ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

করোনা সঙ্কট ॥ এভাবে আমরা কতদূর যাব?

প্রকাশিত: ০৮:৩৪, ২৯ মার্চ ২০২০

করোনা সঙ্কট ॥ এভাবে আমরা কতদূর যাব?

স্বাধীনতার পরে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এতবড় ঝুঁকিতে প্রথম একবারই পড়েছিল ১৯৯০ সালে এরশাদ সাহেব যখন একটি স্বাস্থ্যনীতি প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এবারের ঝুঁকি ভিন্ন, যদিও সংক্রামক রোগের পরিস্থিতি, কিন্তু সামান্য অব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের সকল অর্জনের ভিত কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম। আমাদের আশঙ্কা সেখানেই, এই ভিনদেশী আপদের কারণে আমরা কি কোন বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছি? আশার কথা আমাদের নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক সমাজ ও স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কর্মীগণ এই আশঙ্কায় না যেতে আমাদের এখনও আশা এবং ভরসা দিচ্ছেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এখন পর্যন্ত যতগুলো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে তাতে নাগরিক হিসেবে আমাদের উদ্বেগ কমছে না বরং বাড়ছে। যদিও যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে যে কোন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীর নিবেদিতপ্রাণের পরিচয় আমরা পাচ্ছি কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কোথাও ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার ঘাটতি আছে এটাও স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে কমিউনিটি পর্যায়ে সংক্রমণ নিয়ে সমগ্র জাতির যে উদ্বেগ তা নিরসনে যেসব ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে সবই ভয়ের, কান ধরে উঠবস থেকে স্থানীয় পুলিশের বাড়াবাড়ি কোনটাই সাধারণ মানুষ কামনা করে না। এদেশের শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ শেখ হাসিনাকে ভালবাসে ও সম্মান করে। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ ঘরে না থেকে নিজের ও পরিবারের এমনকি দেশের স্বার্থ দেখবে না, পাড়ায় পাড়ায় রোগ ছড়িয়ে দেবে এমন বাহুল্য প্রচারণার কোন অর্থ থাকতে পারে না। ভুল হয়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার। ইতালি ও ইউরোপের নানা দেশ থেকে মানুষগুলো যখন দেশে ফিরতে প্লেনে উঠল এটা নিশ্চয়ই হঠাৎ করে হয়নি। অন্তত কাজ থেকে ছুটি নিয়ে, টিকেট কেটে, গোছগাছ করে রওনা হতে যে ক’দিন লেগেছে সেটা আমাদের দূতাবাস থেকে শুরু করে এভিয়েশন কর্তারা টের পেলেন না, এটা কেউ বিশ্বাস করে? অথচ ততদিনে আমরা চীন ও পূর্ব এশিয়ার অভিজ্ঞতা জেনে গেছি, কিন্তু কী শিখলাম দেশের কেউ জানতেই পারল না। আশকোনা হাজী ক্যাম্পের হৈচৈ টেলিভিশনে না দেখলে এর গুরুত্বটুকুও আমরা বুঝতাম না। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যাপক একটা হুঁশিয়ারি দিতে পারত এই মর্মে যে, এর ফলে দেশের কত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। দেখতেন ঢাকার অর্ধেক মানুষ ব্যারিকেড দিয়ে ওই মানুষগুলোকে কোয়ারেন্টাইনে ঢুকিয়ে দিত। আর এই তথ্য জেনে আমার বিশ্বাস অর্ধেক মানুষ দেশে আসার টিকেট ফেরত দিত কারণ দেশে গেলেই ছুটির অর্ধেক কেটে যাবে ওই কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে, তার চেয়ে না যাওয়াই ভাল, এই ভেবে। কিন্তু সেসব উদ্যোগ না নিয়ে আমরা কী করলাম? অযাচিতভাবে আমাদের বিদেশমন্ত্রী প্রবাসীদের ‘নবাবজাদা’ বলে কটাক্ষ করে এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রাথমিক উদ্যোগে দেশের মানুষের ও মিডিয়ার সমর্থন হারালেন! অপরদিকে আশকোনা ক্যাম্পে প্রবাস থেকে আসা ভ্রমণক্লান্ত নারী-শিশু-বৃদ্ধ-যুবা যে-ই হোক তাদের চৌদ্দটা দিন স্বস্তিতে রাখার জন্য একটা মশারির ব্যবস্থাও আমরা করতে পারলাম না। ফলে সে আয়োজন ব্যর্থ হলো। এর দায় তো কাউকে না কাউকে নিতেই হবে। উহান থেকে ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে আসা নাগরিকদের দিয়ে শুরু“করে মার্চের ১৫ পর্যন্ত দেশে যত প্রবাসী এসেছেন তাদের সবাই ভাইরাস বহনের ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন বলেই আশকোনায় সরকারী ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টাইনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এটা ব্যর্থ হবার শেষক্ষণে এসে ১৪ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক জানান, ওখানে থাকা ইতালি প্রবাসী ১৪২ জনকে নিজ নিজ বাড়িতে ১৪ দিনের জন্য ‘বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে’ থাকতে হবে অর্থাৎ তাঁদের বাড়ি চলে যেতে বলা হয়েছে। আর একই সময়ে আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বিবিসিকে বলেন, ‘যারা এসেছেন তাদের বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টাইন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আশকোনা হজ ক্যাম্পে তাদের রাখা হবে না যদিনা কারও বাড়িতে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার মতো অবস্থা না থাকে।’ তার মানে কি এই নয় যে এ রকম সিদ্ধান্ত দিয়ে আমরাই কমিউনিটি সংক্রমণের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছি? শেষমেশ ২৪ মার্চ ছাপা প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে দেয়া পুলিশের হিসাব থেকে একটা প্রকৃত চিত্র পাওয়া গেল। পুলিশের সে হিসাবে মার্চের প্রথম ২০ দিনে বিদেশ থেকে ফিরেছেন ২ লাখ ৯৩ হাজার মানুষ। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক এসেছেন কোভিড-১৯ আক্রান্ত দেশগুলো থেকে। বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই তাঁরা যাঁর যাঁর বাড়িতে চলে গেছেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১৮ হাজার বিদেশফেরত স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টাইনে আছেন। অন্যদের কোন হদিস নেই! গত সপ্তাহ পর্যন্ত এসব প্রবাসী স্বাভাবিকভাবেই গ্রামে-গঞ্জে, হাট-বাজারে ঘুরেছেন, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এই বিদেশ ফেরতদের মধ্যে কেউ সংক্রমিত হয়ে থাকলে তা কত মানুষের মধ্যে ছড়াবে, সে বিষয়ে কোন ধারণাই করা যাচ্ছে না কারণ ‘সংক্রমণ প্রজেকশন’ হিসাব যাদের করার কথা তাঁরা আদৌ তা করেছেন কী না আমরা জানি না। মাঠ থেকে পাঠানো প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পুলিশের কর্মকর্তারা এক ‘ভয়ঙ্কর পরিণতি’র আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এই অবস্থার বিপরীতে দেশে কোন প্রস্তুতি খুবই সামান্য। চিকিৎসক-নার্সদের এখন পর্যন্ত ঠিকভাবে সুরক্ষা সরঞ্জাম বা পিপিই সরবরাহ করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। জ্বর-কাশি-গলাব্যথার রোগী হাসপাতালে এলেই দূরত্ব বজায় রাখছেন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন চিকিৎসকরা। পুলিশ সদর দফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, জানুয়ারি থেকে সাড়ে ছয় লাখ মানুষ দেশে এসেছেন। দেশে আসার সময় সঠিক ঠিকানা না দেয়া এবং পাসপোর্টের ঠিকানায় অবস্থান না করার কারণে ফিরে আসা এসব লোককে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। অন্যদিকে আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওয়েবসাইটে তথ্য তালাশ করে দেখলাম সারাদেশে সরকারী প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা সুবিধা আছে মোট ৫১৬টি। এর মধ্যে বিশেষায়িত স্নাতোকোত্তর শিক্ষা ও হাসপাতাল সুবিধা আছে ২২টি ও স্বায়ত্তশাসিত ৭টি, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ৩৬টি, জেনারেল হাসপাতাল ৭টি, ২০০ থেকে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা হাসপাতাল ২৩টি ও জেলা সদরের হাসপাতালের সংখ্যা ৩১। বাকি থাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যার সংখ্যা ৪২৫। সব মিলিয়ে সরকারী হাসপাতালগুলোর শয্যা সংখ্যা আছে ৫২ হাজার ৮০৭টি। প্রবাসীদের বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলের বা বড়জোর জেলা শহরের। পুলিশ হিসাবে সাড়ে ছয় লাখ লোক যদি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে নিজ দেশে এসে থাকেন তাহলে গড়ে প্রতি জেলায় ১০ হাজারের মতো লোক এসে অবস্থান করছেন। আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ এখনও মহামারী বিদ্যার জৈব-পরিসংখ্যানের আনুপাতিক হিসাব অনুসরণ করে কোন মডেলিং করে দেশের সম্ভাব্য করোনা রোগে আক্রান্তের ‘প্রজেকশন’ বা ‘অভিক্ষেপ’ জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি। ফলে আমরা জানি না আমি আমার কমিউনিটিতে কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছি। এর থেকে বাঁচার উপায় যদি ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ বা ‘সঙ্গনিরোধ’ কর্মসূচীও হয় তাহলেও, যে ক’টি সেবা সুবিধা আছে সেগুলো যথার্থ ও নিশ্চয়তা বিধান করে এমন সুবিধা আছে বলে কেউ নিশ্চিত করছে না। খোদ ঢাকা শহরেরই উত্তরায় আলাদা করে রাখা একটি হাসপাতালের সেবাচিত্র গত বুধবার একাত্তর টিভিতে উপস্থাপন করা হয়েছে যেখানে করোনা চিকিৎসা সেবার বিন্দুমাত্র স্বস্তিকর তথ্য নেই। সারাদেশের উপায় তাহলে কি? কেউ যদি তাঁর উপসর্গ নিয়ে বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার রাজনগর গ্রাম থেকে আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করেন তিনি যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাবেন তার বিস্তৃত এখানে উল্লেখের প্রয়োজন নেই। শুধু এই উদ্বেগ জানাতে চাই- টেলিফোনে সব উপসর্গ মিলে গেলে তাঁর রক্তের নমুনা কে নেবে? রাজনগর থেকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজে যেখানে আজকালের মধ্যে রক্ত পরীক্ষার পিসিআর বসার কথা সেখানে যেতে দুই ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। পথে পথে ভাইরাস ছিটিয়ে তিনি খুলনা যাবেন না কি রক্তের নমুনা সংগ্রহের জন্য কেউ তাঁর বাড়ি যাবেন? সে ব্যবস্থা কি করা হয়েছে? ব্যাপকভাবে সেটা জানানো দরকার। খুলনায় পিসিআর বসার পরে যখন রক্ত পরীক্ষায় রোগের কথা জানা যাবে ততক্ষণে যদি তাঁর শ্বাসযন্ত্র আক্রান্ত হয় ও আইসিইউ সেবার দরকার হয়ে পড়ে খুলনার নিবেদিত ডাক্তার ও স্বাস্থ্যসেবকদের হাতে তখন কী উপায়? তাঁদের পিপিই, মানসিক নিরাপত্তা আছে? আলাদা করে আইসিইউ ব্যবস্থা করা হয়েছে? যদি এই ভয়াবহ সংক্রমণ আশঙ্কা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় আরও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় বিবেচনায় না নেয়া হয় তাহলে নিরাময় তো দূরের কথা, বাংলাদেশের মানুষের উদ্বেগ কোনভাবেই নিরসন করা যাবে না। জনপ্রিয় রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছার সুযোগের অপব্যবহার করা এক শ্রেণীর সবজান্তা ও উন্নাসিক ব্যবস্থাপকদের অপসারণ জরুরী। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মূল কথাই হলোÑ ‘বিনয়’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলেছেন বিনয়ের সঙ্গে। অথচ আমাদের কর্তাব্যক্তিরা খুশিমতো নির্দেশ দিচ্ছেন, একের পর এক অযাচিত অফিস অর্ডার করেই চলেছেন, ডাক্তার আর সেবকদের ভয় দেখাচ্ছেন, মিডিয়াকে দুষেই চলেছেন কিন্তু কেউ সামান্য বিনয় প্রদর্শন করতে পারছেন না! বিনয়ের সঙ্গে বলি- দেখুন, দুনিয়ার সব দেশই আক্রান্ত, কিন্তু বিনয়ে সবার মাথা নুয়েই আছে, কোন দেশে ধমক নেই। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়ন গবেষণা প্রকল্প [email protected]
×