ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুটি গল্প ॥ রামেলা

প্রকাশিত: ১২:৩২, ২০ মার্চ ২০২০

দুটি গল্প ॥ রামেলা

লাল গরুটার বাছুর হয়েছে। কয়েক দণ্ড মাত্র উঠোনে বসেছিলো। তারপর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা। একবার, দু’বার। হাঁটু ভেঙে পড়ে যায়। পড়ে গিয়েও হাল ছাড়ে না। মা তার গা চেটে দিয়ে উৎসাহ দেয়। চারপায়ে দাঁড়ালো সে। তারপর দিলো লেজ তুলে দৌড়। ফিরে এসে মায়ের উলানে মাথা দিয়ে দুটো গুঁতো দিয়ে দুধ খেতে শুরু করে। রামেলা লাল গরুটার গলায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, কি রে রঙিলা! কি নাম রাখবি তোর ছেলের? না আমি ভাল দেখে একটা রেখে দিবো! রামেলার নাম রেখেছিলো রামেলার মা। পর পর চার মেয়ে বলে বাবা তার মুখ দেখেনি অনেকদিন। পরে রামেলা বাবাকে ভুলিয়েছে। অনেক আদরের মেয়ে হয়ে উঠলো সে বাবার কাছে। বাবা তাকে কাছ ছাড়া করতো না। ‘রামেলা’ নামের মানে সে জানে না। বাবাকে জিগ্যেস করেছিলো। বাবাও জানে না। মাকে জিগ্যেস করা হয়নি। রামেলার যখন জিগ্যেস করার মতো বয়স হয়েছে তার অনেক আগে এক অজানা রোগে মারা গেছে মা। রামেলা নামে আর কেউ নেই আশে পাশের দশ গ্রামে। রামেলার মতো সুন্দর মুখের এরকম মেয়েও নেই দশ গ্রামে। তার পিঠোপিঠি বড় বোনের বিয়ের ছয় মাসের মাথায় রামেলার বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলে বাকড়া স্কুলের হেডমাস্টারের পরিচিত। সে বাংলার মাস্টার। কলেজের পড়া শেষ করে এই স্কুলের মাস্টার হয়ে এসেছে। ছুটির দিন। দহলিজ ঘরে রামেলার বাবার সঙ্গে কথা হচ্ছিলো হেডমাস্টারের। হেড মাস্টার বললো, তোমার মেয়ের সঙ্গে খুব ভাল মানাবে। ছেলে যেমন ভাল, তেমনি ভদ্র। বিশ বছর ধরে মাস্টারি করি। ছাত্র চড়ায়ে খায়। দু’একটা কথা বলে মানুষ চিনতে পারি। যাবার সময় বললো, মেয়ের মতো নাও! মেয়েকে তো সারাজীবন ঘরে রাখতে পারবে না। চিন্তা-ভাবনা করো। তাড়াহুড়ো নেই। জানায়ো সময়মতো! রামেলার বাবার পাঁচ-ছয় কাঠার মতো জমি আছে। স্কুলের কাছে। এই জায়গাটুকু রামেলার বাবা বাংলার মাস্টার আজিজুলকে বুঝিয়ে দেয়। বলে, আমাকে বাবা মনে করো। এই জমিতে ঘর তুলো নিজের মত করে। আর আমার রামেলারে দেখে রেখ! ঘর তুলে দু’জনে। বাকি জায়গাতে সবজি লাগালো। হাঁস-মুরগির ঘর তুললো। লাল গরু আর ছাগলগুলোর জন্য একটা ঘর হলো। স্কুলের মাঠে সরকারী টিউবওয়েল থেকে খাবার পানি আনতে হয়। বাড়ির ভেতর রান্না ঘরের পাশে একটা টিউবওয়েল বসিয়ে দিয়েছে আজিজুল। গোসলের জায়গাটা ঘিরে দিয়েছে। পাড়ার মানুষেরা পানি নিতে আসে। আর গল্প করে যায় রামেলার সঙ্গে। দেখে যায় তার পুতুলের মতো সাজানো সংসার। স্কুলের কাজে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে আজিজুলের। তার বাংলা বাদে অন্য সাবজেক্টের ক্লাস নিতে হয়। যারা পড়াশোনায় কাঁচা, তাদের জন্য আলাদা ক্লাস নেয়। স্কুলটা অনেক ভাল করছে। স্কুল ইন্সপেক্টর তার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেছে। জানতে চেয়েছে তার পড়ানোর টেকনিক। যে স্কুলে তিনি যান উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করান আজিজুলকে। রামেলার কোলে ফুটফুটে সুন্দর একটা ছেলে এসেছে। তার মুখটা দেখলে যেমন মায়া হয়, তেমনি ভরে যায় বুক। কাজের ফাঁকে এসে যায় বার বার। আজিজুল বাড়িতে ফিরলে রামেলা খুব অভিমান করে বলে, কি পাষাণ বাপ আপনি! ছেলেটার মুখ এতক্ষণ না দেখে কিভাবে থাকেন? আজিজুল বোঝায় রামেলাকে। বলে, তুমি আছো! তাইতো নিশ্চিন্তে স্কুলের কাজ সাড়তে পারি। এতোটুকু কথায় খুব খুশী হয়ে যায় রামেলা। ঘরের মেঝেয় পাটি পেতে ভাত বেড়ে দেয়। আজিজুল হাত রাখে রামেলার হাতে। বলে, আমি নিব! তুমিও খেয়ে নাও! কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বলে। পাখার বাতাসে ল্যাম্পের শিখা দুলে দুলে ওঠে। রামেলার ছেলেটা বড় হয়। কথা বলতে শিখেছে। মজার মজার কথা বলে। খুব বুদ্ধিমানের মতো কথা বলে। রামেলা তার কথা শুনে আর হাসে। নিজে তাকে বাংলা ও ইংরেজী বর্ণমালা শেখায়। অক্ষর শেখায়। খুব তাড়াতাড়ি সবকিছু ধরতে পারে। আগ্রহ ভীষণ পড়াশোনায়। আজ বেশি রাত করে বাসায় ফিরলো আজিজুল। রামেলা বলে, আজ এতো রাত করে ফিরলেন! ভাত-তরকারি সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গরম করে আনি। ছেলেটা ঘুমালো আপনার কথা বলতে বলতে। আজিজুল বলে, একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। চিন্তা করবে তাই বলিনি। শুনো! গলার স্বর নিচু করে বলে, দেশের অবস্থা ভালো না। পাকিস্তানীরা আমাদের ওপর বন্দুক কামান নিয়ে হামলা শুরু করেছে। আমরাও বসে নেই। মিটিং করেছি। বাহিনী গড়েছি। এদিকে এলে পাকিস্তানী সৈন্যরা এলে গেরিলা কায়দায় জবাব দিব আমরা! এসব কথা শুনে যেন বাজ পড়লো রামেলার মাথায়। অনেক দেরিতে রামেলার ঘুম এলো সেই রাতে। গ্রামের কয়েকটা লোক আর খাকী পোশাক পরা রাইফেল কাঁধে সেনারা আজিজুলকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। রামেলা ভয়ে চিৎকার করেছে। গায়ের লোকদের ডাকছে। কেউ এগিয়ে আসছে না। আসবে কি করে। কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না তার গলা থেকে। কিন্তু মনে হচ্ছে গলা ফেটে রক্ত হবে। তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। খোকা ঘরে। খুঁজতে থাকে খোকাকে। খোকা নেই। তার শাড়িতে আগুন লেগে গেছে। দাউ দাউ করে উপরের দিকে উঠছে। ঘুম ভাঙে রামেলার। সূর্যের আলো জানলা দিয়ে তার চোয়ালে এসে পড়েছে। চোয়ালে হাত দেয়। রোদের তাপে তার চোয়াল গরম হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী টের পেয়েছে এই দিকে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছে। কয়েকটা গেরিলা অপারেশন করেছে তারা। তাতেই দিশাহারা তারা। গ্রামের কিছু লোকজন দিয়ে শান্তিবাহিনী করেছে। সুরুজ মিয়া এদের নেতা। ঘরে তার দুই বউ। তারপরেও রামেলাকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিলো তার বাবার কাছে। রামেলার বাবা রাজি হয়নি। গেরিলা খুঁজতে বের হয়েছে পাকিস্তানী বাহিনী। তাদেরকে বুক উঁচু করে পথ দেখাচ্ছে সুরুজ মিয়া ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা। ফজরের নামাজ পড়ে আজিজুল আবার শুয়ে পড়েছিলো। সেদিন ছিলো ছুটির দিন। স্কুল নেই। উঠোনে সুরুজ মিয়াদের চিৎকারে ঘুম ভাঙে তার। ওঠে পড়ে আজিজুল। উঠে রামেলা ধরমড় করে। জেগে যায় খোকা। ভয়ে কেঁদে ফেলে। সুরুজ মিয়া চিৎকার করতে থাকে, মাস্টার বাইরে আসো! মেজর সাহেব আসছে। তোমার সাথে কথা বলবে। তাকে টেনে হিচড়ে উঠোনে বের করে আনে। একজন সিপাই রাইফেলের বাট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে। রক্তে সারা শরীর ভিজতে থাকে। ভিজে যায় সাদা গেঞ্জি। মেজর রাগী গলায় জিগ্যেশ করে, তোমার সঙ্গে আর কে কে মুক্তি আছে নাম বলো! আজিজুল কারুর নাম বলেনি। পিস্তল ধরা তারা কপালে। মেজর বললো, গোয়াড় টাইপের লোক আমার পছন্দ না। সে গুনলো, এক...দুই...তিন... রামেলা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে স্বামীকে। আজিজুলের শরীরের ভার রামেলার উপর। রামেলা ভিজে যাচ্ছে গরম রক্তে। রামেলাকে দেখে মেজরের চোখ লালসায় ভরে ওঠে। বললো, মেয়েটাকে গাড়িতে তুলো। আর সব জ্বালিয়ে দাও। রামেলাকে টানতে টানতে জীপে তুলে। মায়ের পা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে খোকা। ছাড়বে না কিছুইতেই। মেজরের বুটের লাথি সহ্য করতে পারলো না রামেলার ছেলেটা। বাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। উঠে দাঁড়িয়ে সে ছুটতে থাকে। ধুলো উড়িয়ে মেঠো পথে জীপ ছুটছে। ধুলোর জন্য মাকে আর দেখতে পাচ্ছে না খোকা। ফুফায়ে কাঁদছে সে। তার চোখ জলে ভরে ঝাপসা হতে গেছে। তবুও সে ছুটতে থাকে লাল গরুর বাছুরটার মতো।
×