সৃজনশীল নতুন নতুন চিন্তার ধারক যেখানে কবি সেখানে সেই সব চিন্তার প্রবল বেগবান প্রকাশ তার রচিত কাব্য। ফলে কবিকে অতীত আত্মস্থ করে, বর্তমানে জারিত হয়ে, গঠনমূলক ভবিষ্যৎকে মনোঃচক্ষে অনুধাবন করেই কাব্য রচনা করতে হয় এবং সেভাবে করেন কোন কোন কবি। তখন কবি যেন চেতনার ধারক হয়ে বরফ সদৃশ্য হিমালয় আর তার কাব্য ঝরনা-নদী-সাগর হয়ে চৈতন্যের প্রবহমান প্রকাশ। তেমনই কাব্য প্রকাশ দেখা গেল এবারের অমর একুশে বই মেলায়, ঐতিহ্য প্রকাশন থেকে প্রকাশিত, ধ্রুব এষের প্রচ্ছদিত, জীবনানন্দ দাশের কাব্য রচনা রীতির উত্তরাধিকার আমাদের কবি আসাদুল ইসলাম রচিত কাব্য গ্রন্থ ‘সাদা কালো হৃদয়ের ঘাসগুলো’ পড়তে পড়তে। বর্তমান সময়ে করোনা ভাইরাসের নির্মমাঘাতে বিশ্ববাসীর মনোভূমি যখন জ্বলে পুড়ে তছনছ তখন কত ইঙ্গিতবাহী হয়ে ওঠে আসাদুল ইসলামের ডেঙ্গু কেন্দ্রিক রচিত কবিতা,
কখন ডেঙ্গু আসবে সেই ভয়ে
দরজা জানালা বন্ধ করে ঢুকে গেছি
লোহার বাসরে
ঘরে ঘরে পৌরনিক পাতা থেকে উঠে আসা লখিন্দর
আধমরা শুয়ে আছে
চিন্তার কফিনের পাশে
মৃত্যুভয়ে শেকড় জুড়ে বয়ে যাচ্ছে শংখনদী [ ডেঙ্গু ]
শংখ নদী যদি দূষিত হয় চিন্তা রূপ ব্যাধির আবর্জনায়, তবে তার শুশ্রুষা করবার মতো পথ্য বেশির ভাগটা সময় কমই দেখতে পাওয়া যায়। ফলে জীবাণুর কারণে বাতাস দূষণের মতো হিংসা, বিদ্বেষ, হ্রেষাহ্রেষির চক্করে পড়ে সমাজ বাস্তবতার দূষণ ঘটে যায় দৃশ্য-অদৃশ্যের অন্তরালে বিশ্বায়নের সমান্তরালে যে কারণে কবি লিখলেন,
দ্রুত বদলে যাচ্ছে সমাজের ধীর স্থির মন
চিন্তার মানচিত্র
অস্থিরতার দৃশ্য স্থির হবার আগেই
নতুন দৃশ্যে অস্থিরতা
বরগুনার নয়ন বন্ড বা
ওয়াশিংটন নিয়ে টন টন ব্যথা কেরানির কাতায়
কুপিয়ে যাচ্ছে প্রকাশ্য রাজপথে দুপুরের সূর্য্য [শেষ দীর্ঘশ্বাসের যৌবন ]
সূর্য্যরে আলোকের মতো পরিষ্কার একটি মানুষ কোথায় জন্মেছে এবং সেখানকার আলো-বাতাস-মাটির রসে পুষ্ট হয়ে কেমনে এবং কিভাবে বেড়ে উঠেছে। তথাপি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে কিংবা গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায়ের বিভাজনের দাবানলে পুড়তে থাকা মানুষকে হয় কাগজ দেখিয়ে প্রমাণ দিতে হয় ভূখ-ের অংশীদারিত্বের, নয়তো হয়ে যেতে হয় স্বভূমে উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তু কারণ তার মেলেনি চরিত্রের সনদ তথা নাগরিকত্বের সনদ। আর তাই কবি আসাদুল ইসলামের রচিত কবিতা হয়ে ওঠে এই সব দল ছুটদের স্বগোতক্তি বিলাপগাঁথা,
পৃথিবীর আনন্দ খুঁজে চলেছি
কোন ঠিকানা জানি না আমার বসবাসের
আমি ভবঘুরে বাউল
তবু কণ্ঠ শুষ্ক রেখে নতুন শুল্কের জন্য
নিজেকে ফিরিয়ে আনি
নিজের নির্মিত শ্রেণিচরিত্রে
যেখানে আমার চরিত্র খুঁজে পাই না
সেখানে আমি জন্মাবধি চরিত্রহীন [ চরিত্রহীন ]
চরিত্রবান কিংবা চরিত্রবতীদের যারা অস্তিত্ব শূন্য করে দিলো তাদের মনরস্তাত্ত্বিক চক্রান্তের মানচিত্র কত অদ্ভুত ভাবে ফুটে ওঠে কবির রচনায়,
মিথ্যাকে সত্য বানাবার গল্পে
কিছু করুন রসের প্রয়োজন হয় বলেই তো
জীবন অস্থির সুন্দর [ মিথ্যাবাদী সত্য ]
অস্থির সুন্দর আর স্থির বেদনার দোলাচলে দোদুল্যমান ভোক্তা-বিক্রেতা, শোষিত-শোষক, অনুরাগী-কবি আর সেকারনে দুই কবিতায় দুই শ্রেণীর মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে ফেরা।
কবিত্বের শক্তিতে,
এই যে বদলে যাচ্ছি খুব
প্রতিদিন একটু একটু করে বিবর্তন শেষে
এখন নিজেই অচেনা নিজের আয়নায়
কার মুখ দেখি
কে দাঁড়িয়ে আছে আমার রূপ ধরে
হাড়মাংসের অবিকল প্রতিমূূর্তি নিয়ে আমরাই মুখোমুখি
তবু আমি নই [ চুপচুপ পাপ ]
আমি নই কিন্তু তুমি কি তাই! এই যে কৌতূহল নিরন্তন জাগিয়ে রাখা, অবিরত জানতে চাওয়া, গন্তব্য খুঁজে ফেরা এটাই কবির কাব্য সাধনা, আর এই সাধনা আছে বলেই কবি আসাদুল ইসলামের ‘সাদা কালো হৃদয়ের ঘাষ গুলো’ কাব্য গ্রন্থ নিয়ে কবিতার বই মোট বেড়ে হলো নয়টি। অসমীয় অনুবাদে একটি। কবি সত্তার পাশাপাশি নাট্যকাব্য সত্তায় নাটকের বই তিনটি। কবি আসাদুল ইসলাম চিন্তার প্রবাহ কাব্যের ভাষায় নিরবচ্ছিন্নভাবে করে চলেছেন মানুষের কথা মানুষের সামনে বলবেন বলে। এটি তার সাধনা, এটি তার সত্যের অন্বেষণে নিরন্তন পথ খোঁজা।