ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

বঙ্গবন্ধু- জানুয়ারি থেকে মার্চের জয়রথে

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ২২ মার্চ ২০২০

বঙ্গবন্ধু- জানুয়ারি থেকে মার্চের জয়রথে

(তৃতীয় ও শেষ পর্ব) মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্ন উপস্থিত হয়। সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় পেয়ে খোদ দলের মধ্যেই অভূতপূর্ব উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় নেতারা দফায় দফায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হতে থাকেন ও সম্ভাব্য করণীয় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য, অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে জনসাধারণ বিশেষত সর্বস্তরের সরকারী-বেসরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের দেশব্যাপী আশু করণীয় বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রায় প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়ে ওঠে ও কোথাও কোথাও সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হয়। একদিকে প্রশাসন, অপরদিকে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর করণীয় নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশনার প্রয়োজন হলে বঙ্গবন্ধু সে সকল বিষয়ের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন ও ১৪ মার্চ ১৯৭১ তারিখে একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচী ও নির্দেশনা প্রদান করেন যা পরেরদিন (১৫ মার্চ) সকল দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়। এর আগে, ১১ মার্চ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ দেশের অর্থনীতি সমুন্নত রাখতে একটি বিবৃতি দেন যাতে তিনি সুস্পষ্ট উল্লেখ করেন, আমাদের আন্দোলন একটি অভূতপূর্ব উচ্চ মাত্রায় পৌঁছাতে পেরেছে কারণ দেশের প্রতিটি মানুষ নিজেদের কর্তব্যকাজে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনাগুলো মেনে চলছেন। সর্বস্তরে আন্দোলিত মানুষের মধ্যে প্রখর দায়িত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে যা আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণামূলক। আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশের উৎপাদন অর্থনীতি সমুন্নত রাখতে সর্বশক্তি নিয়োজিত রাখতে হবে’ (সূত্র : দ্য ডন, ১১ মার্চ ১৯৭১)। এই বিবৃতিতে তাজউদ্দীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যাংকগুলো খোলা রাখা ও লেনদেন মাত্রা, সময়সূচী সম্পর্কে কিছুটা প্রশাসনিক পরিবর্তনের কথাও জানান। এই বিবৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন যথাযথ সময়ে পরিশোধের বিষয়ে; যেখানে তিনি বলেন কেবলমাত্র সম্পর্কিত কর্মচারী ও কর্মকর্তাগণই বেতন পরিশোধের কাজে অফিসে আসবেন ও কর্তব্য পালন করবেন। জেলখানা, জেল ওয়ার্ডেন ও জেল অফিস যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করবে। বিদ্যুত ও পানি সরবরাহে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত দফতরগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে। এমনকি সব বীমা কোম্পানিগুলোও যথাযথভাবে কাজ করবে। ১১ মার্চের নির্দেশনা ছিল মূলত আন্দোলনের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেন কোনভাবেই স্থবির না হয়ে পড়ে ও জনসাধারণের দৈনন্দিন চাহিদায় যেন কোথাও ঘাটতি পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। দলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর এসব নির্দেশনা সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন সকল মহলে পৌঁছাবার ব্যবস্থা করেন যার ফলে আন্দোলন ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে ও পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মনে এই আন্দোলনের প্রতি গভীর আস্থা জন্মায়। ১৪ মার্চ করাচীর এক জনসভায় পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ‘দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে’ ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দেন (সূত্র : দৈনিক পাকিস্তান, ১৫ মার্চ ১৯৭১)। নরম সুরে ভুট্টো বলেন, ‘দেশের দুইটি সংখ্যাগুরু দল জাতীয় স্বার্থে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে, পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণ সেটাই কামনা করে। ভুট্টো বলেন, আওয়ামী লীগ প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য তিনি এখনও পূর্ব পাকিস্তানে যেতে রাজি আছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু দল বলেই তিনি তার দলের সঙ্গে কথা বলার জন্য শেখ মুজিবের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। বর্তমান সঙ্কট সমাধানের জন্য তাদের এক সঙ্গে চলার সময় এখনও রয়েছে।’ ভুট্টোর এই চতুর ভাষণে একটি বিষয় স্পষ্ট যে ৭ মার্চের দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মূল বক্তব্যের প্রতি ভুট্টো কোন প্রকার গুরুত্ব না দিয়ে তার নিজের অংশে তার দলের সংখ্যাগরিষ্ঠের অজুহাত ক্রমাগত দিতেই থাকেন। অথচ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে ইতোমধ্যে আসন তৈরি করে নিয়েছে। বাংলাদেশের তখনকার ভূখ-ে যেসব দমনপীড়ন, অত্যাচার ও রক্তপাত ঘটে চলছিল ভুট্টো সেসব প্রসঙ্গ একেবারেই এড়িয়ে চলেছেন যেন তিনি কিছুই জানেন না এমনভাবে করাচীর সভায় বক্তব্য রেখেছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার দাবিদার হলেও পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের প্রতি অন্যায়-অবিচারের প্রতি ভুট্টো কখনওই সোচ্চার হননি। ফলে পাকিস্তান সামরিক চক্র ভুট্টোকেই তাদের অন্যতম সমর্থক ও প্রেরণাদাতা হিসেবে গণ্য করে তাদের অন্যায়ের মাত্রা ক্রমশ বাড়াতেই থাকে। সঙ্গত কারণেই ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু একটি পূর্ণাঙ্গ ঘোষণাপত্র জারি করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না যেখানে প্রকৃতই তিনি গণমানুষের প্রাণের নেতা হিসেবে দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করেন। শুরুতেই তিনি বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের প্রতিটি নারী-পুরুষ এমন কি শিশু পর্যন্ত মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহসে বলীয়ান। নগ্নভাবে শক্তি প্রয়োগ করে মানুষকে দলিত করার কথা চিন্তা করেছিল যারা, তাঁরা নিশ্চিতই পরাভূত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরের মানুষ সরকারী কর্মচারী, অফিস আর কলকারখানার শ্রমিক, কৃষক আর ছাত্র সবাই দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছেÑ তাঁরা আত্মসমর্পণের চেয়ে মরণ-বরণ করতেই বদ্ধপরিকর। এই বিবৃতি বঙ্গবন্ধুর মার্চ আন্দোলন জীবনের সেরা বিবৃতি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে যেখানে তিনি মোট ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন। পটভূমিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘এ বড় দুঃখজনক যে, এমন পর্যায়েও কিছু অবিবেচক মানুষ সামরিক আইন বলে নির্দেশ জারি করে বেসামরিক কর্মচারীদের একাংশকে ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ এদেশের মানুষ সামরিক আইনের কাছে মাথা নত না করার দৃঢ়তায় একাট্টা। আমি তাই, সর্বশেষ নির্দেশ যাদের প্রতি জারি করা হয়েছে, তাঁদের হুমকির কাছে মাথা নত না করার আবেদন জানাই। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের পেছনে রয়েছে। তাঁদের ত্রাসিত করার উদ্দেশ্যে এই যে চেষ্টা তা বাংলাদেশের মানুষকে রক্তচক্ষু দেখার অন্যান্য সাম্প্রতিক চেষ্টার মতো নস্যাৎ হতে বাধ্য।’ এখানে উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু এই বিবৃতির মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জাতিকে দল ও মত নির্বিশেষে একটি বিষয়ে আওতাভুক্ত করেছিলেন আর তা হলো সমগ্র জাতিই নিপীড়িত মানুষের ও তাঁদের পরিবারবর্গের পেছনে আছে। বিশ্বের খুব কম নেতাই এমন দুর্দিনে দেশের সব মানুষকে একে অপরের পাশে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ১৫ মার্চের দেয়া বঙ্গবন্ধুর নতুন কর্মসূচী নির্দেশাবলী আকারে জারি করা হয়। উল্লেখ করা হয় যে, ‘নির্দেশাবলী কার্যকরী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব ঘোষিত সকল নির্দেশ, অব্যাহতি ও ব্যাখ্যাসমূহ বাতিল বলে বিবেচিত হবে।’ নতুন কর্মসূচীকে ১নং নির্দেশ, ২নং নির্দেশ এইভাবে ৩৫নং নির্দেশ পর্যন্ত ভাগ করে অনেকটা পরিপত্র বা সার্কুলার আকারে জারি করা হয়। পৃথিবীর মুক্তিকামী দেশগুলোর রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসে এই রকমের নির্দেশনামা জারি করে কোন নেতা দেশের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তার দৃষ্টান্ত বিরল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পরিপত্রে প্রথমেই ঠাঁই পায় সরকারী সংস্থাসমূহের করণীয় যেখানে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েটসমূহ, সরকারী ও বেসরকারী অফিসসমূহ, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানসমূহ, হাইকোর্ট এবং বাংলাদেশের সকল কোর্ট হরতাল পালন করবেন। ২য় নির্দেশে তিনি বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দেন। ৩য় নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ডিসি ও এসডিওদের অফিস না খুলে নিজেদের এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনের কথা বলেন। পুলিশের সঙ্গে প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে যোগ দিতে পরামর্শ দেন। বলা হয় জেল অফিস খোলা থাকবে ও আনসার বাহিনী তাঁদের দায়িত্ব পালন করবে। ৪র্থ নির্দেশে অভ্যন্তরীণ বন্দরগুলো পরিচালনার নির্দেশনায় উল্লেখ করেন খাদ্য সাহায্য বা মাল খালাসের নিয়মিত কাজ অব্যাহত থাকলেও সৈন্য ও সমরাস্ত্র আনা-নেয়ার কাজে বন্দর ব্যবহার করা যাবে না। ৫ম নির্দেশে আমদানি শুল্ক পরিচালনার জন্য বলা হয় ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন লিমিটেড ও ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের বিশেষ এ্যাকাউন্ট খুলে কাস্টমস কালেক্টরগণ যেন সেগুলো পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগের নির্দেশ অনুযায়ী সেসব এ্যাকাউন্টে কাস্টমস কালেক্টরগণ আদায়কৃত শুল্ক জমা রাখবেন, কোন মতেই তা কেন্দ্রীয় সরকারের নামে জমা হবে না। একে একে নির্দেশে বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে, সড়ক পরিবহন, পোস্ট অফিস-টেলিগ্রাম-মনি অর্ডার, স্থানীয় ও আন্তঃজেলা ট্রাংক টেলিফোন পরিচালনার নির্দেশ দেন। ১১নং নির্দেশে সুস্পষ্ট নির্দেশে বলেন, ‘বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলো কাজ চালিয়ে যাবেন। তাঁরা গণআন্দোলন সম্পর্কিত সকল বক্তব্য, বিবৃতি, সংবাদ ইত্যাদি প্রচার করবেন। যদি না করেন তবে এই সব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা সহযোগিতা করবেন না।’ পরবর্তী নির্দেশগুলোতে হাসপাতাল, বিদ্যুত, গ্যাস-পানি, ইট ও কয়লা সরবরাহ, ধান-বীজ-সার ও কীটপতঙ্গ নাশক ওষুধ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে ঘোষণা দেন। পাওয়ার পাম্প, সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন ও নির্মাণ কার্য, সাহায্য পুনর্বাসন, যাবতীয় কলকারখানা, বেতন ও পেনশন প্রদান, ব্যাংকিং সময়, ট্রাভেল এজেন্ট, ফায়ার ব্রিগেড, পৌরসভা এমন কি কর আদায় পর্যন্ত নিয়মের মধ্যে বেঁধে দেন। ৩৪নং নির্দেশে তিনি আদেশ দেন, ‘সকল বাড়ির শীর্ষে কাল পতাকা উত্তোলিত হবে।’ সর্বশেষ ২৫নং নির্দেশে বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম পরিষদগুলোকে এ সকল নির্দেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়নের কথা বলেন। জগতের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ যখন কোন দেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের একাডেমিক বিশ্লেষণ করেন জানি না তাঁদের মনে কোন ধারণা আছে কী না বাংলাদেশের জাতির পিতা হয়ে ওঠা এই রাজনীতিবিদ মুক্তিসংগ্রামের অনবদ্য এক দায়িত্বশীল ইতিহাস রচনা করেছেন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম তিন সপ্তাহেই। তাঁদের সেই বিশ্লেষণে যাই-ই বেরিয়ে আসুক, বাংলাদেশের মানুষের গৌরবগাথা অস্বীকার করে কোন বই বা তত্ত্ব রচনা কোনদিনও সম্ভব হবে না। কারণ বঙ্গবন্ধুর মতো এমন দূরদর্শী নেতৃত্ব সংগ্রামের স্বপ্নগাথায় বোনা যে দেশ তার ঠাঁই হয়ে আছে মহাকালের স্বপ্নগৌরব ছুঁয়েই। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা [email protected]
×