ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ১০:৩৯, ২৭ মার্চ ২০২০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ স্বাধীনতা দিবস অথচ সবাই ঘরে। ঢাকার রাস্তা-ঘাট ফাঁকা। জনশূন্য। পতাকার লাল-সবুজ গায়ে জড়িয়ে কেউ, না, বের হলেন না। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের মন খারাপ করা ছবি সামনে এলো। ফুল নিয়ে সেখানে কেউ গেল না। এত দূরে থাকা, এত উদ্যাপনহীন স্বাধীনতা দিবস আগে কোনদিন আসেনি। ঢাকার কোথাও উৎসব অনুষ্ঠান নেই। স্বাধীন বাংলা বেতারের গানগুলো বাজল না। উচ্চারিত হলো না কবিতার কোন পঙ্ক্তি। হ্যাঁ, করোনা ঝুঁকির কারণেই সরকারীভাবে এদিনের সকল কর্মসূচী বাতিল করা হয়েছিল। সংক্রমণ থেকে বাঁচতে গুটিয়ে নেয়া হয়েছিল সব কিছু। সিদ্ধান্তটি যে বাস্তবসম্মত, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এরপরও মন মানছিল না। এতবড় একটি উপলক্ষ! এভাবে নিভৃতে পার করে দেব আমরা? বিকল্প কিছুই কি ভাবব না? এমন নানা প্রশ্ন মনকে যখন বিষন্ন করে তুলছিল ঠিক তখনই সামনে এলো অদ্ভুত সুন্দর একটি ছবি। ছবিতে দেখা যায়, ঢাকার একটি বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছে দুই শিশু। পতাকার দিকে তাকিয়ে স্যালুট দিচ্ছে তারা। ঘরবন্দী অবস্থায় এমন স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন দেখে, কী বলব, মনটা আনন্দে ভরে উঠল। কিছুক্ষণ আগের বিষণœতা আর খুঁজে পেলাম না নিজের মধ্যে। পরে জেনে আরও ভাল লাগল যে, সচেতন উদ্যোগটি অভিনেতা মাজনুন মিজানের। ছবির দুই শিশু তার সন্তান। ছেলে লুব্ধক মানব ও মেয়ে রাজেশ্বরী মৃন্ময়ীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নিজেও এদিন স্যালুট জানান। কথা প্রসঙ্গে বলেন, ঘরে বসে কত কিছুই তো করছি। স্বাধীনতা দিবসটা উদ্যাপন করব না? তাই পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। সবাই মিলে স্যালুট দিলাম। যাদের প্রাণপণ লড়াইয়ে স্বাধীনতা বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সালাম জানালাম। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হলাম। বাচ্চারাও শিখল। বলার অপেক্ষা রাখে না, আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলতে এমন ছোট ছোট উদ্যোগও অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। মাজনুন মিজান ও তার দুই সন্তানকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ঘুরে ফিরে এসেছে স্বাধীনতা দিবস। একে অন্যকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। স্ট্যাটাস দিয়ে যুদ্ধদিনের কথা স্মরণ করেছেন অনেকে। দেওয়ান মাবুদ আহমেদ নামের একজনের একটি পোস্ট পড়ে ফিরে গেলাম একাত্তরে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের ডায়রী’ থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন তিনি, যেখানে জননী লিখছেন, ‘কাঁহাতক ঘরে বসে থাকা যায়। এক সময় উঠে সদর দরজা খুলে গাড়ি-বারান্দায় গেলাম। আমাদের বাসার সামনের এই গলিটা কানা। এলিফ্যান্ট রোড থেকে নেমে এসে আমাদের বাসা পেরিয়েই বন্ধ হয়ে গেছে। ওই বন্ধ জায়গাটার ওপরে ডাঃ এ. কে, খানের বাড়ি। বন্ধ গলি হওয়ার মস্ত সুবিধে এখানে বাইরের লোকের চলাচল বা ভিড় নেই। এ রাস্তার বাড়িগুলোর বাসিন্দারা- আমরা অনেক সময় গলির ওপর দাঁড়িয়ে গল্প করি। গলিটা যেন আমাদের সকলের এজমালি উঠান। ১৯৫৯ সালে এখানে বাড়ি করে উঠে আসার পর থেকে এদেশে যতবার কারফিউ পড়েছে, আমরা বাড়ির সামনের এই গলিতে দাড়িয়ে বহু সময় গল্পগুজব করে কাটিয়েছি। আজ কিন্তু গাড়ি-বারান্দা পেরিয়ে গলিতে পা রাখতে সাহস হলো না। গোলাগুলির শব্দে এখনও আকাশ ফাটছে। মাঝে মাঝে কুকুরের চিৎকার কানে ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে মনে হচ্ছে যেন মানুষেরও চিৎকার। খুব অস্পষ্ট। নাকি আমার ভুল? এত বিরামহীন গোলাগুলির পরও কোন মানুষ কি বেঁচে আছে চিৎকার দেয়ার জন্য? আশ্চর্যের ব্যাপার, একটা কাক, চিল কি কোন পাখির ডাক নেই...।’ এভাবে বিকল্প পথে উদ্যাপিত হওয়া স্বাধীনতা দিবসের কথা নিশ্চয়ই অনেকদিন মনে থাকবে আমাদের। এর বাইরে পুলিশের একটি অপকর্মের কথা বলতেই হবে। এদিন কাওরান বাজারের রাস্তায় নেমে কয়েকজন পথচারীকে বেধড়ক পিটিয়েছে তারা। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে এমন অসভ্য আচরণ দেখে সাধারণ মানুষ হতবাক হয়ে গেছে। করোনার ঝুঁকির কারণে বাসা থেকে বের না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই মাঝে ঢাকা ফাঁকা হয়ে গেছে। লোকজন নেই বললেই চলে। বিশেষ প্রয়োজনেই কেউ কেউ বের হচ্ছেন। তাদের বোঝানো যেতে পারে। ভয় দেখানো যেতে পারে কিন্তু কোন তথ্য জানার চেষ্টা না করে এমন লাঠিপেটা করা দেখে মনে হয়েছে, খুব মজা পাচ্ছেন পুলিশের ওই সদস্যরা। অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি উঠেছে এদিন।
×