ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্যাম্পাস লাইফ

স্মৃতির পাতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ১২:১১, ২২ মার্চ ২০২০

স্মৃতির পাতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

জিএ মিল্টন মানব জীবন অসংখ্য ঘটনার সংমিশ্রণে পূর্ণ। মানুষ যখন কোন ঘটনাকে অতিক্রম করে; ঠিক তখনই সেগুলো স্মৃতির পাতায় স্বর্ণাক্ষর হয়ে থাকে। এক একটি ঘটনা এক একটি বার্তা বহন করে। সেসব বার্তা মানুষকে কখনও হাসায় আবার কখনও কাঁদায়। তেমনি একটি স্মৃতি বিশ^বিদ্যালয় জীবন। এখানে দীর্ঘ পাঁচ বছর অতিক্রম করতে হয়। আবার কারও কারও সাত কিংবা আট বছরও পার করতে হয় বিশ^বিদ্যালয়ের একাডেমিক জীবন শেষ করতে। তবে কেউ এমফিল কিংবা পিএইচডি করে থাকে। সেটা ভিন্ন কথা। সাধারণত এই সময়টা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় এই কারণে যে, বহমান নদীর মতোই এ সময় সবার জীবনে যৌবনকাল চলে। যার ফলে কেউ সময়টা কাজে লাগাতে পারে আবার কেউ ব্যর্থ হয়। ক্যাম্পাস জীবনে যারা পড়াশোনার পাশাপাশি কোন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয় তারাই এই জীবনটা ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারে। নিজেকে আরও বেশি সফলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। সে সংগঠন হোক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী কিংবা রাজনৈতিক। ২০১৫ সালের কথা। মাত্র বিশ^বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পা দিয়েছি। জীবনের অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে এ জগতে আসতে পেরে নিজেকে বড় ধন্য মনে হয়েছে। তবে বিশ^বিদ্যালয় ছিল আমাদের বাসা থেকে অনেক দূরের পথ। ফলে একটু খারাপও লাগত, সব সময় বাসায় যেতে পারব না এই ভেবে। কিছু দিনের মধ্যে সেই খারাপ লাগা কেটে যায়; যখন বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। এ বিষয়ে মা একবার আমাকে বলেই ফেললÑ ‘কি রে তোকে ওখানে ভাল লাগে? একা একা, কেউ নাই, কেমন করে থাকিস?’ তখন একটু হাসিই পেল। বললামÑ ‘মা, ওখানে শুধু আমাদের পরিবারের কেউ নাই। তা ছাড়া আমার বন্ধু-বান্ধবী, শিক্ষক, বড় ভাই সবাই আছে। খারাপ তো লাগার কথা না। বরঞ্চ থাকতে বেশ ভালই লাগে।’ বিশ^বিদ্যালয়ে প্রবেশের আগে থেকে লেখালেখি করার প্রবল ইচ্ছা ছিল। অবশ্য তা পূরণও হয়েছে বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে। সেখানে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা করতাম। সে সুবাদে অনেক সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। যার মধ্যে সুজন আলী হুট করে সবাইকে ফোন দিয়ে বলতÑ ‘আজ রাতে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াব, তোরা সন্ধ্যার পরই ক্যাম্পাসে চলে আসিস।’ যেই কথা সেই কাজ। আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে এক জোট হয়ে রাতের ক্যাম্পাস দেখতাম। শুধু বন্ধুরাই নয় আমাদের সঙ্গে ছিল বান্ধবীরাও। যারা সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত অবধি আমাদের সঙ্গে ঘুরত। জনমানব শূন্য রাতের ক্যাম্পাসে হাঁটতে অসম্ভব সুন্দর লাগত। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় অনেকের কণ্ঠ দিয়ে গানের সুর বেরিয়ে আসত। তবে কণ্ঠ সুন্দর হোক আর না হোক সবাই এক সঙ্গে গান গাইতাম সেই আড্ডায়। বন্ধুদের অনেকেই আবার ভাল গানও গাইতে পারত। বিশ^বিদ্যালয়ের প্যারিস রোড, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে, মেয়েদের আবাসিক হলের সামনে দিয়ে রাত দশটার পর হাঁটতে কি যে ভাল লাগত। নিজে না হাঁটলে তা কখনও অনুভব করাই যাবে না। লিখে প্রকাশ করা তো দূরের কথা। এ ছাড়াও বিকেল বেলা হলেই কয়েক বন্ধু মিলে ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার, ফোকলোর চত্বর, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পেছনে, শিরাজী ভবনের সামনেসহ বিভিন্ন জায়গায় চলত আড্ডা। কিছু না থাকলে অন্তত চা তো থাকবেই। চায়ে চুমু দিতে দিতে চলত কথার তুবরি। ক্যাম্পাসের প্রথম দিকে সবার একটু ঝোক থাকত ভাল কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার। তাই আড্ডাতে এমন কথাই থাকত বেশি। একজন একটু শুরু করে দিলে আর যেন কারও তর সইত না। একজনের মুখ থেকে আরেকজন, এভাবে চলতে থাকত কথার ছড়াছড়ি। কার কি অবস্থা, কে এখনও সম্পর্কে জড়ায়নি, বা কে কতটা সম্পর্ক করছে প্রভৃতি বিষয় আসত সেখানে। আবার আড্ডায় বন্ধুদের অনেকেই বলত, ‘তোরা তো অনেক বড় জায়গায় যাবি, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবি, তোদের আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না। যাই হোক, জীবনকে এখন থেকে তৈরি করে নে, চাকরি না পেলে কেউ কারও নয়।’ এমন হাজারো কথা উঠে আসত আড্ডা থেকে। এভাবে প্রতিনিয়ত চলত ঘোরাফেরা, আড্ডা, গান ও কথার ছড়াছড়ি। যাক সে সব কথা। প্রায় দেড় বছর পর বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক হলে উঠলাম। হল জীবন আরও মধুর ও স্মৃতির। একই হলে বন্ধুদের সঙ্গে থাকা, আবার সকাল হলেই তাদের সঙ্গে ক্লাসে দৌড়ানো। চোখ মুছতে মুছতে ক্লাসে গেছি এ রকম অনেক ঘটনা আছে। কারণ সে সময় সকাল ৮টার ক্লাস ছিল। গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা ও আড্ডার মধ্য দিয়ে কেটে যেত। ফলে সকালে উঠতে একটু দেরি হতো। তা ছাড়া ছুটি পেলেই বন্ধুরা মিলে চড়–ইভাতির আয়োজন হতো। তবে সে সিদ্ধান্ত কিন্তু হুট করেই হতো। হলে খুব কাছের বন্ধু ছিল সোহেল রানা, বায়েজিদ খান। মাঝে মধ্যেই বায়েজিদ বলত, ‘এই, আজ রাতে একটা খাবার হয়ে যাক।’ যেই কথা সেই কাজ। ঠিক আছে, ‘তুই সোহেল, আর দু-একজনকে বল; তারা যদি থাকে তো বেশ ভালই জমবে।’ আয়োজনে বেশ মজাদার সব রান্না হতো। রান্না শেষে খাওয়া-দাওয়া, গানের আসর বসত। আমি বেশ রান্না করতে পারতাম। অনেক সময় বান্ধবীদের সঙ্গেও খাবারের আয়োজন করা হতো। এ বিষয়ে বান্ধবীদের অনেকের মুখে অবাক হয়ে রান্নার প্রশংসা শুনেছি- ‘ছেলেদের রান্না এত সুন্দর হয়! আগে তো জানতাম না। কেমন করে রান্না করিস তুই, তোর সে (বউ) খুব আরামে থাকবে রে’ প্রভৃতি কথা বলত তারা।’ ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার জন্যই হোক আর অভ্যাসই হোক আমার সবাই খুব ভাল বন্ধু ছিল। মনে হতো সবাই আমার খুব কাছের বন্ধু। এ জন্য আবার আমাকে অনেকেই অনেক কথা শুনিয়েছে। একজনের সঙ্গে ঘুরলে আরেকজন অভিমান করত। তবে নিজেকে খুব সামলে নেয়ারও ক্ষমতা ছিল আমার। অনেকেই অনেক ভাবে ব্যবহার খারাপ করতে চেষ্টা করতো। তবে খুব ঠা-া মাথায়, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতাম। আবার সাংবাদিকতার কারণেই নিজ বিভাগের শিক্ষকরা অত্যন্ত কাছের মানুষ হয়েছিল। কারণে-অকারণে তাঁদের কাছে যেতাম। তাঁদের সঙ্গে কথা বললেই যেন অন্যরকম তৃপ্তি পাওয়া যায়। শুধু মনে হতো শিক্ষকরা ছাত্রদের এত কাছের হতে পারে। ছুটির দিন ছাড়াও যেকোন সময় তাদের বসার কক্ষে যাওয়া যেত। তাঁরাও অত্যন্ত আপন মনে করে সমস্যার কথা শুনত, সমাধানের চেষ্টা করত। সে হোক পড়াশোনা কিংবা ব্যক্তিগত। এ ছাড়াও ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার সুবাদে অনেকের সঙ্গে শত্রুতার সৃষ্টি হয়েছে আবার বেশিরভাগ মানুষের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করতে পেরেছিলাম; যা আমার আর কোন বন্ধু করতে পারেনি। মনে মনে ভাবতাম- এই সফলতার সবটুকুই সম্ভব হয়েছে, যার হাত ধরে আমার সাংবাদিকতার হাতে খড়ি। দীর্ঘ পাঁচ বছর সেখানে সাংবাদিকতা করেছিলাম। ক্যাম্পাসের প্রতিটি কণায় আমার পদচারণা। যেন হাজার বছরের সম্পর্ক সেই সব মানুষদের সঙ্গে। বিশেষ করে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের অত্যন্ত কাছের মানুষ হতে পেরেছিলাম। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই না কেন মতিহারের এই সবুজ চত্বরকে মন থেকে কখনই ভুলতে পারব না। কিছু মানুষের সঙ্গে শত্রুতা থাকলেও ভালবাসার হাজারো মানুষ এখানে দিনাতিপাত করে। ভাল থাকুক মতিহারের এই ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের মানুষগুলো।
×