ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খালেদা হোম কোয়ারেন্টাইনে

হাসপাতাল হয়ে উঠছে ফিরোজা

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ২৮ মার্চ ২০২০

 হাসপাতাল হয়ে উঠছে ফিরোজা

শরীফুল ইসলাম ॥ সাময়িক কারামুক্ত বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া যাতে বাসায় অবস্থান করেই যাবতীয় চিকিৎসা সেবা পেতে পারেন সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তার মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শে গুলশানের বাসা ফিরোজা’য় হাসপাতালের পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ জন্য বর্তমানে ওই বাসায় হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা খালেদা জিয়ার শয়নকক্ষের পাশের আরেকটি বড় কক্ষে তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় যন্ত্রপাতি সেট করা হচ্ছে। আর আপাতত তার বাসায় চিকিৎসক ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। সূত্রমতে, খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শে ও লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানের ইচ্ছায় চিকিৎসার জন্য যা যা প্রয়োজন তা সংগ্রহ করে গুলশানের বাসাটাকেই অস্থায়ী হাসপাতালের আদলে গড়ে তোলা হচ্ছে। যাবতীয় চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছেন বিএনপি পন্থী চিকিৎসক সংগঠন ড্যাবের নেতারা। এ কাজ তদারকি করছেন ড্যাবের সাবেক মহাসচিব ও বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডাঃ এবিএম জাহিদ হোসেন। তবে তিনি এ কাজ করতে গিয়ে তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডাঃ জোবায়দা রহমানের পরামর্শ নিচ্ছেন। এক সপ্তাহের মধ্যেই খালেদা জিয়ার বসবাস করা গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর রোডের ১ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের কাজ শেষ হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। মুক্তি পেয়ে বাসায় ফেরার পরপরই খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎ?সকেরা তার সুচিকিৎসার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি শুরু করেন। ইতোমধ্যেই চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু যন্ত্রপাতি সেখানে রাখা হয়েছে। ৬ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শে নিয়মিত তার চিকিৎসা চলছে। এ জন্য একজন ডাক্তার ও একজন নার্স সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিদিনই তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করানো হচ্ছে। জানা যায়, চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি নিয়মিত ওষুধ সেবন করায় শুক্রবার খালেদা জিয়ার ডায়াবেটিস কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ ছাড়া তার স্বাস্থ্যের সার্বিক অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভাল হয়েছে। আর বাসায় অবস্থান করার পর মানসিকভাবে স্বস্তিতে থাকায় সব দিক থেকেই তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। বৃহস্পতিবার থেকে ১৪ দিনের জন্য তিনি হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন। এ সময় পার হওয়ার পর আরও ব্যাপকভাবে তার শারীরিক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সে রিপোর্ট অনুসারে উন্নত চিকিৎসা করা হবে। সূত্র জানায়, কাজের মেয়ে ফাতেমা ও চিকিৎসকদের খালেদা জিয়ার কক্ষে যেতে হলে পাশের আরেকটি কক্ষে জীবাণুনাশক ব্যবহারসহ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক পরতে হচ্ছে। আর হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা অবস্থায় নিকটাত্মীয়দেরও বাসায় আসতে নিষেধ করা হয়েছে। এ ছাড়া সমগ্র বাসাটির ওপর ও নীচতলায় প্রতিদিন জীবাণুনাশক ছিটিয়ে জীবাণুমুক্ত রাখা হচ্ছে। এদিকে ৬ মাসের জন্য মুক্তি পেয়ে গুলশানের বাসায় অবস্থান করার পর থেকেই খালেদা জিয়ার চিকিৎসার সার্বিক তদারকি করছেন লন্ডন প্রবাসী পুত্রবধূ ডাঃ জোবায়দা রহমান। ৬ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা চললেও লন্ডন থেকে ডাঃ জোবায়দা রহমানই খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি সমন্বয় করছেন। তিনি খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয় নিয়ে লন্ডনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে বিএনপির ভাইসচেয়ারম্যান ও ড্যাবের সাবেক মহাসচিব ডাঃ এবিএম জাহিদ হোসেন বলেন, গুলশানের বাসায় যাতে খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা যায় সে জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এ জন্য বাসায়ই হাসপাতালের পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তার চিকিৎসার জন্য যা যা প্রয়োজন তা বাসায় এনে রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া চিকিৎসকদের পরামর্শে সেলফ কোয়ারেন্টাইনে আছেন। তার অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভাল। তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করেছে। এ ছাড়া নিজের বাসায় ভাল পরিবেশে থাকার কারণে তিনি মানসিকভাবে স্বস্তিবোধ করছেন। প্রতিদিনই আমরা কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম মেনে পর্যবেক্ষণ করছি। ইতোমধ্যেই কোন কোন ওষুধের ডোজ কমানো-বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, ৬ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শে খালেদা জিয়াকে এখন বাসায়ই চিকিৎসা নিতে হবে। বাসাটাকে কিভাবে হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তোলা যায় সে প্রস্তুতি চলছে। ওনার চিকিৎসার জন্য যা যা প্রয়োজন তা সেখানে রাখা হচ্ছে। দু’এক সপ্তাহের মধ্যেই ওনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে বলে আমরা আশা করছি। মুক্তি পাওয়ার পর খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিএনপি গঠিত ৬ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডে রয়েছেন- প্রফেসর ডাঃ এফ এফ রহমান, প্রফেসর ডাঃ রজিবুল ইসলাম, প্রফেসর ডাঃ আব্দুল কুদ্দুস, প্রফেসর ডাঃ হাবিবুর রহমান, প্রফেসর ডাঃ সিরাজ উদ্দিন ও প্রফেসর ডাঃ এ জেড এম জাহিদ হোসেন। তাদের পরামর্শে বাসায় একজন ডাক্তার ও একজন নার্স সার্বক্ষণিক খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। ২৫ মার্চ দুর্নীতির মামলায় দুই বছর দেড় মাস কারাভোগের পর শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। মানবিক বিবেচনায় সরকারের নির্বাহী আদেশে দ-াদেশ স্থগিত রেখে ছয় মাসের জন্য তার ভাই শামীম ইস্কান্দারের জিন্মায় মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তির ২ শর্তের মধ্যে রয়েছে এই ৬ মাস বাসায় অবস্থান করেই চিকিসা নিতে হবে এবং তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। মুক্তির আগের দিন ২৪ মার্চ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলন করে সরকার তার বয়স বিবেচনায় মানবিক কারণে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে এবং বয়স ও মানবিক বিবেচনায় ৪০১ ধারায় শর্তসাপেক্ষে তাকে মুক্তির কথা জানান তিনি। ২৪ মার্চ আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির সুপারিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলে সেখানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কারামুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর পর তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যায়। ফাইলে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে সেই ফাইল ২৫ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে কারা অধিদফতরে পৌঁছে। পরে কারা অধিদফতরের মুক্তির প্রক্রিয়া শেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের (বিএসএমএমইউ) প্রিজন সেল থেকে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তির পর বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী শোডাউন করে খালেদা জিয়াকে বিএসএমএমইউ থেকে গুলশানের বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। বেশ ক’দিন আগে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য মুক্তি চেয়ে স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেন খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার, কোন সেলিমা ইসলাম ও বোনের জামাই রফিকুল ইসলাম। তারা খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছেও একটি আবেদন করেন। এর পরই খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি ত্বরান্বিত হয়। স্বজনদের বিরামহীন চেষ্টায় মুক্ত হন তিনি। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার ৫ বছরের সাজা হয়। ওইদিন থেকেই পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার আসামি হিসেবে বন্দী জীবন শুরু করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। পরে হাইকোর্ট তার সেই সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদ-াদেশ দেন। একই বছর ২৯ অক্টোবর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার ৭ বছরের সাজা হয়। দুই মামলায় ১৭ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে তিনি কারাবন্দী। গত বছর ১ এপ্রিল থেকে তিনি বিএসএমএমইউ হাসপাতালের ৬২১ নম্বর কেবিনে কারা নজরদারিতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু সেখানের চিকিৎসায় খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় বিএনপি ও স্বজনদের পক্ষ থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে উন্নত চিকিৎসার দাবি জানানো হয়। স্বজনরা চেয়েছিল মুক্তি পেলে তাকে লন্ডনে নিয়ে চিকিৎসা করাতে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী বর্তমান করোনা পরিস্থিতি ও মুক্তির শর্ত অনুসারে বিদেশে নেয়া যাচ্ছে না বিধায় খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা গুলশানের বাসায়ই করা হয়েছে।
×