ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

মুজিববর্ষ ॥ এই দিন নিয়ে যাবে সেই দিনের কাছে

প্রকাশিত: ০৮:১১, ২১ মার্চ ২০২০

মুজিববর্ষ ॥ এই দিন নিয়ে যাবে  সেই দিনের কাছে

মানুষ স্বভাবজাতভাবে কল্পনাবিলাসী। কল্পনাবিলাসী মানুষই আগামীর স্বপ্ন দেখে। এগিয়ে যায় গৌরবের সিঁড়ি বেয়ে। অবশ্য স্বপ্ন, কল্পনা এসব হাওয়া থেকে উড়ে আসে না। একটা মজবুত ভিতের প্রয়োজন পড়ে। এবং সেই ভিতটি রচনা করে দিয়ে গেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী আমাদের জাতিরাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়ে তারই কন্যা সমসাময়িক বিশ্বের সবচেয়ে সফল সাহসী রাষ্ট্রনেতা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে এমন এক স্বপ্নের সিঁড়িতে তুলে এনেছেন যেখান থেকে আমরা কল্পনার রথ শূন্যে উড়াতে পারি। এই শতবর্ষ থেকে আগামীর শতবর্ষে। এই মুজিববর্ষ থেকে আগামীর শত মুজিববর্ষে। এই দিন নিয়ে যাবে সেই দিনের কাছে। যদিও আমাদের সামনে বড় ধরনের বিপর্যয়। কেবল আমাদের নয়, বিশ্বব্যাপী তাবৎ জনগোষ্ঠীর প্রতিটি জনপদ আক্রান্ত। সাত শতাধিক কোটি মানুষের (শিশুদের বাদ দিয়ে) একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না যার মধ্যে করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক নেই। বাংলাদেশে এই করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি যেমন অপেক্ষাকৃত বেশি তেমনি আমাদের একটা সুবিধা আছে- আমরা যা পাই তা খাই না। আমরা সাপ-বিচ্চু, কাক-বাদুড় খাই না। আমরা কাঁচা মাছ-মাংস খাই না। এদিক থেকে আমরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও বড় ঝুঁকির ব্যাপার হলো আমাদের প্রায় এক কোটি লোক বাইরের পৃথিবীতে কাজ করে। বিশেষ করে ভাইরাসটি যেসব দেশে বেশি বেশি সংক্রমণ হয়েছে সেসব দেশে কর্মরত আমাদের লোকরা এরই মধ্যে ব্যাপক হারে দেশে ফিরেছে। যে যেভাবে পারছে ফিরে আসছে। সবচেয়ে ঝুঁকির ব্যাপার হলো, বেশিরভাগ ফিরে আসা প্রবাসী কোয়ারেন্টাইন মানে না। এমনকি হোম কোয়ারেন্টাইনও না। তারা বাড়িতে যেয়েই আপনজনের সঙ্গে কোলাকুলি, হাতে হাত মেলানো কাজগুলো করতে থাকে। শোনা গেল কেউ কেউ দেশে ফিরেই পরিবার-পরিজন নিয়ে কক্সবাজার- সেন্টমার্টিন বেড়াতে গেছিল। পরে অবশ্য ফেরত এসেছে বা আসতে শুরু করেছে। শ্বশুরবাড়ি, বোনের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে গুরুজনদের সঙ্গে কোলাকুলি, হাত মেলানো বা পায়ে হাত দিয়ে সালাম করছে যা মোটেই উচিত নয়। কারণ, এই ভাইরাস অদৃশ্য বা বিমূর্ত। এটি আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্যের শরীরে খুব দ্রুত সংক্রমিত হয়। কাজেই যেকোনো বিদেশ ফেরত ব্যক্তির দেশে ফিরে বিমানবন্দরে বা সরকারের নির্ধারিত পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা করিয়ে ১৫ দিন কোয়ারেন্টাইনে কাটিয়ে তবেই বাড়ি যাওয়া উচিত। বাড়ি গিয়েও স্ব নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন করতে হবে। এ ভাইরাসের এখনও টিকা আবিষ্কার হয়নি। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ডাক্তারদের ঝুঁকি কম নয়। তাদেরও তো জীবন আছে। তার ওপর যেটি লক্ষণীয় তা হলো বাজার। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া কিংবা হাতে দেবার জন্য স্যানিটাইজারও দুর্লভ হবার ব্যাপার রয়েছে। মানুষের দুর্দশার সুযোগ নিয়ে ব্যবসা করার অর্থাৎ টু-পাইস কামানোর লোকের তো অভাব নেই। কাল যে পিঁয়াজের দাম ছিল ৫৫ টাকা আজ তা ৮০ টাকা। কোন কারণ নেই, যুক্তি নেই। কেউ মরল না বাজারে আকাল পড়ল কিচ্ছু আসে-যায় না, পকেট ভরলেই হলো। বৃহস্পতিবার আমার নির্বাচনী এলাকা ২৬৩ চাঁদপুর-৪ ফরিদঞ্জের জনগণ, রাজনৈতিক কর্মী এবং প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলি। অবস্থা যা-ই হোক এলাকার মানুষের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি তথা এমপি হিসেবে আমাকে তো এটুকু করতেই হবে। মানুষের কাছে যেতে হয়। তাই গিয়েছিলাম। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মত বিনিময়ে যে আহ্বানটি করেছি তা হলো এই মুহূর্তে একজন রাজনৈতিক কর্মীর সবচেয়ে বড় কাজ হলো করোনাভাইরাস, এর সংক্রমণ, ভয়াবহতা সম্পর্কে জানা এবং নিজে সতর্ক থাকার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশী বা অন্যদের সতর্ক করা এবং স্ব নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করা। আমার মনে হয়, এ মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় রাজনীতি। মনে রাখতে হবে আমরা বাঙালীরা এমন একজন রাষ্ট্রনেতা পেয়েছি যিনি সব কিছু খেয়াল রাখেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেন এবং প্রতিরোধের সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কতগুলো ব্যাপার আছে যেগুলো আপনার, আমার একান্তভাবে ঘরের ব্যাপার, একান্তভাবে নিজস্ব, সেসব তো আর প্রধানমন্ত্রী ঘরে ঘরে গিয়ে সামাল দিতে পারবেন না, দেবেন না। নিজের জিনিস নিজেকেই সামলে দিতে হবে। দলীয় কর্মীদের, নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়টির ওপরই বেশি জোর দিয়েছি। প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারলাম, এরই মধ্যে প্রচুর প্রবাসী ঘরে ফিরেছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করাই এখন বড় কাজ। অফিসাররা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ ফেরতাদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, তাদের সতর্ক করার চেষ্টা করছেন। তুলনামূলকভাবে বেশি সংখ্যক ফরিদগঞ্জের মানুষ দেশের বাইরে থাকে। এর কারণ থানাটি সবচেয়ে ঘনবসতি এলাকা, চাষের জমি কম তাই ফরিদগঞ্জের মানুষের দুটি পথ থাকে- ১) লেখাপড়া শিখে দেশে চাকরি করা, ২) বিদেশে জব তালাশ করা। শেষোক্ত গ্রুপই মেজরিটি। এবার বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে দলে দলে দেশে ফিরতে শুরু করে। প্রশাসনের কাজ বেড়ে যায়। ফরিদগঞ্জের থানা হেলথ কমপ্লেক্সটিও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ডাক্তার এবং হেলথ প্রশাসনের দুর্ভাবনা রয়েছে। শুরু করেছিলাম এই মুজিববর্ষ থেকে আগামীর মুজিববর্ষ তথা আগামী শতবর্ষে আমাদের স্বপ্ন নিয়ে। কেননা, রাব্বুল আলামিনের কৃপায় একদিন করোনার আতঙ্ক কেটে যাবে। বিপদ আসে বিপদ চলেও যায়। সে কারণেই আমাদের যেমন একদিকে বিপদ মোকাবেলা করতে হয় তেমনি স্বপ্নের সিঁড়িতে হাঁটাও বন্ধ করা যাবে না। কালো আফ্রিকার মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন “Long way to go before we sleep”. আমাদেরও আরও অনেকদূর যাবার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছেন মহান রাষ্ট্রনেতা শেখ হাসিনা। আগামী ১০০ বছরের ডেল্টা প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। ১০০ বছর পর কি হবে, আমরা মানে আমাদের উত্তর প্রজন্ম কোথায় যাব, কতটুকু অর্জন করব ডেল্টা প্রকল্পে তা রয়েছে। ধাপে ধাপে এগোতে এগোতে আমরা আগামী ১০০ বছরে পৌঁছে যাব। আমরা যেমন অতীতের ৩০২ মেগাওয়াট থেকে বিদ্যুত উৎপাদন মাত্র এক দশকের মাথায় ২৪০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছি, তেমনি ৫.৫% মূল্যস্ফীতি ধরে রেখে জিডিপি ৮.১৫%, মাথাপিছু আয় ২০০০ ইউএস ডলার, গড় আয়ু ৭৩ বছর, খাদ্যশস্য উৎপাদন চার কোটি টনের ওপরে উঠিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ইত্যাদি অর্জন করতে পেরেছি। তেমনি খুনী এবং তাদের সহযোগীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জাতির পিতা হত্যার বিচার করতে পেরেছেন, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পেরেছেন, দেশকে পাপমুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এখন আর আমাদের ভয় নেই, আমাদের কেবল এগিয়ে যাবার সময়। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ উদ্যাপনে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১০১ সদস্যের জাতীয় উদ্যাপন কমিটি এবং জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয় এবং উভয় কমিটিতে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন সদস্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী (কবি ও সাবেক সিনিয়র সচিব)। ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ১৭ মার্চ ২০২১ এই এক বছরব্যাপী নানান কর্মসূচীর মাধ্যমে মুজিববর্ষ শুরু করার প্রস্তুতি ছিল। বিশেষ করে তেজগাঁও প্যারেড গ্রাউন্ডে লক্ষ জনতার সমাবেশের কথা ছিল। এমনিভাবে আনন্দ শোভাযাত্রা প্রভৃতি বড় বড় কর্মসূচী নেয়া হয়েছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ছোট বোন শেখ রেহানা করোনাভাইরাস সংক্রমণ জনিত কারণে সকল বড় বড় কর্মসূচী স্থগিত করেন। সঙ্কট কেটে গেলে তখন দেখা যাবে কি করা যাবে। কিংবা ২০২১ সালের ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি তথা সুবর্ণজয়ন্তী। তখন পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে মুজিববর্ষ এবং সুবর্ণজয়ন্তী একসঙ্গে উদ্যাপন করা যেতে পারে। কেননা আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, স্বাধীনতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একইসূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামে দেশ প্রতিষ্ঠা হতো না। ১০০ বছর আগে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া শেখ বাড়িতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়েছিল বলেই আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি, যা ছিল বাঙালী জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন সাধ। বস্তুত মুজিববর্ষ ছিল আত্ম-আবিষ্কারের কর্মসূচী। এক বছর বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে আমরা যেমন জাতির পিতাকে জানব তেমনি কিভাবে আমাদের স্বাধীনতা এলো, আমি কে, এই বিষয়ে আমরা নিজেদের আবিষ্কার করব। বড় কর্মসূচী স্থগিত করা হলেও দেশব্যাপী মানুষের মাঝে যে অভূতপূর্ব সাড়া পড়েছে, যে আত্ম-উপলব্ধি এসেছে তা আগামী ১০০ বছর বাঙালী জাতিকে পথ দেখাবে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাব। ঢাকা- ২০ মার্চ ২০২০ লেখক : এমপি, সদস্য- মুজিববর্ষ উদ্যাপন জাতীয় কমিটি, সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×