ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রদীপ দা ছিলেন আমার পিতৃতুল্য ॥ বাইচুং

প্রকাশিত: ১১:৫৭, ২২ মার্চ ২০২০

প্রদীপ দা ছিলেন আমার পিতৃতুল্য ॥ বাইচুং

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ আমার কাছে তিনি ছিলেন বাবার মতো। মাঠের মধ্যে নয়, বাইরেও। মাঝেমধ্যেই আমাদের ফোন করে তার বাড়িতে ডাকতেন এবং রাতে খাওয়াতেন। তার স্ত্রী দারুণ রান্না করতে পারতেন। বিশ্বের অনেক কোচের অধীনে খেলেছি। কিন্তু প্রদীপ দার মতো ম্যান ম্যানেজমেন্ট করতে কাউকে দেখিনি। তিনি এই কাজে সব থেকে পারদর্শী ছিলেন। একজন খেলোয়াড়কে মাঠে এবং মাঠের বাইরে ঠিক কী বলতে হবে সেটা উনি জানতেন। এটা ওর কাছে খুব স্বাভাবিক কাজ ছিল। আবারও বলছি, প্রদীপ দার চলে যাওয়া অপূরণীয় ক্ষতি। কথাগুলো বলেছেন ভারতের সাবেক অধিনায়ক, দক্ষিণ এশিয়ান অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার বাইচুং ভুটিয়া। তিনি দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার এবং কোচ। দেশের জার্সিতে ১৯৫৫ সালে অভিষেক হয়েছিল তার। তারপর চোট ব্যতীত একটানা, ধারাবাহিকতার সঙ্গে ভারতের হয়ে খেলেছেন তিনি। ৮৬ ম্যাচে করেছেন ৬৫ গোল। দেশের হয়ে মারডেকা কাপ খেলেছেন ১৯৫৯, ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালে। দেশের হয়ে এশিয়ান গেমস খেলেছেন ১৯৫৮, ৬২ ও ৬৬ সালে। এছাড়া ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে এশিয়া কাপেও খেলেছেন তিনি। ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। দেশের হয়ে সবচেয়ে বড় সাফল্য ১৯৬২ সালে জাকার্তা এশিয়াডে সোনা জয়। দীর্ঘ ১২ বছর আন্তর্জাতিক ফুটবলে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। ক্লাব ফুটবলে ইস্টার্ন রেলের হয়ে আজীবন খেলে গেছেন। ফুটবল ছাড়ার পর কোচিংয়ে চলে আসেন তিনি। ১৯৭২ সালে ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব নেন তিনি। এরপর কোচিংয়ের সংজ্ঞাটাই পাল্টে দেন। ভারতীয় ফুটবলে ভোকাল টনিক চালু করেন। তার মতো ফুটবলারদের উদ্দীপ্ত আর কোন কোচ করতে পারেননি। ১৯৭২ সালে পি কের কোচিংয়ে ইস্টবেঙ্গল ত্রিমুকুট জেতে। ১৯৭৩ সালে পাঁচটি ট্রফি জেতে ইস্টবেঙ্গল পি কের কোচিংয়ে। ৭৫ সালে ইস্টবেঙ্গল টানা ষষ্ঠবার কলকাতা লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় পি কের কোচিংয়ে। শিল্ড ফাইনালের ডার্বিতে পি কের কোচিংয়ে সেবারই ইস্টবেঙ্গল ৫০ ব্যবধানে হারায় মোহনবাগানকে। কোচ হিসেবে ইস্টবেঙ্গলকে ২৮টি ট্রফি দিয়েছেন তিনি। ১৯৭৭ সালে মোহনবাগানের কোচ হয়ে আসেন পি কে। ৭৭ সালে মোহনবাগানকেও ত্রিমুকুট এনে দেন। সে বছরই পেলের কসমসের বিরুদ্ধে খেলতে নামে পি কের মোহনবাগান। যা আজও ইতিহাস হয়ে আছে। তারপরেও একাধিকবার মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের কোচের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ১৯৯৭ সালে ডায়মন্ড ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলকে ৪১ জেতান পি কে। ১৯৯১ থেকে ৯৭ পর্যন্ত টাটা ফুটবল একাডেমির টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে ফিফার ‘প্লেয়ার অব দ্য মিলেনিয়াম’ স্বীকৃতি পান তিনি। ‘অর্জুন’, ‘পদ্মশ্রী’ ছাড়াও মোহনবাগানরতœ সম্মান পেয়েছেন পি কে। পি কে ব্যানার্জির চলে যাওয়া ভারতীয় ফুটবলের পক্ষে বড় ক্ষতি। প্রদীপ দা শুধু কিংবদন্তি ফুটবলারই ছিলেন না, কিংবদন্তি কোচও ছিলেন। ওর কোচিংয়ে কিছু দুরন্ত মুহূর্তের সাক্ষী ছিলাম, যা সারাজীবন মনে থাকবে। কবে এবং কখন ওর সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল তা মনে পড়ছে না। কিন্তু ওর কোচিংয়ে খেলতে পেরে আমি ভাগ্যবান। নিঃসন্দেহে ইস্টবেঙ্গলে ওর অধীনে খেলা সব থেকে স্মরণীয় ম্যাচ হয়ে থাকবে ১৯৯৭ ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনাল। ওই ম্যাচটা নিয়ে প্রচণ্ড উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। অমলদা (দত্ত) চাপে ছিলেন। সে কারণেই অপ্রত্যাশিত কিছু মন্তব্য করে ম্যাচের আগে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিশেষত আমাকে এবং স্যামি ওমোলোকে নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু আমরা তাতে একটুও প্রভাবিত হইনি। তার একটা বড় কারণ প্রদীপ দার ঠাণ্ডা মাথা। কোচ হিসেবে উনি শান্ত থাকতেন বলে খেলোয়াড়রাও বেশি ভয় পেত না। ম্যাচেও সেটার প্রভাব দেখা গিয়েছিল। এভাবেই খেলোয়াড়দের মধ্যে থেকে সেরাটা বের করে আনতে পারতেন তিনি। আমার জীবনের সব থেকে বড় ম্যাচ ওটাই।
×