ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেয়ে ফিরোজায় খালেদা

প্রকাশিত: ১১:০৫, ২৬ মার্চ ২০২০

শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেয়ে ফিরোজায় খালেদা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দুর্নীতির মামলায় দুই বছর দেড় মাস কারাভোগের পর মুক্তি পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। মানবিক বিবেচনায় সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য বুধবার বিকেল ৪টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়াকে তার ভাই শামীম ইস্কান্দারের জিম্মায় মুক্তি দেয়া হয়। ৭৭৬ দিন পর গুলশানের বাসা ফিরোজা’য় অবস্থান করবেন তিনি। হাসপাতাল থেকে বাসায় পৌঁছা পর্যন্ত তাকে দেখার জন্য পথে পথে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ভিড় করে। হাসপাতাল থেকে রওনা দেয়ার ১ ঘণ্টা পর বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে গুলশানের বাসায় পৌঁছেন তিনি। মুক্তি পেয়ে বিকেল সোয়া ৪টায় হাসপাতাল কেবিন ছেড়ে হুইল চেয়ারে করে লিফটযোগে নিচে নামেন খালেদা জিয়া। তার সঙ্গে ছিলেন কাজের মেয়ে ফাতেমা, যিনি কারাভোগকালে সার্বক্ষণিক খালেদা জিয়ার সঙ্গেই ছিলেন। এ সময় সেখানে উপস্থিতি বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী খালেদা জিয়াকে দেখে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন পুরো এলাকা। প্রতিযোগিতা শুরু হয় কাছে গিয়ে তাকে এক নজর দেখার জন্য। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হিমশিম খেতে হয়। দীর্ঘদিন পর খালেদা জিয়াকে কাছে পেয়ে তার স্বজন ও বিএনপি নেতাকর্মীরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। এর মধ্যে কেউ কেউ হাউমাউ করে কেঁদে আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, খালেদা জিয়ার ছোট শামীম ইস্কান্দার ও বোন সেলিমা ইসলাম খালেদা জিয়াকে গাড়িতে তুলেন। মুক্তি পাওয়ার পর খালেদা জিয়ার পরনে ছিল গোলাপি শাড়ি, চোখে সানগ্লাস ও মুখে মাস্ক। ছোট ভাইয়ের স্ত্রী কানিজ ফাতেমাও তার সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন। ৪টা ২২ মিনিটে খালেদা জিয়াকে বহনকারী গাড়ি হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসা ফিরোজার উদ্দেশে রওনা দেয়। এ সময় তাকে বহনকারী গাড়ির সামনে পেছনে ছিল বিএনপি নেতাকর্মী ও মিডিয়া কর্মীদের বিপুলসংখ্যক যানবাহন। এ ছাড়া দলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী রাস্তায় তার গাড়ি বহরের সামনে-পেছনে অবস্থান করে স্লোগান দিতে থাকে। দলের সিনিয়র নেতা ও আইনশৃঙাখলাবাহিনীর লোকেরা তাদের সরাতে ব্যর্থ হন। নেতাকর্মীদের ভিড় এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কয়েক দফা লাঠিচার্জ করতে হয়। এ সময় করোনা আতঙ্কের মধ্যে কেন নেতাকর্মীরা এভাবে সেখানে জড়ো হয়েছে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের সিনিয়র নেতারা জানান, দীর্ঘদিন পর খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়েছেন। তাই আমরা নিষেধ করা সত্ত্বেও তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তারা তাদের প্রিয় নেত্রীর প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা শুনে বুধবার সকালেই তার গুলশানের বাসা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে তার বসবাসের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করা হয়। আর সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে হাজির হতে থাকে দলের নেতাকর্মীরা। বেলা যত বাড়ে নেতাকর্মীদের ভিড় ততই বাড়তে থাকে। বিকেল পৌনে ৩টার দিকে বিএসএমএমইউতে পৌঁছান খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার, বোন সেলিনা ইসলাম এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের সিনিয়র নেতারা। করোনা আতঙ্কের মধ্যে হাসপাতালে এত ভিড় কেন এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, আমরা কিছুটা আবেগাপ্লুত তো বটেই, কিছুটা স্বস্তিও বোধ করছি। আবার কিছুটা আতঙ্কিতবোধ করছি এই ভয়ঙ্কর সময়ে তার এই মুক্তি তাই তার কোন ক্ষতি না ঘটে। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে ৬ মাসের জন্য খালেদা জিয়ার দ-াদেশ কার্যকারিতা স্থগিত করে মুক্তির আদেশের নথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের কয়েক মিনিটের মধ্যেই অফিসিয়াল প্রক্রিয়া শেষ করে ৪টার দিকে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম গণমাধ্যমকে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এরপর বিকেল সোয়া ৪টার দিকে হাসপাতাল থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসেন খালেদা জিয়া। এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান। নেতাকর্মীদের স্লোগানের মধ্যে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে রাখা গাড়িতে ওঠেন খালেদা জিয়া। সেখান থেকে খালেদা জিয়াকে বহনকারী গাড়ি বাংলামোটর, কাওরানবাজার, ফার্মগেট, মহাখালী ও বনানী হয়ে তার গুলশানের ৭৯ নম্বর রোডের ১ নম্বর বাসভবন ‘ফিরোজা’য় পৌঁছে। তবে খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার গৃহকর্মী ফাতেমাও হাসপাতাল থেকে বের হলেও ব ফাতেমা অন্য একটি গাড়িতে করে গুলশানের বাসায় আসেন। মঙ্গলবার সরকারের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলন করে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার তার বয়স বিবেচনায় মানবিক কারণে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান। তার সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত থাকবে এবং তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন এবং বিদেশ যেতে পারবেন না এমন শর্তে মুক্তির কথা জানান। আইন মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত সুপারিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলে সেখানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কারামুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়। সর্বশেষ তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যায়। ফাইলে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে সেই ফাইল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে কারা অধিদফতরে পৌঁছায়। পরে কারা অধিদফতরের মুক্তির প্রক্রিয়া শেষ করে বিএসএমএমইউতে খালেদা জিয়ার মুক্তির চিঠি নিয়ে যান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরী। সেখানকার আনুষ্ঠানিকতা শেষে মুক্তি পেলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। মুক্তির সময় খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র কারা ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বজনদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। কয়েকটি লাগেজ, চেয়ার, ব্যাগ গাড়িতে করে গুলশান নেয়া হয়। মঙ্গলবার বিকেলে গুলশানের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে এবং বয়স ও মানবিক বিবেচনায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ৪০১ ধারায় শর্তসাপেক্ষে ৬ মাসের জন্য মুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তার সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়া ঢাকার নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে পারবেন। তবে এ সময় তিনি বিদেশ যেতে পারবেন না। আইনমন্ত্রী বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা (উপধারা-১) অনুযায়ী এটা আইনী প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হচ্ছে জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ হচ্ছে আইনী প্রক্রিয়ায় দুই শর্তে তার দ-াদেশ স্থগিত রেখে তাকে মুক্তি দেয়া। দুই শর্তের মধ্যে রয়েছে ঢাকার নিজ বাসায় থেকে তিনি চিকিৎসা নেবেন এবং উক্ত সময়ে তিনি দেশের বাইরের গমন করতে পারবেন না। খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ার পর বিএনপির সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন ধরনের ব্যানার ফেস্টুন হাতে নিয়ে শাহবাগ থেকে তার গাড়িবহর অনুসরণ করে গুলশান পর্যন্ত আসেন। বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে গুলশানের বাসা ফিরোজায় পৌঁছে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর। এরপর তিনি বাসায় প্রবেশ করে আত্মীয়স্বজন ও দলের নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত অনেকেই ছিলেন আবেগাপ্লুত। খালেদা জিয়া গুলশানের বাসায় প্রবেশ করার পরও বাসার সামনে নেতাকর্মীরা ভিড় করে। এ সময় সেখানে অবস্থান করা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া যে ওনাকে আমরা বাসায় নিয়ে আসতে পেরেছি। আমরা বিশ্বাস করি তিনি এই ঘরোয়া পরিবেশে মানসিকভাবে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠবেন। ইনশাল্লাহ তাকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা হবে। আমরা তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি, ওনারা ম্যাডামের সিদ্ধান্তক্রমে ব্যবস্থা নেবেন। তার নিজস্ব চিকিৎসকরা চিকিৎসার বিষয়ে পরামর্শ দেবেন। এ সময় বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাবের মহাসচিব হারুন আল রশিদ বলেন, ওনার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা বলব উনাকে যেন বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি করার হয়। তিনি জানান, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য পাঁচ থেকে ছয় সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাসায় কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন খালেদা জিয়া- ফখরুল ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আপাতত তার নিজ বাসায় হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বুধবার রাতে গুলশানের ফিরোজা ভবনে সদ্য মুক্তি পাওয়া দলের চেয়ারপার্সনের সঙ্গে সাক্ষাত শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা বাসায় এসে তাঁর সঙ্গে (ডাক্তার) আলোচনা করছেন। আপাতত কিছু দিনের জন্য ম্যাডামকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে। ডাক্তাররা এ বিষয়ে আলোচনা করবেন। তার সঙ্গে যাতে কেউ দেখা করতে না পারে সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি।’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তার সঙ্গে কোন রাজনৈতিক আলোচনা করিনি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সবাই তার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। শুকরিয়া আদায় করেছেন যে তিনি বাসায় ফিরেছেন।’
×