ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা প্রতিরোধে চিকিৎসকদের ১৭ পরামর্শ

আক্রান্ত হওয়া মানেই অবধারিত মৃত্যু নয়

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ২২ মার্চ ২০২০

আক্রান্ত হওয়া মানেই অবধারিত মৃত্যু নয়

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বিশ^জুড়ে মহামারী আকারে ছড়িয়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১১ হাজারের বেশি। মোট মৃত্যুর বেশিরভাগ বয়স্ক হলেও গোটা বিশে^র তরুণদের জন্য নতুন করে সতর্ক বার্তা জারি করেছে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা। শনিবার প্রাণঘাতী এ রোগে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২৪। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয়েছে দুই জনের নাম। করোনা সন্দেহে বিনা চিকিৎসার মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। এই প্রেক্ষাপটে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ১৭টি পরামর্শ দিয়েছেন দেশের খ্যাতনামা চিকিৎসকরা। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে চিকিৎসা সহায়ক কমিটি যা ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনস্বার্থে প্রচার চালাচ্ছেন। তাছাড়া নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে করোনা সচেতনতায় ১০ লাখ প্রচারপত্রসহ সারাদেশে ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) বলেন, গোটা বিশ^ এখন করোনা আতঙ্কে। আমাদের দেশেও এ রোগের আতঙ্ক ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। আতঙ্কিত হলে মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। তাই এখন প্রয়োজন প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সবাই একটু সচেতন হয়ে চললে আশা করি করোনা প্রতিরোধ করা অনেকটাই সম্ভব হবে। তিনি বলেন, এরকম চিন্তা থেকেই আমরা সবাইকে সচেতন করতে পরামর্শ দিচ্ছি। আশা করি সবাই তা মেনে চলবেন। ১২ জন বিশিষ্ট চিকিৎসকের স্বাক্ষরিত প্রচারপত্রে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি কোভিড-১৯কে প্যানডেমিক ঘোষণা করেছে। তবে এটি সাম্প্রতিক সময় প্রথম প্যানডেমিক নয়। ইতোপূর্বেও আমরা সোয়াইন ফ্লু, সার্স এবং মার্স-এর মতো প্যানডেমিক সফলভাবে মোকাবেলা করেছি। মনে রাখতে হবে প্যানডেমিক মানেই এই নয় যে কোভিড-১৯ নামের এই ভাইরাসটি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে কিংবা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া মানেই মৃত্যু অবধারিত। বরং এটি ভাইরাসটির ভৌগোলিক বিস্তারের স্বীকৃতি মাত্র। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মতো বাংলাদেশেও এখন কোভিড-১৯ ছড়াচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে সামনের দিনগুলোতে আরও কেউ কেউ এই রোগে আক্রান্ত হবেন। এখন প্রয়োজন সতর্কতার। আতঙ্কিত না হয়ে সাধারণ কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে আমরা নিজেরা যেমন কোভিড-১৯ মুক্ত থাকতে পারব, তেমনি ভাল রাখতে পারব আমাদের আশপাশের মানুষগুলোকে আর আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে জানুন, সচেতন হন, সুস্থ থাকুন এবং সুস্থ রাখুন শিরোনামে প্রয়োজনীয় ১৭ সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, নিজের এবং নিজের চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখুন। যেখানে সেখানে থুথু ফেলা থেকে বিরত থাকুন। সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশির জন্য অযথা দুুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে হাসপাতালে ভিড় না বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র দীর্ঘমেয়াদী অথবা বাড়াবাড়ি রকমের লক্ষণ দেখা দিলেই সরকার নির্ধারিত হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করুন করার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া শুধু সর্দি-কাশি থাকলে ফেস মাস্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, ফেস মাস্ক ব্যবহার করা কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী এবং চিকিৎসাসেবা প্রদানকারীদের জন্য জরুরী- সবার জন্য নয়। পাশাপাশি অপ্রয়োজনে গণপরিবহণ যেমন বাস, ট্রেন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে ডাঃ বলেছেন, দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ থেকে বিরত থাকার কোন বিকল্প নেই। সামাজিক মেলামেশার সময় হাত মেলানো ও কোলা-কুলি করা পরিহার করার পরামর্শ দিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজের নাকে-মুখে হাত দেয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলার পাশাপাশি হাঁচি-কাশির সময় কনুই এবং কাঁধের মাঝামাঝি অংশ দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়া জরুরী। প্রয়োজনে টিস্যু ব্যবহার করে এবং ব্যবহৃত টিস্যু নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিতে হবে। মাছ, মাংস বা ডিম ভালভাবে রান্না করে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ডাক্তাররা বলছেন, অন্যের ব্যবহার করা তোয়ালে, কাপড় ইত্যাদি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কমপক্ষে বিশ সেকেন্ড সাবান দিয়ে বার বার, ভালভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাস করা জরুরী তবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক নয়। এছাড়া আপনি যদি চীন, ইতালি, স্পেন, ইরান বা অন্য কোন দেশ থেকে সম্প্রতি দেশে ফিরে থাকেন তাহলে ১৪ দিন স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, এই ১৪টি দিন বাসায় একটি নির্দিষ্ট ঘরে থাকুন, কোন কারণেই ঘরের বাইরে বের হবেন না। এ সময় আপনার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কেউ আপনার সংস্পর্শে আসতে পারবেন না। হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা অবস্থায় আপনার থালা-বাসন, কাপড়-চোপড়, বিছানার চাদর-তোয়ালে ইত্যাদি অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবেন না। কোয়ারেন্টাইনে থাকার সময় বই পড়ে, গান শুনে বা অন্য কোন বিনোদনমূলক কাজের মধ্যে দিয়ে সময় কাটান। কোন পশু-পাখি সঙ্গে না রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। মরণঘাতী করোনা থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে দশ জনের বেশি মানুষ এক সঙ্গে জমায়েত না করার পরামর্শ দিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, কোন স্থানে জমায়েত হলে পরস্পরের মধ্যে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের অন্য কোন অসুস্থতা যেমন হাঁপানি, ডায়াবেটিস বা হার্টের অসুখ আছে তাদের ঝুঁকি বেশি। করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে কোন ধরনের গুজব না ছড়ানোর পরামর্শ দিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভাইরাস নিয়ে গুজবে বিশ্বাসও করবেন না। যে কোন পরামর্শের জন্য কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে যোগাযোগ করার কথা বলছেন তারা। পরামর্শ দিয়ে বিশিষ্ট চিকিৎসকদের মধ্যে রয়েছেন, অধ্যাপক ডাঃ কামরুজ্জামান, অধ্যাপক ডাঃ আমজাদ হোসেন, অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান, অধ্যাপক ডাঃ কনক কান্তি বড়ুয়া, ডাঃ শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর, অধ্যাপক ডাঃ সজল কৃষ্ণ ব্যানার্জী, অধ্যাপক ডাঃ শাহিন আখতার, অধ্যাপক ডাঃ বরেন চক্রবর্তী, অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়া, অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল), অধ্যাপক ডাঃ মোঃ মাহবুবুর রহমান (বাবু) ও ডাঃ নুজহাত চৌধুরী। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে শনিবার বিকেলে জানানো হয়েছে, এখন পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৫০ জন, হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন ১৪ হাজার। ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি শেখ হাসিনা বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য আরও ৪০০ আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করা হবে। চিকিৎসকদের জন্য পার্সোনাল প্রোটেকশন ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই), মাস্ক কয়েক লাখ এসেছে। রোগ মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। ইতালির ক্যাগলিয়ারি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক সারা ডি ম্যাত্তিস বলেন, বায়ুদূষণের কারণে অনেক রোগীর ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে খারাপ থাকে। ওই রোগীদের ক্ষেত্রে ফুসফুস সংক্রমণের মতো সমস্যা মোকাবেলা করা সহজ হয় না। ফলে তাদের মৃত্যু হয়। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। বায়ুদূষণের মাত্রা কমিয়ে আমরা করোনায় আক্রান্তদের মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে পারি। এতে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য মহামারী মোকাবেলা করতে সুবিধা হবে। সার্স করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণাকারী বিজ্ঞানীদের মতে, বায়ুদূষণ এলাকায় বসবাসকারী সার্সে আক্রান্ত ব্যক্তির তুলনায় কম দূষণ এলাকার আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যু হার কম। ২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ধূমপায়ীদের মধ্যে সহজেই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। হার্ভার্ড টিএইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষক এ্যারন বার্নস্টেইন ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ধূমপায়ীরা করোনাভাইরাসে অধিক আক্রান্ত হচ্ছেন। যারা পরিচ্ছন্ন বায়ুর মধ্যে বাস করেন এবং ধূমপান করেন না, তারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও দ্রুত আরোগ্য লাভ করছেন। চীনে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসার কারণ জরুরী অবস্থার মধ্যে গোটা দেশে বন্ধ থাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক কমে যায়। বাতাসে ক্ষতিকর কণার মাত্রা ২৫ শতাংশ কমে গেছে। গাড়ি বন্ধ থাকায় নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের মতো ক্ষতিকর গ্যাস উৎপাদন কম হচ্ছে। ফলে চীনে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসছে। করোনাভাইরাসের পরোক্ষ প্রভাব এখনও অজানা। করোনার কারণে কল-কারখানা, গাড়ি বন্ধ থাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা কমেছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এতে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। কারণ করোনায় আক্রান্ত হওয়ার হার কমার সঙ্গে সঙ্গে আবারও বন্ধ কল-কারখানা চালু হতে শুরু করবে। তখন যে আবারও করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাবে না তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
×