ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন যুগের সম্ভাবনা আবর্জনার দিন শেষ

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ২৭ মার্চ ২০২০

নতুন যুগের সম্ভাবনা আবর্জনার দিন শেষ

জঞ্জাল নেই, আবর্জনা নেই এমন একটা জগতের অস্তিত্ব বাহ্যত অসম্ভব বলেই মনে হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা আজ যে সার্কুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকারে অর্থনীতির কথা ভাবছেন তাতে এই অসম্ভবই এখন সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। সেই অর্থনীতিতে সম্পদ মিতব্যয়িতার সঙ্গে ব্যবহার করা হবে এবং ব্যবহৃত সামগ্রী বিরামহীনভাবে রিসাইকেল পুনর্প্রক্রিয়াজাত করা হবে। এমন এক অর্থনীতির ধারণা ব্যবসায়ী ও পরিবেশবাদী নির্বিশেষে সবাইকে অনুপ্রাণিত করছে। প্রশ্ন হচ্ছে তেমন এক অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা কি আমরা করতে পারব? প্রশ্নটাকে ঘুরিয়ে করা যায় তেমন এক অর্থনীতি কায়েম হতে না দেয়া কি আমাদের পক্ষে উচিত না সম্ভব? সে প্রশ্নের জানান পাওয়ার আগে আমাদের বিশ্ব অর্থনীতির চেহারাটা একবার খতিয়ে দেখা যাক। প্রতি বছর আমরা ১০ হাজার কোটি টনেরও বেশি কাঁচামালকে পণ্যে রূপান্তরিত করি। এর এক-চতুর্থাংশেরও কম দিয়ে ইমারত, মোটরগাড়ি ও অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী জিনিস তৈরি হয়। ১০ শতাংশেরও কম বৃত্তাকারে অর্থনীতিতে ফিরে আসে। বৃত্তাকার অর্থনীতির প্রবক্তাদের লক্ষ্য হচ্ছে এই ফিরে আসার সংখ্যাটা বাড়িয়ে তোলা এবং বিপুল পরিমাণ অপচয় হ্রাস করা। প্রকৃতি জগতের ইকোসিস্টেম চক্রাকারে চলে। উদ্ভিদ মাটিতে জন্মে, প্রাণীরা উদ্ভিদ খায়, তাদের শরীরের বর্জ্য যেমন গোবর ইত্যাদি দিয়ে মৃত্তিকার ঘাটতি পূরণ হয়। শিল্প অর্থনীতি ইকোসিস্টেমের মতো চক্রাকারে চলে না। চলে বহুলাংশে রৈখিক আকারে। প্রকৃতির প্রধান চারটি কাঁচামাল খনিজদ্রব্য, আকরিক পদার্থ, জীবাশ্ম জ্বালানি ও বায়োমাস মানুষের সাত ধরনের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বিভিন্ন পণ্যে পরিণত হয়েছে। ছয়টি মহাদেশে বালু দিয়ে তৈরি হয়েছে সুউচ্চ কংক্রিটের এ্যাপার্টমেন্ট। ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়েছে জাহাজ, মোটরগাড়ি, হার্ভেস্টার। একটি মাত্র বছরে আমরা হার্ভেস্টার ব্যবহার করে কিংবা হার্ভেস্টার বাদেই তৈরি করেছি ২০২০ কোটি টন বায়োমাস স্রেফ আমাদের সকলের খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য। জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে যানবাহন, হার্ভেস্টার ইত্যাদি চলেছে। তৈরি হয়েছে বিদ্যুত যা দিয়ে আমাদের ঘরবাড়ি আলোকিত ও উষ্ণ থেকেছে। তৈরি হয়েছে প্লাস্টিক ও আরও নানা ধরনের পণ্য। ২০১৫ সালে অর্থনীতিতে মোট প্রবাহ ঘটেছে ১০ হাজার ২৩০ কোটি টন দ্রব্যসামগ্রীর। এটা মানুষের শ্রমের ফল সন্দেহ নেই। কিন্তু এসব দিয়ে আমাদের চাহিদা পূরণ হওয়ার পর কি ঘটেছে সেটাই হলো সমস্যা- বলা যেতে পারে সব পরিবেশগত সমস্যার বড় সমস্যা। এ বছরটিতে আমরা এই গ্রহের বুক থেকে যা কিছু আহরণ করেছি তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আমাদের আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ৬ হাজার ৭০০ কোটি টনের বেশি কঠিন পদার্থ খোয়া গেছে- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। প্লাস্টিকের পরিত্যক্ত সামগ্রী নদীতে ও সাগরে ভেসে গেছে। আমাদের সার দেয়া ফসলের ক্ষেত থেকে বেরিয়ে গেছে নাইট্রেট ও ফসফেট। উৎপাদিত খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশ পচে গেছে। অধিক খাদ্য ফলানোর জন্য আমাজন অরণ্যের একাংশ উদ্ধার করে দেয়ার পরও তা ঘটেছে। আমাদের যে পরিবেশগত সমস্যা তাও কিন্তু বর্জ্যরে সঙ্গে যুক্ত। পরিবেশগত সমস্যার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনও আছে। পরিবর্তনের কারণ আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াই এবং তা থেকে সৃষ্ট বর্জ্য কার্বন-ডাই অক্সাইড বায়ুম-লে ছড়িয়ে দেই। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্পের কাজে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের আগ পর্যন্ত মানুষ তার বেশিরভাগ কাজকর্ম করত পেশীশক্তির জোরে তা মানুষের হোক আর প্রাণীর হোক। খাদ্য ও পণ্য উৎপাদন এবং পরিবহনের মতো কাজগুলো কঠোর শ্রমের দ্বারা সম্পন্ন হতো। তবে মানুষের দৈহিক শক্তি সীমিত থাকায় এই গ্রহের পরিবেশ প্রতিবেশের ক্ষতিসাধনের মাত্রাও ছিল সীমিত। এতে অবশ্য বেশিরভাগ মানুষ গরিব ছিল। তথাপি পরিবেশ ছিল সূক্ষ্ম। কিন্তু এরপর তেল, কয়লা, গ্যাসের মতো সস্তা জীবাশ্ম জ্বালানির আহরণ সবকিছু বদলে দেয়। যে কোন জায়গায় কাঁচামাল আহরণ, কারখানায় নেয়া এবং উৎপাদিত পণ্য সব জায়গায় পৌঁছে দেয়া সহজতর হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি আমাদের সম্ভাবনার বিস্ফোরণ ঘটায়। এখনও সেই সম্ভাবনার ব্যাপক বিস্তার ঘটে চলেছে। গত অর্ধ শতাব্দীতে বিশ্বের জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে এবং বিশ্ব অর্থনীতি দিয়ে প্রবাহিত পণ্যসামগ্রীর পরিমাণ তিনগুণেরও বেশি হয়েছে। আজ আমরা একটা চরম সীমার দিকে পৌঁছে যাচ্ছি। গত অর্ধ শতাব্দী ধরে পরিবেশবাদীরা হুঁশিয়ার করে দিচ্ছেন যে প্রবৃদ্ধির রাশ টেনে ধরা দরকার। কিন্তু নতুন যে সার্কুলার অর্থনীতির কথা বলা হচ্ছে তা ভিন্ন ধরনের। এটি হচ্ছে বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজি বা কৌশলের সমষ্টি। সেই কৌশলগুলোর কোনটি পুরনো আবার কোনটি নতুন। পুরনোর মধ্যে আছে জিনিসের পুনর্ব্যবহার ও পুনর্প্রক্রিয়াজাতকরণ। নতুনের মধ্যে আছে জিনিসের অধিকারী না হয়ে অন্যকে ধার দেয়া। একত্রিতভাবে এই নতুনÑপুরনো কৌশলের উদ্দেশ্য হচ্ছে বর্জ্য ও অপচয় দূর করার জন্য বিশ্ব অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানো। সার্কুলার অর্থনীতির লক্ষ্য প্রবৃদ্ধির অবসান ঘটানো নয়। এর লক্ষ্য হচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গে সুসামঞ্জস্য রক্ষা করে উৎপাদন ও অন্যান্য কাজকর্ম করা যাতে করে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। সীমিত সম্পদের মধ্যে সমৃদ্ধি এটাই হচ্ছে সার্কুলার অর্থনীতির মূলমন্ত্র। ধারণা করা হচ্ছে এমন অর্থনীতির মধ্য দিয়ে ইউরোপে বছরে ৬৩ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত ব্যবসা সাশ্রয় হবে। এমন অর্থনীতির ধারণাটি বিশেষ করে ইউরোপে অর্থাৎ আয়তনে ছোট, জনবহুল, ধনী অথচ সম্পদ স্বল্প মহাদেশটিতে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই স্ট্র্যাটেজির পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। নেদারল্যান্ডস ২০৫০ সালের মধ্যে পুরোপুরি সার্কুলার অর্থনীতিতে উত্তরণের অঙ্গীকার করেছে। প্যারিস আমস্টার্ডাম ও লন্ডনেরও এ জাতীয় পরিকল্পনা আছে। এটা হতেই হবে বলে মন্তব্য করেছেন লন্ডন ওয়েস্ট এ্যান্ড রিসাইক্লিং বোর্ডের প্রধান ওয়েইন হুবার্ড। এমন ঘটনার সম্ভাবনা নিয়ে সুস্পষ্ট চিন্তা-ভাবনা করেন মার্কিন স্থপতি উইলিয়াম ম্যাকডোনাফ। জার্মান কেমিস্ট মাইকেল ব্রাউনপার্টকে নিয়ে যৌথভাবে তিনি ২০০২ সালে ‘ক্র্যাডল টু ক্র্যাডল’ নামে একটা বই লিখে ছিলেন যেখানে যুক্তি সহকারে বলা হয়েছে যে পণ্যসামগ্রী ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোর পরিকল্পনা এমনভাবে করা যেতে পারে যে সমস্ত বর্জ্যই হয়ে দাঁড়াবে অন্য কোন কিছু তৈরির উপকরণ। এটা আকাশ কুসুম কল্পনা নয়, এটা বাস্তবেই সম্ভব বলে দৃঢ়ভাবে মনে করেন ম্যাকডোনাফ। সার্কুলার অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে কম ব্যবহার করা, যে জিনিস ব্যবহার হচ্ছে তা দীর্ঘদিন ব্যবহার করে চলা ও বিরামহীনভাবে রিসাইকেল করা। এর জন্য নানা কৌশল দরকার। এই অর্থনীতিতে সকল পণ্যই শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে টেকনিক্যাল নিউট্রিয়েন্টে অথবা বায়োলজিক্যাল নিউট্রিয়েন্টে পরিণত করা হয়। টেকনিক্যাল নিউট্রিয়েন্ট দিয়ে নতুন পণ্য তৈরি হয়। আর বায়োলজিক্যাল নিউট্রিয়েন্ট ফিরে যায় মৃত্তিকায়। অপচয় আমাদের ত্রুটির ফল। প্রকৃতিতে এর অস্তিত্ব নেই। অপচয়রোধে পণ্যসামগ্রীর ব্যবহার কমাতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির জায়গায় ব্যবহার করতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি। রেন্টাল বা শেয়ারিং ব্যবসায় অল্প সংখ্যক পণ্য দিয়ে বেশি সংখ্যক লোকের চাহিদা পূরণ করা যায়। পরিকল্পনা করতে হবে বিচক্ষণতার সঙ্গে। মেশিন ও অন্যান্য পণ্য এমনভাবে তৈরি করতে হবে যা হবে দীর্ঘস্থায়ী ও মেরামত করা সহজ কিংবা হবে এমন যে তা সহজেই ভেঙ্গে মৌলিক উপাদানে পরিণত করা যায়। সার্কুলার ইকোনমিতে সকল উপাদান চক্রাকারে ঘুরবে। প্রায় কোন কিছুই দূষিত পদার্থ বা বর্জ্য হিসেবে বের হবে না। কিংবা সেগুলো দিয়ে নিচু জমি ভরাট করা হবে না। এই অর্থনীতিতে নিজেকে সংযত রাখতে হবে। বিমান ও গাড়িতে যাতায়াত কমাতে হবে। কেনা খাবারের সবটুকু খেতে হবেÑ ফেলে দেয়া চলবে না। যে কাপড় আগে থেকেই আছে সেটাই বার বার ওয়াশ করতে হবে। ওয়ানটাইম ইউজের প্লাস্টিক সামগ্রী পরিহার করতে হবে। কিনতে হবে অল্প সংখ্যায় উন্নতমানের পণ্য। ভেঙ্গে বা বিকল হলে মেরামত করতে হবে। যে পোশাক পরা হচ্ছে না তা অন্যকে দান করতে হবে। অপচয় হওয়া খাবার দিয়ে কম্পোস্ট সার বানাতে কিংবা গবাদি পশুকে খাওয়াতে হবে। যতটা সম্ভব সবকিছুই রিসাইকেল করতে হবে এবং রিসাইক্লিংয়ের পক্ষে প্রচার চালাতে হবে। আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলা প্রায় সব দেশেরই রেওয়াজ। উন্নত দেশগুলোতে আবর্জনা দাহন-সঙ্গে পুড়িয়ে বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়। আবর্জনা জমিয়ে রাখার চেয়ে এটা নিঃসন্দেহে উন্নত ব্যবস্থা। তবে সার্কুলার অর্থনীতির লক্ষ্য হলো আবর্জনা আদৌ তৈরি হতে না দেয়া এবং এভাবে আবর্জনার অবসান ঘটানো। মেশিনারির পুনর্ব্যবহার অপচয় ও জঞ্জাল লাঘবের একটা সময়োচিত কৌশল। সার্কুলার অর্থনীতিও এই কৌশলের ওপর জোর দেয়। এই কৌশলই বাস্তবে প্রয়োগ করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এরিজোনার টুকসান এ ডেভিস মনথান এয়ারফোর্স বেস-এ। সেখানে মার্কিন সরকারের প্রায় ৩ হাজার ৩০০টি অব্যবহৃত বা অচল বিমান ও হেলিকপ্টার মজুদ করে রাখা হয়েছে। সেখানে বিমানগুলোর বিভিন্ন অংশ খুলে সার্ভিসিং ও মেরামত করে পুনঃসংযোজিত করা এবং এভাবে আবার চালু করা হয়। এমনিতে এরিজোনার শুষ্ক বায়ুর কারণে ক্ষয় কম হয়। তার ওপর বিমানগুলোকে সংরক্ষণ করার জন্য মুছে ফেলার উপযোগী একটা আবরণ স্প্রে করে দেয়া হয়। বনিয়ার্ড নামে কথিত এই স্থাপনাটি বিশ্বে এ ধরনের সর্ববৃহৎ। (চলবে...) সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×