ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুই পক্ষই মহাখুশি

ঘরে বসেই কারাবন্দীর সঙ্গে কথা বলতে পারছেন স্বজনরা

প্রকাশিত: ১০:৩৬, ২৭ মার্চ ২০২০

ঘরে বসেই কারাবন্দীর সঙ্গে কথা বলতে পারছেন স্বজনরা

মশিউর রহমান ॥ কারাবন্দীর সঙ্গে স্বজনদের সরাসরি সাক্ষাতের ২৩২ বছরের ইতিহাস ভঙ্গ করে দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল পদ্ধতিতে মোবাইল ফোনে ঢাকা কেন্দ্রীয়সহ দেশের সকল কারাগারে আটক বন্দীর সঙ্গে কথা বললেন স্বজনরা। জনকণ্ঠকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ কর্নেল আবরার হোসেন। স্বজনরা ঘরে বসেই কথা বলায় এ নিয়ে কারাবন্দীদের মাঝে বইছে আনন্দের বন্যা। কথা শেষ করার পরও আবেগে বন্দীর খুশি যেন থামছেই না। কেউ কেউ আনন্দে কেঁদে ফেলেছেন। অপরদিকে এ প্রান্তের স্বজনরাও কথা বলে মহাখুশি। অনেকে হঠাৎ করে বাবা-মা বা স্বজনের ফোন পেয়ে বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে ঘরে বসেই সরকারী নিয়ম মেনেই কথা বলতে পারছেন তার স্বজনরা। স্বজনরা কারাগারে না গিয়েই মন খোলে ঘরে বসেই কথা বলার সুযোগ পেয়ে বেশ আনন্দিত। ১৭৮৮ সালে মোগল আমলে তৈরি প্রথম কারাগার হিসেবে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী আটক রাখার ব্যবস্থা করার পর এই প্রথম নিশ্চিন্ত মনে বন্দীর সঙ্গে কথা বললেন তার স্বজনরা। একইসঙ্গে দেশের প্রতিটি কেন্দ্রীয় কারাগারেই মোবাইল ফোনে কারাবন্দীর সঙ্গে কথা বলার পদ্ধতি চালু করল সরকার। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকারের বিশেষ নির্দেশে স্বজনদের সঙ্গে বন্দীর সঙ্গে সাক্ষাতের কষ্ট লাঘবে কারা অধিদফতরের বিশেষ তত্ত্বাবধানে অতি দ্রুততার সঙ্গে মোবাইল ফোনে বন্দীর সঙ্গে কথা বলার এ বিশেষ সুযোগ তৈরি হলো। এর মাধ্যমে দেশে বন্দীর সঙ্গে সাক্ষাত পর্বের এক নতুন কারা ইতিহাস তৈরি হলো। কারা সূত্র জানায়, ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হিসেবে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বন্দীর সাক্ষাতের এ পদ্ধতি চালু করল সরকার। এ সুবিধা পরিবারের সদস্য তথা মা বাবা ভাই বোন, ছেলে মেয়ের সঙ্গে কথা বলার জন্যই দেয়া হবে। অন্য যে কোন অপরিচিত ব্যক্তি বা যে কারো সঙ্গে কথা বলার জন্য ফোন করতে সুযোগ দেবে না কারা কর্তৃপক্ষ। এর ফলে যে কোন বন্দী দেশের যে কোন প্রান্তে থাকার তার পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। এর আগে মোবাইল ফোনে বন্দীর সঙ্গে কথা বলর জন্য সরকার পরীক্ষমূলকভাবে টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে স্বজন নামে একটি প্রকল্প চালু করে। যা সফলভাবে শেষ হয়। কারাসূত্র জানায়, দেশের ৬৮ কারাগারের আটক ৯০ হাজার বন্দী এ সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। তবে প্রাথমিকভাবে জেএমবি বা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গী, দেশের আলোচিত মামলা বা রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় এবং চাঁদাবাজি মামলার আসামিরা এই সুবিধা পাচ্ছেন না। সাক্ষাত প্রথা বন্ধ করার মাধ্যমে সরকার কর্তৃক করোনাভাইরাস ছড়ানো রোধ করতে জরুরী ভিত্তিতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে কারা অধিদফতর। এছাড়া নাগরিক জীবনের ঝুঁকি ও নিরাপত্তা বিবেচনায় কারা অধিদফতর কর্তৃক মাদারীপুর জেলা কারাগারের সরাসরি সাক্ষাত পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখা হলেও মোবাইল ফোনে কথা বলার পদ্ধতি চালু করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) নিয়মানুযায়ী যে কোন একটি সিম থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি মানুষকে কথা বলা যাবে না। কথা বললে সেই সিমকে প্রাথমিকভাবে ব্লক করে দেয়া হয়। এ নিয়মের কারণে প্রতিটি কারাগারের সর্বোচ্চ ২৫০ জন বন্দী কথা বলার পরপরই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কারাগারের কিছু সিমের সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে নতুন এ পদ্ধতি নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ কিছুটা বিপাকে পড়ে। এ অবস্থায় কারা কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে বিটিসিএল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে বন্দীর সঙ্গে কথা বলার বিষয়টি বুঝাতে সক্ষম হওয়ায় ও ব্যাখ্যা উপযুক্ত প্রমাণিত হওয়ায় কারাগারের সেসব সিম পুনরায় চালু করে বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ। পরে আবার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন কারাবন্দীরা। সূত্র জানায়, একইসঙ্গে বর্তমান নিয়মেও সাক্ষাত প্রথা চালু থাকবে। এছাড়া কারাগারে মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় মূলত সাক্ষাতকক্ষের গাদাগাদিতে করোনাভাইরাস আরও ছড়ানোর আশঙ্কায় কারাকর্তৃপক্ষ সরাসরি সাক্ষাতে কিছুটা অনুৎসাহিত করছে ও নতুন নিয়মে কথা বলার জন্য পরামর্শ দিচ্ছে। তবে করোনার প্রাদুর্ভাবের সময় আটক কারাবন্দীর জীবনের ঝুঁকি বিবেচনায় সাক্ষাতপর্ব জেলকোড মেনে অত্যন্ত কঠোরভাবে অনুসরণ করছে কারাকর্তৃপক্ষ। নির্দিষ্ট সময়ের আগে কোনক্রমেই বন্দীর সঙ্গে যেন স্বজনরা সাক্ষাত করতে না পারে কারাকর্তৃপক্ষ এ নিয়ে নজরদারি করছে। কারা সূত্র জানায়, এর আগে গত সোম ও মঙ্গলবার মোবাইল ফোনে কথা বলার এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে কারাকর্তৃপক্ষ প্রতিটি কারাগারে জরুরী ভিত্তিতে মোবাইল ফোন ও নির্দিষ্ট সিম পৌঁছে দিয়েছে। দেশের সকল কারাগারের উপকারা মহাপরিদর্শকের (ডিআইজ প্রিজন্স) মাধ্যমে দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল জেল সুপার ও জেলারদের কাছে এসব সিম ও মোবাইল ফোনসেট দিয়ে সঙ্গে ফোনে কথা বলার ব্যালেন্সও দিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে কথা বলার জন্য বন্দীকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। নিয়মানুযায়ী প্রতি ২৫০ জন বন্দীর জন্য একটি ফোন ব্যবহার করতে পারবেন। সেই হিসাব অনুযায়ী কারাগার ও বন্দী অনুযায়ী কারাগারে বুথ স্থাপন ও মোবাইল ফোন প্রদান করা হবে। যেসব কারাগারে বর্তমানে ১ হাজার বন্দী আটক রয়েছে সেখানে মোট ৪টি টেলিফোন বুথ স্থাপন করা হচ্ছে। প্রতি কারাবন্দীর সঙ্গে স্বজনরা সপ্তাহে ১ দিন সর্বোচ্চ ৫ মিনিট করে কথা বলতে পারবেন। সকাল নয়টা থেকে বেলা ১২টা ও বেলা ১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত দুদফা কথা বলতে পারছেন কারাবন্দীরা। এজন্য প্রতি মিনিটের বিপরীতে বন্দীর প্রিজন্স ক্যাশ (পিসি) থেকে সপ্তাহে ব্যবহার্য মিনিটের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা কেটে নেয়া হবে। তবে এসব ফোনালাপ রেকর্ড করবে কারা প্রশাসন। আর সকল কর্মকা- পরিচালনার জন্য জেল সুপার, জেলার ও ডেপুটি জেলারের মাধ্যমে তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, অতি দ্রুততার সঙ্গে এ পদ্ধতি চালু করায় বুধবার পর্যন্ত ৩টি বুথ স্থাপন করেছে কারাকর্তৃপক্ষ। তবে আগামী ২ দিনের মধ্যেই মোট ২০টি বুথ স্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে। কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, কারাবন্দীর সংখ্যা বিবেচনায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মোট ৪৭টি বুথ স্থাপন করা প্রয়োজন। অধিদফতর কর্তৃক প্রাথমিকভাবে মোট ২০টি ফোনসেট প্রদান করা হয়েছে। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই ৪৭টি বুথই চালু করা হবে বলে জানা গেছে। অপরদিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জন্য প্রাথমিকভাবে ১৫টি ফোনসেট প্রদান করা হয়েছে। যেগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। কথা বলার সময় কোন বন্দী ফোনে অসংলগ্ন ও বেআইনী কোন কথা বললেই সঙ্গে সঙ্গে সেই ফোনের লাইন কেটে দেয়া হবে। একইসঙ্গে প্রয়োজনে তা রেকর্ড শোনার পর বন্দীর বিরুদ্ধে কারাবিধি ও জেলকোড অনুযায়ী তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তির ব্যবস্থা নেবে কারা প্রশাসন। প্রতি ৫ মিনিট পরই টেলিফোন লাইন অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যাবে। জানা গেছে, বন্দী অনুযায়ী বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মোট প্রায় ১০ হাজার ২শ’ বন্দী আটক রয়েছেন। প্রতিটি কারাগারের ভেতরে কারা কর্তৃপক্ষ মাইকে তাদের স্বজনদের যেন দেখা না করে ফোনে কথা বলেন সেজন্য উৎসাহিত করতে পরামর্শ দিতে বন্দীদের প্রতি অনুরোধ করছে কারা কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ কর্নেল আবরার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, বন্দীর সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাতের ২৩২ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বর্তমান সরকার। আগের নিয়মে বন্দীর সঙ্গে স্বজনদের অনেক কষ্ট করে অর্থ ও সময় ব্যয় করে সরাসরি কারাগারে এসে সাক্ষাত করতে হতো। মূলত আমরা কারাবন্দী ও স্বজনদের আসা যাওয়া ও সাক্ষাতের কষ্ট লাঘব করতে চাই। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কথা বলার পদ্ধতি চালু হওয়ায় বর্তমানে যে কোন বন্দী ঘরে বসেই সপ্তাহে একদিন ৫ মিনিট করে সকল হাজতি ও কয়েদি বন্দী কথা বলতে পারছেন। যা বন্দী ও স্বজনদের কাছে অনেকটা অবিশ্বাস্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন কারাগারে খোঁজ নিয়ে জেনেছি আসামি ও তার স্বজনরা মোবাইল ফোনে কথা বলে মহাখুশি। কারাভ্যন্তরে বন্দীদের মাঝে বইছে আনন্দের বন্যা। তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হিসেবে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বন্দীর সাক্ষাতের এ পদ্ধতি চালু করলো সরকার। এ সুবিধা পরিবারের সদস্য তথা মা বাবা ভাই বোন, ছেলে মেয়ের সঙ্গে কথা বলার জন্যই দেয়া হবে। অন্য যে কোন অপরিচিত ব্যক্তি বা যে কারো সঙ্গে কথা বলার জন্য ফোন করতে সুযোগ দেবে না কারাকর্তৃপক্ষ। আবরার বলেন, পূর্বের নিয়মে নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে কথা বলার নিয়ম থাকায় অনেক বন্দীর স্বজন ও বন্দী একে অপরের কথা শোনার সুযোগ পেতেন না। বর্তমান নিয়মে এর অবসান ঘটলো। কর্নেল আবরার বলেন, সরকারের বিশেষ নির্দেশনায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমাতে গাগাগাদি করে জনবহুল স্থানে বন্দীর সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাত বন্ধ করতেই আমরা মোবাইল ফোনে সারাদেশের সকল কারাগারে এ পদ্ধতি চালু করেছি। কারা অধিদফতরের নিজস্ব অর্থায়নে মোবাইল ফোন ও সিম কিনে দেয়া হয়েছে। পাবলিক হেলথের এ বিশেষজ্ঞ জনকণ্ঠকে বলেন, বন্দীর বিষণœতা দূর করবে ও একইসঙ্গে দেখা করতে আসা স্বজনদের কষ্ট লাঘবে অনেক সহায়তা হবে। দেশের ৬৮ কারাগারের আটক ৯০ হাজার বন্দী এ সুবিধা ভোগ করবে। প্রাথমিকভাবে জেএমবি বা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গী, দেশের আলোচিত মামলা বা রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় এবং চাঁদাবাজি মামলার আসামিগণ এই সুবিধা পাচ্ছেন না। সকাল নয়টা থেকে বেলা ১২টা ও বেলা ১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত দুদফা কথা বলতে পারছেন বন্দীরা। এজন্য প্রতি মিনিট বন্দীর প্রিজন্স ক্যাশ (পিসি) থেকে সপ্তাহে ৫ মিনিটের জন্য সর্বোচ্চ ৫ টাকা কেটে নেয়া হবে। প্রতি সপ্তাহে একজন বন্দী সর্বোচ্চ একবার কথা বলবেন।
×