ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তালাবদ্ধ স্কুলে তিনি একাই তুললেন জাতীয় পতাকা

প্রকাশিত: ১০:৩২, ২৭ মার্চ ২০২০

তালাবদ্ধ স্কুলে তিনি একাই তুললেন জাতীয় পতাকা

রশিদ মামুন ॥ ‘কোথাও কেউ নেই। এত হা হা শূন্যতায় কোনদিন জাতীয় পতাকা তুলিনি। আমার সন্তানেরা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে আর আমি প্রাণের পতাকা মেলে দেই অসীম নীলে, বিস্তৃত আকাশে। আজ কেন যেন বুক ফেটে কান্নার ঢেউ আছড়ে পড়ছে, চোখ দুটো অকারণে ভিজে উঠছে। ভালো থেকো আমার সন্তানেরা। আবারো যেন এই মাঠে তোমাদেরকে নিয়ে গাইতে পারি প্রাণের সঙ্গীত।’ খুলনাঞ্চলের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ আল মামুনের ফেসবুক স্ট্যাটাস। স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের একটি ভিডিও শেয়ার করে ফেসবুকে এই স্ট্যাটাসটি দিয়েছেন তিনি। তালাবদ্ধ স্কুলে একাই এসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছেন তিনি। দূরে দাঁড়িয়ে উৎসুক তিন শিক্ষার্থী স্যারের কাজটি দেখছেন। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস কিংবা অন্যকোন জাতীয় দিনে সারাদেশ উৎসবে মেতে ওঠে, করোনা আতঙ্কে সেখানেই রাজ্যের শূন্যতা। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের সব রাষ্ট্রীয় আয়োজন বাতিল হয়েছে। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে দেশের মানুষকে নিরাপদে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সাধারণ মানুষকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। সাধারণ মানুষও সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। স্বাধীনতা দিবস পালনে লাল-সবুজের কোন আয়োজন হয়নি এবার। নিকট অতীতে এমন অভিজ্ঞতা হয়নি কারও। সারা বিশে^ চার লাখ ৭০ হাজার ৯৭৩ জন গতকাল বিকেল পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। দেশেও এই ভাইরাস সংক্রমণের শিকার ৪৪ জন। তাদের পাঁচজনকে আমরা ইতোমধ্যে হারিয়েছি। ভয়ঙ্কর এই ভাইরাস প্রতিরোধে একমাত্র উপায় মানুষকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। মূলত আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশি থেকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। একটি জীবিত ভাইরাস মুহূর্তে মিলিয়ন মিলিয়ন ভাইরাস সৃষ্টি করতে পারে। আর তার একটি ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলে তিনি আরও মানুষকে আক্রান্ত করতে পারেন। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনা ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলে প্রথম ১৪ দিন কোন লক্ষণ প্রকাশ নাও পেতে পারে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তার হাঁচি কাশি থেকে পরিবেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে যাতে নতুন মানুষে ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটতে পারে। সেই দিক বিবেচনা করে মানুষকে জনবিচ্ছিন্ন থাকতে বলা হচ্ছে। বৈশি^ক এই মহামারীতে সব মানুষ ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। সঙ্গত কারণে এবার স্বাধীনতা দিবসের কোনো আয়োজন দেশের কোথাও হয়নি। স্বাধীনতা দিবসে রাজধানী ঢাকা সাজে লাল-সবুজের বর্ণিল সাজে। সকাল থেকে রাত অবধি রাজধানীর সব রাস্তা কানায় কানায় সাধারণ মানুষে পরিপূর্ণ থাকে। জাতীয় সংসদ ভবন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, শহীদ মিনার, হাতিরঝিল ছাড়াও বিভিন্ন এলাকা এত সাধারণ মানুষ বেরিয়ে আসে যে পা ফেলার জায়গা থাকে না। কিন্তু এবার ঘটেছে ঠিক এর উল্টো। বৃহস্পতিবার এসব জায়গাতে কোন মানুষকে দেখা যায়নি। এর বিপরীতে এসব জায়গাতে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং আনসার সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে। স্বাধীনতা দিবসে ঢাকার এই চিত্র কেউ আগে কোন দিন দেখেনি। সরকারের আগের ঘোষণা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার থেকে টানা ছুটি শুরু হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে টাকা দশদিন দেশ কোয়ারেন্টাইনে যাচ্ছে। এজন্য শহর বা গ্রামের কোন রাস্তাতে কাউকে নামতে দেয়া হয়নি। সরাসরি লকডাউনের ঘোষণা দেয়া না হলেও অঘোষিত লকডাউনই চলছে দেশজুড়ে। জরুরী সেবা ছাড়া সব দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দেশের সব ধরনের পরিবহনও বন্ধ রয়েছে। শহর ঢাকার এক রিক্সাচালক আব্দুল মালেক বলেছেন, এর আগে এমন ঢাকার চিত্র কোনদিন তিনি দেখেননি। ঈদের সময়ও এমন ফাঁকা চিত্র দেখা যায় না। সকালে পেটের তাগিদে বের হতে হয়েছে তাকে। কিন্তু যাত্রী না থাকায় বসেই কাটাতে হয়েছে। এখন জাতীয় দিবসগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি থাকে না। সকাল সকাল স্কুল কলেজে গিয়ে নানা আয়োজনে অংশ নেয় সব শিক্ষার্থী। কিন্তু এবার তার কোন আয়োজনই করেনি কেউ। যেসব শিক্ষকের মন কেঁদেছে তারা হয়তো শিক্ষক শেখ আল মামুনের মতো বিষণœ চিত্তে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছেন।
×