ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কুড়িগ্রামের রাজীবপুরে গৃহ নির্মাণে বাণিজ্য ইউএনও’র !

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ২৩ মার্চ ২০২০

কুড়িগ্রামের রাজীবপুরে গৃহ নির্মাণে বাণিজ্য ইউএনও’র !

স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম ॥ কুড়িগ্রামের রাজীবপুরে সরকারের বিশেষ উদ্যোগে গৃহহীনদের জন্য দুর্যোগ সহনীয় গৃহ নির্মাণ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে নীতিমতো বাণিজ্য করার অভিযোগ পাওয়া গেছে ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে। সরকারি অর্থে ১২৪টি পাকা ঘর নির্মাণ করে অর্ধকোটি টাকারও বেশি বাণিজ্য করেছেন বলে জানা গেছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বারদের বাদ দিয়ে একক ভাবে তালিকা তৈরি করে ইউএন নিজেই ঠিকাদারি সেজে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন। পরিষদের সদস্যদের প্রকল্প সভাপতি দেখিয়ে তাদের অজান্তে ঘর নির্মাণের বরাদ্দকৃত অর্থ তুলে নিচ্ছেন ইউএনও নিজেই। ইউএনও মেহেদী হাসান ২০১৮ সালের ৬ মে’ যোগদান করেই রাজীবপুরে একক রাজত্ব শুরু করেন। এলাকার কিছু তাবলীক জামায়াতি বন্ধুদের দিয়ে সরকারি গৃহ নির্মাণ কাজে ব্যবহার করেন। এমনও দেখা গেছে ঘর নির্মাণ করে দেয়ার তালিকায় নাম কিন্তু বাস্তবে ঘর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সরকারের গৃহ নির্মাণ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে ইউএনও অর্ধ কোটি টাকারও বেশি বাণিজ্য করেছেন। দুই মাস আগে গ্রামের বাড়িতে জমি কিনতে সোনালী বাংক রাজীবপুর শাখা থেকে টিটির মাধ্যমে ২০ লাখ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন-এমন তথ্যও ব্যাংক থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। রাজীবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দশটি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম হলো গৃহহীনদের দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ করে দেয়া। এলক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কাবিটা (গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার) ও টিআর (গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষনাবেক্ষন) কর্মসূচীর বিশেষ খাতের অর্থ দিয়ে গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণ করে দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। রাজীবপুর উপজেলার ৩ ইউনিয়নে ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে ৫৫টি ঘর নির্মাণের বরাদ্দ পাওয়া যায়। এতে দুই কক্ষ বিশিষ্ট প্রতিটি ঘর নির্মাণের ব্যয় ধরা হয় ২ লাখ ৫৮ হাজার টাকা যা সম্পন্ন হয়ে গেছে। চলতি ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে আরো ৬৯টি ঘর নির্মাণের বরাদ্দ আসে। এবার প্রতিটি ঘর নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে ২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা করে নির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ৬৯টির মধ্যে ৫০টি নির্মাণ শেষ হয়েছে। সরকারি নির্দেশনা অনুসারে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বারদের মাধ্যমে ঘর গুলো নির্মাণ করে দেয়ার। যে ওয়ার্ডভুক্ত গ্রামে ঘর নির্মাণ করা হবে সেই ওয়ার্ড সদস্যকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ওই প্রকল্পের সভাপতি করারও নির্দেশনা দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বারদের মাধ্যমে গৃহ নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন না করে ইউএনও মেহেদী হাসান নিজেই নেমে পরেন ঠিকাদারি কাজে। যাদেরকে ঘর করে দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে তাদের তালিকাও করেন তিনি একক ভাবে। মজার বিষয় হলো গৃহ নির্মাণ কাজের মিস্ত্রি ও শ্রমিক নিয়ে আসা হয় ইউএনও’র গ্রামের বাড়ির এলাকা থেকে। নি¤œমানের সামগ্রী ব্যবহার ও নি¤œমানের কাজ ঢাকতে এবং অর্থ বাঁচনোর সুবিধার জন্য রাজীবপুরের মিস্ত্রি ও শ্রমিক ব্যবহার করা হয়নি। ইউএনও’র নিজস্ব এলাকা নীলফামারীর ডোমার থেকে মিস্ত্রি শ্রমিক রাজীবপুরে এনে তাদের থাকার ব্যবস্থাও করেন তিনি। নির্মাণ শ্রমিক যার বাড়িতে ঘর নির্মাণ করেছেন মূলত তাকেই খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়েছে মিস্ত্রি শ্রমিকদের। অনেকেই অভিযোগ করেছেন নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের ভাড়াও নেয়া হয়েছে সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে। ইউএনও’র এমন কর্মকান্ড নিয়ে এলাকায় ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। একজন ইউপি চেয়ারম্যান অভিযোগ করে জানান, ইউন ও সাহেব তার নিজস্ব মানুষদিয়ে কাজ করাচ্ছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন বেলাল হোসেন। বরাদ্দ পাওয়া ১শ২৪টি ঘর নির্মাণ কাজের প্রায় সকল সামগ্রী সরবরাহ করেন ওই বেলাল হোসেন। একটা গৃহ নির্মাণ করে ইউএনও যেমন ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা লাভ করছেন তেমনি নি¤œমানের সামগ্রী সরবরাহ করে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হয়েছেন ওই বেলালও। সরেজমিনে খোঁজখবর দেখা গেছে, গৃহ পাওয়ার তালিকা নাম রয়েছে সদর ইউনিয়নের শিবেরডাঙ্গী নয়াপাড়া গ্রামের হাফিজুর রহমান, বালিয়ামারী আদর্শপাড়ার জহুরুল হক, মেম্বারপাড়া গ্রামের রেজিয়া খাতুন, টাঙ্গালিয়া পাড়া গ্রামের সবুরা বেগম, বালিয়ামারী মন্ডল পাড়া গ্রামের ফুল মালা এবং মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের নয়াচর মাস্টার পাড়া গ্রামের আমান আলীর। তালিকায় তাদের বাড়িদে গৃহ নির্মাণও দেখানো হয়েছে কিন্তু তাদের বাড়িতে গিয়ে ওই ঘর পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাকে কেউ কোনো ঘর নির্মাণ করে দেয়নি। তালিকায় আমার নাম রয়েছে এটাও জানতাম না। আপনার কাছেই শুনলাম।’ একই ধরণের কথা বলেন তারা সবাই। অপরদিকে গৃহ নির্মাণে যে নি¤œমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মরিচাকান্দিা গ্রামের হাওয়া খাতুনের ঘর নির্মাণ কাজ শেষ না হতেই বারান্দার ইট সিমেন্ট ধসে পরে। জাউনিয়াচর লম্বাপাড়া গ্রামের অমেলা খাতুন বলেন, ‘ঘর নির্মাণ করে মিস্ত্রিরা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর ইট একাই খসে খসে পরেছিল। পরে তারা মেরামত করে দিয়েছে।’ সদর ইউনিয়নের সদস্য ইসমাইল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ‘৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে সোনালী ব্যাংক থেকে আমার নামের চেকের মাধ্যমে ৮ লাখ ২৭ হাজার টাকা করে দুই চেকে সাড়ে ১৬ লাখ টাকা তুলে নেন বেলাল হোসেন নামের একজন। এমন খবর শোনার পর আমি ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে দেখি ঘটনা সত্য। এটাও জানতে পারলাম ওই টাকা ইউএনও স্যার তার বন্ধুদের দিয়ে তুলে নিয়েছেন। পরে আমি ইউএনও স্যারের কাছে গেলে তিনি আমাকে ধমক দিয়ে হুমকি দেন।’ বাদশা মিয়া ও আবু বক্কর নামের আরও দুই মেম্বার অভিযোগ করে জানান, ১৫ জানুয়ারী তাদের নামের চেকের ৩ লাখ করে ৬ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নেয় ইউএনও স্যার। আব্দুল বারী নামের আরেক সদস্য বলেন, ‘আমার নামে গৃহ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে অথচ আমি কিছুই জানি না। আমার নামের চেকে দিয়ে ১৬ লাখ টাকা সোনালী ব্যাংক তুলে নিয়েছেন বেলাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি।’ এ বিষয় ইউএনও’র কাছে জানতে গেলে তাদেরকে পরিষদের সদস্য থেকে বহিস্কারের হুমকি দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মেম্বাররা। রাজীবপুর সদর ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল আলম বাদল অভিযোগ করে বলেন, ‘প্র্রতিটি ঘর নির্মানে একদিকে নি¤œমানের সামগ্রী ব্যবহার করেছেন অন্য দিকে সিমেন্ট কম ব্যবহার অর্থ বাচিয়ে পকেটে ভরেছেন ইউএনও স্যার। এতে দেখা গেছে প্রতি ঘর নির্মাণ করে দিয়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে বাণিজ্য করা হয়েছে। ঘর নির্মাণে রাজীবপুরের মিস্ত্রি শ্রমিকদের ব্যবহার করলে অনিয়ম ও নি¤œমানের সামগ্রী ব্যবহারের তথ্য ফাঁস হয়ে যেত। একারনে অন্য জেলা থেকে নির্মাণ শ্রমিকদের নিয়ে এসেছেন। পরিপত্রে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বারদের মাধ্যমে ওইসব ঘর নির্মাণ করে দেয়ার। কিন্তু আমাদের ইউএনও স্যার প্রত্যাহার হওয়া ডিসি’র ভয় দেখাতো আমাদের। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজীবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আজিজুর রহমান বলেন, ‘গৃহ নির্মাণ কাজ গুলো ইউএনও স্যার একা করছেন। আমাকে শুধু চেকে স্বাক্ষরের সময় ডেকে নেয়। গৃহ গুলো যাতে ভালো হয় সে কারনে ইউএনও স্যার নিজেই তা করে দিয়েছেন। অনিয়ম, দুর্নীতি বা নি¤œমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে-এসব আমি বলতে পারব না।’ অভিযোগ গুলো নিয়ে জানতে চাইলে ইউএনও মেহেদী হাসান বলেন, ‘চেয়ারম্যান মেম্বারদের ঘর নির্মাণের দায়িত্ব দিলে তারা দুর্নীতি করতেন। যার নামে ঘর দেয়া হতো তার কাছ থেকে অবৈধ ভাবে অর্থ নিতেন। এ কারনে ঘর গুলো আমি এবং আমার নিজস্ব কিছু লোক দ্বারা করে দিয়েছি। আপনারা দেখে কাজের মান খারাব হয়েছে কিনা?’ নি¤œমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের কথা অস্বীকার করে তিনি আরো বলেন, ‘তালিকায় নাম রয়েছে কিন্তু ঘর নেই-এমন কয়েকজনের স্বজনদের বাড়িতে ওই ঘর করে দেয়া হয়েছে। কয়েকটি ঘর ভেঙ্গে পড়ার পর আমি মিস্ত্রিদের সর্তক করে দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাজীবপুরে মিস্ত্রি শ্রমিকরা মজুরি বেশি চাওয়ার কারনে তাদের বাদ দিয়ে আমার এলাকা থেকে মিস্ত্রি শ্রমিক নিয়ে এসেছি-এতে সমস্যা কোথায়।’
×