ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উদ্বেগে শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ

লকডাউনে কড়া অবস্থানে ভারত

প্রকাশিত: ১০:০৫, ২৬ মার্চ ২০২০

লকডাউনে কড়া অবস্থানে ভারত

করোনাভাইরাস ঠেকাতে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণার পর তা বাস্তবায়নে শক্ত অবস্থান নিয়েছে দিল্লীর কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে সারা ভারতে ২১ দিনের লকডাউন শুরু হয়েছে। ১৩০ কোটি জনতাকে ঘরে রাখতে অবস্থান নিয়েছে সরকার। এদিকে লকডাউনের ফলে রুটি রুজি নিয়ে উদ্বেগের মুখে পড়েছে দেশটি শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ। বিবিসি ও এনডিটিভি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন তিনি ১৩০ কোটি মানুষ পুরোপুরি নিজেদের ঘরবন্দী অবস্থায় রাখবেন। মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে পুরো দেশ লকডাউন, পুরো লকডাউনে থাকবে। ভারতকে বাঁচাতে, তার প্রতিটি নাগরিককে বাঁচাতে তিনি সবাইকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেছেন। দেশের প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি জায়গা লকডাউন করে দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘তবে এই লকডাউন নিয়ে একেবারেই আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ যাতে ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।’ করোনাভাইরাসের মোকাবেলায় ভারতের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে আরও শক্তিশালী করতে তার সরকার ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ভারতে এখন পর্যন্ত ৫৩৬ জন মানুষ আক্রান্ত করোনাভাইরাসে। ইতোমধ্যেই মারা গেছে ১০ জন মানুষ। দেশটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে আরও ৩৭ জন। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যে এই ভাইরাসকে আটকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং পৃথকীকরণের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া একান্ত আবশ্যিক। না হলে এই ভাইরাসটি বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশকে এক মৃতের দেশে পরিণত করে দিতে পারে। লোকজনকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু দেশটির দৈনিক মজুরির ওপর নির্ভরশীল বহু লোকের জন্য এটি কোন বিকল্প নয়। রাজধানী দিল্লীর শহরতলী অঞ্চল নয়ডার লেবার চক কাজের খোঁজে থাকা নির্মাণ শ্রমিকের ভিড় লেগে থাকে, ভবন নির্মাতারা এই জায়গায় এসে শ্রমিক ভাড়া করে নিয়ে যান। কিন্তু জনতা কার্ফু চলাকালে রবিবার সকালে তিনি যখন এই এলাকায় আসেন তখন এলাকাটি ফাঁকা, পুরোপুরি শান্ত, চুপচাপ। শুধু পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে যা এলাকাটিতে কল্পনাও করা যায় না বলে মন্তব্য তার। এদিক ওদিক তাকিয়ে এক কোন কয়েকজন লোককে বিবিসির সাংবাদিক দেখতে পেয়েছে। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে তিনি তাদের জিজ্ঞাস করেন, তারা জনতা কারফিউ মেনে চলছে কিনা। সেখানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বানডা জেলা থেকে কাজের খোঁজে আসা রমেশ কুমার জানান, তাদের ভাড়া নেয়ার জন্য এখানে কেউ নাও আসতে পারেন এটা জানেন তিনি, কিন্তু তারপরও কোন কাজ পাওয়া যায় কিনা দেখতে এসেছেন। রমেশ বলেন, ‘প্রতিদিন আমি ৬শ’ রুপী কামাই করি। ঘরে খাওয়ার লোক পাঁচজন। কয়েকদিনের মধ্যেই ঘরে যে খাবার আছে শেষ হয়ে যাবে। করোনাভাইরাসের ভয় আমারও আছে, কিন্তু আমরা সন্তানরা না খেয়ে আছে, এটি সহ্য করতে পারব না আমি।’ ভারতজুড়ে কোটি কোটি দৈনিক মজুরের এই একই অবস্থা। তিন সপ্তাহ লকডাউন চলার সময় তাদের আয়ের কোন সম্ভাবনা নেই। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এ রকম অনেক পরিবারের মজুদ খাবার শেষ হয়ে যেতে পারে। বুধবার নাগাদ ভারতে করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা ৫০০ জনেরও বেশি এবং মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১০ জনের, এমনটিই জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। উত্তর প্রদেশ, কেরালা ও রাজধানী দিল্লীসহ বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার রমেশের মতো শ্রমিকদের এ্যাকাউন্টে সরাসরি অর্থ পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কেন্দ্রের মোদি সরকারও লকডাউনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দৈনিক মজুরি নির্ভর লোকজনকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এসব অর্থ ও অন্যান্য সহায়তা সঠিক লোকের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে জটিলতা আছে। আইএলও তথ্যানুযায়ী, ভারতের শ্রমিকদের ৯০ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত, যাদের অনেকেই নিরাপত্তা রক্ষী, ক্লিনার, রিকশাচালক, হকার, মেথর ও গৃহকর্মী। তাদের অধিকাংশই পেনশনের আওতায় নেই, অসুস্থতাজনিত ছুটি, সবেতন ছুটি বা কোন ধরনের ইন্স্যুরেন্সও নেই তাদের। অনেকের ব্যাংক এ্যাকাউন্টও নেই, দৈনিক চাহিদা পূরণে নগদ টাকার ওপরই নির্ভর করেন তারা। অনেকেই কাজের খোঁজে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিক। এর অর্থ যে রাজ্যে কাজ করছেন সেই রাজ্যের বাসিন্দা তারা নন। এমন অনেক লোক আছেন যারা সারাবছর ধরে কাজের খোঁজে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে ঘোরেন, জনসংখ্যার ভাসমান এই অংশকে নিয়েও সমস্যা আছে। উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব এগুলোকে অনেক বড় সমস্যা বলে স্বীকার করে নিয়ে বলেন, ‘কোন সরকারের কেউই এর আগে এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়নি।’ ‘পরিস্থিতি প্রতিদিনই পরিবর্তন হতে থাকায় সব সরকারকেই বজ্র্যের মতো দ্রুতগতিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। বড় ধরনের সামাজিক রান্নাঘর চালু করে যাদের দরকার তাদের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়া দরকার। কে কোন রাজ্য থেকে এসেছে তার দিকে না তাকিয়ে হাতে হাতে টাকা অথবা চাল বা গম দেয়া দরকার। ‘সামাজিক সংক্রমণ ঠেকাতে লোকজনের এক শহর থেকে আরেক শহরে যাওয়া বন্ধ করতে হবে আমাদের, আর এটি করার একটি পথ হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সঙ্কটের সময় লোকজন তাদের গ্রামে গিয়ে জড়ো হচ্ছে।’ ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সব ধরনের যাত্রী সেবা স্থগিত করেছে। কিন্তু ২৩ মার্চ এই স্থগিতাদেশ শুরু হওয়ার আগে লাখ লাখ অভিবাসী শ্রমিক প্রাদুর্ভাব কবলিত শহর দিল্লী, মুম্বাই, আহমেদাবাদ ছেড়ে তাদের গ্রামে চলে গেছে। এভাবে করোনাভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণের ঝুঁকি উচ্চমাত্রায় বেড়েছে এবং বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, আগামী দুই সপ্তাহ ভারতের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং হতে যাচ্ছে। তবে সবাই নিজ নিজ গ্রামে চলে যেতে পারেননি। এলাহাবাদ শহরের রিক্সাচলাক কিশান লাল তাদেরই একজন। আগের চারদিন তিনি কোন কামাই করতে পারেননি বলে জানান।
×