব মসজিদে নামাজ বাতিল করা হয়েছে। সৌদি আরবে প্রাইভেট সেক্টরে ১৫ দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ভি মুরালিধরন স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। কানাডার তিন প্রদেশে জরুরী অবস্থা। কভিড-১৯ দ্রুত গতিতে বৃদ্ধির ফলে কানাডার আলবার্টা, ব্রিটিশ কলম্বিয়া এবং অন্টারিও প্রদেশকে পাবলিক হেলথ জরুরী অবস্থার ঘোষণা করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৬টি দেশের পাশাপাশি আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্যে এ ব্যবস্থা কার্যকর হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিক, ইউ-নাগরিকদের পরিবারের সদস্য, দীর্ঘ মেয়াদি বাসিন্দা, কূটনীতিক, স্বাস্থ্যকর্মী, পণ্য পরিবহনকারী মানুষ ছাড়া সবার ইউরোপে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। করোনাভাইরাস ঠেকাতে অনেক দেশ সীমান্ত আংশিক ও পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। মক্কা-মদিনার দুটি বাদে সৌদির সব মসজিদে নামাজ বাতিল করা হয়েছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সৌদি আরবের মক্কার মসজিদুল হারাম ও মদিনার মসজিদুল নববী ছাড়া দেশের বাকি সব মসজিদে নামাজ আদায় সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে সৌদি আরব। সৌদি আরবে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে, জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এবং ইসলামী আইনি দৃষ্টিকোণ বিশ্লেষণ করে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় সংগঠন দ্য কাউন্সিল অব স্কলার্স এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মসজিদ পুরোপুরি বন্ধ করা হয়নি। সেখানে শুধু জামায়াতে নামাজ পড়া সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। নিয়মিত আজান হবে এবং সবাইকে বাসায় নামাজ পড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেভাবে লকডাউন করা হচ্ছে ও মানুষের দৈনন্দিন চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে তা দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ এতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব হবে মারাত্মক। তবে এভাবে বিধিনিষেধ আরোপ না করলে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগবিষয়ক অধ্যাপক মার্ক উলহাউজ বলছেন, করোনার প্রতিষেধক টিকা আসতে সময় লেগে যাবে বারো থেকে আঠারো মাস। আর এই টিকা গ্রহণ করলে করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে এলেও মানুষ অসুস্থ হবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন। অধ্যাপক মার্ক আরও বলেছেন, করোনা সারাবিশ্বে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। করোনার জন্য পুরো পৃথিবীতে এখন অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আর কবে নাগাদ এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে তাও বলা সম্ভব হচ্ছে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে-করোনার উদ্বেগজনক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কতদিন সময় লাগতে পারে। বিভিন্ন দেশের চিকিৎসক বলছেন, করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আগামী তিন মাসে কমে যেতে পারে। তবে সংক্রমণ পুরোপুরি শেষ হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। আমেরিকা, চীনের মতো বিশ্বের শক্তিশালী ও উন্নত দেশের বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে করোনার টিকা নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেছেন। কোভিড-১৯ এর ওষুধ আবিষ্কার এখন বিজ্ঞানীদের কাছে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। পরিশেষে বলব, করোনাভাইরাসে আতঙ্কিত হয়ে পড়লে একাধিক তথ্য বা গুজবের ভিড়ে আসল প্রয়োজনীয় তথ্য বা সতর্কবার্তা অনেক সময়েই চাপা পড়ে যায়। আতঙ্ক নয়। সচেতনতা। নিজেকে এবং আশপাশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে যেন আতঙ্ক না ছড়িয়ে পড়ে, গুজব না ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের জনবহুল সমাজে এমনটা হলে, তা হিতে বিপরীত হতে পারে। একই সঙ্গে বলবো, কোনও রকম সুযোগই দেওয়া উচিত নয় এই রোগকে। সাবধানতা অবলম্বনে যেন কোনও ভুল না হয়। সর্বোচ্চ সতর্কতা পালন করতেই হবে। ইতিমধ্যেই বিশ্বজোড়া মহামারীর আকার নিয়েছে এই ভাইরাসের সংক্রমণ। এতটুকু গা-এলানোর কোন সুযোগ নেই। আতঙ্ক সরিয়ে রেখে, সচেতনতা ও সতর্কতা পালন করতে হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ, লন্ডন প্রবাসী [email protected]
×