ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ১২:২৯, ২০ মার্চ ২০২০

প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধু

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু-উপাখ্যানের প্রথম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটার এক বছর পর, গ্রন্থকারের ভাষ্যমতে, প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধু গ্রন্থটির আন-অফিসিয়াল জন্ম। তারপর দীর্ঘ ৩১ বছর পরে খসড়া এবং তারও ৫ বছর পর প্রায় পরিণত প্রকাশ। সেই হিসেবে অন্তত ৪ দশককালের চিন্তা, গবেষণা আর সৃজনভাবনার ফলাফল প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধু (দ্বিতীয় সংস্করণ : ডিসেম্বর ২০১২) গ্রন্থটি। প্রখর-চেতন বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের কল্পনা-পরিকল্পনা, জীবনদর্শন, তাঁর শক্তিমত্তা, মানবিকতা, জাতীয়তাবোধ, জনসম্পৃক্তি, জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য স্বপ্ন ও যন্ত্রণা, জেল-জীবন, অসভ্যতার বিরুদ্ধে সভ্যতার আলোকশিখা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়, তাঁর প্রতি আপামর জনতার অপরিসীম ভালবাসা, কারামুক্তিÑ এসব বিষয় বর্তমান কাব্যনাট্যে সাজিয়েছেন মোস্তফা তোফায়েল (জন্ম : কুড়িগ্রাম, ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪)। একজন শিক্ষক ক্লাসরুমে পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের চিন্তার স্তর-উন্নয়ন ও পরিবর্তনে সহায়তা করবেনÑ এটাই প্রত্যাশিত। সেই কারণেই শিক্ষক বন্ধু, পথ-প্রদর্শক, অভিভাবক এবং দার্শনিক। মোস্তফার সৌভাগ্য যে তিনি রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্য অধ্যয়নের সময় প্রফেসর আলী আনোয়ারের উষ্ণ সান্নিধ্য ও সহমর্মিতা লাভ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু-বিষয়ক বিশালাকৃতির এই কাব্য-পরিকল্পনার কথা- একাত্তরে বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধ বিশ^ব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেই মুক্তিযুদ্ধের বিশাল অভিঘাত এবং এর নায়কের উত্থান ও নিধনের ঘটনা ইতিহাসে অনেক বড় দাগ হয়ে আছে। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র সমালোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে ধরনের প্লটের কথা বলেছেন, অবশেষে তাই পাওয়া গেল। অতএব, একটি প্রয়াস, মহাকাব্য রচনার। ১৯৭৬-এ আমার শিক্ষক প্রফেসর আলী আনোয়ার এ-পরামর্শই আমাকে দিয়েছিলেন, যা এখন বাস্তবে রূপ নিল। (‘দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা’) ‘মহাকাব্য’ এখন অনেকটাই প্রতীকী-ফর্ম। প্লট বা কাহিনির বিস্তৃতির বিশালতা, ইতিহাস-ঐতিহ্যের নান্দনিক রূপায়ণ, চিন্তার বিকাশ, জাতীয়তাবোধের বহির্প্রকাশ, চরিত্র কিংবা কোন ঘটনার মহত্ব প্রভৃতি নানান বিষয় উপন্যাসে, নাটকে, কাব্যে রূপলাভ করলে, তাকে মহাকাব্যিক বলতে শোনা যায়। যদিও বিশেষ করে রসের বিবেচনায়, পৌরাণিক প্রসঙ্গের বিবেচনায় এখন মহাকাব্য লেখার প্রাসঙ্গিকতা প্রায় নেই বললেই চলে। যাই হোক, প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধু গ্রন্থটিকে নাটকের আদলে কবিতা লেখার প্রয়াস বলেই মনে হয়েছে, প্রাথমিকভাবে। অতঃপর, পাঠের ভেতরে প্রবেশ করে, কাঠামো ও প্রকাশ-কৌশলের বিচারে এর নিবিড় পর্যবেক্ষণ হতে পারে। প্রসঙ্গত, মনে রাখা দরকারÑ মধ্যযুগের কবি, দুঃখ-বন্দনার ভাষ্যকার মুকুন্দরাম চক্রবর্তী সম্পর্কে প্রচলিত আছে যে, তিনি একালে জন্মগ্রহণ করলে ঔপন্যাসিক হতে পারতেন। কিন্তু, বাস্তবতা হলো, তখন উপন্যাসের প্রসঙ্গ ও প্রয়োজন দেখা দেয়নি। তেমনই, বর্তমানে মহাকাব্যের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, তা-ও ভেবে দেখা আবশ্যক। প্রচলিত মহাকাব্যের কিংবা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগের সাধারণ কাব্যের কাঠামোর মতো বন্দনা বা প্রণতি দেখা যায় মোস্তফা তোফায়েলের কাব্যনাট্যে। তিনি লিখছেন- তোমারই কল্পপ্রতিমা মূর্ত হয়ে আমি লেখনী ধারণ করি, বসি কেদারায় গভীর নিবিষ্টচিত্তে। কাব্য শুরুর আগে তিনি ঐহিত্যিক দেশ-বন্দনাও করতে ভোলেননি। লিখেছেন বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনা আর সৌন্দর্যের কথাও। দেশের প্রতি, জাতির প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা আছে ‘আবাহন’ শিরোনামের এই বন্দনাগীতিতে। খানিকটা পাঠ নেয়া যেতে পারেÑ ধন্য আমি বাংলার দীপ্ত যুবক, যৌবন গৌরবে উজ্জীবিত প্রাণ; দেখেছি মুক্তির যুদ্ধ, রক্তভরা নদী, উৎসর্গে উত্তাল, বীরত্বে বিশাল। ১০টি সর্গে বিভক্ত এই বিশাল কাব্যনাট্যে কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নি-বীণা, মুনীর চৌধুরীর কবর, সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় বইগুলোর পরিবেশন-কৌশল প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয়। হাজার বছরের বাঙালী জাতির বিকাশ ও পরিবর্তনের যে ধারা বাংলা সাহিত্যে প্রতিফলিত, সেই অভিযাত্রায় মোস্তফা তোফায়েল নিশ্চয়ই একটা স্পষ্ট চিহ্ন বহন করবেন বর্তমান গ্রন্থটির জন্য। অন্তত, বঙ্গবন্ধুর প্রাণের যে মহত্ব, ত্যাগের যে অনন্যতা, তা কবি চিন্তা ও কল্পনার সুতোয় সাজিয়েছেন যে পরম মায়ায়, তার জন্য হলেও তিনি প্রাসঙ্গিক হবেন। গাঙেয় এই বাংলার অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জনধারার উদ্ভবের ইতিহাস থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর পুত্র রাসেল পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধুর কাহিনীর ক্যানভাস। যুগ যুগ ধরে বাংলার জনপদে যে নৃ-তাত্ত্বিক বিবর্তন, তার ভেতর থেকে নাট্যকার খুঁজে বের করেছেন বাঙালীর স্বাধীনচেতা বৈশিষ্ট্য, নেতার জননেতা হিসেবে আবির্ভাবের পরিপ্রেক্ষিত এবং জন-আকাক্সক্ষার স্বপ্নভঙ্গÑ সবকিছুতে তিনি জুড়ে দিয়েছেন চেতনার বীজ ও বেদনা। জীবনের করুণতা আর বাঙালীর বীরত্বের ইতিহাসে যেটুকু ব্যর্থতা, যেটুকু অপরিপক্কতা, যেটুকু ভাগ্যহীনতা, তার জন্য এই কাহিনীকারের মমতা আছে। সত্য-অন্বেষার দিকে তাঁর যে দৃষ্টি প্রসারিত, তার সারকথা হলোÑ হাহাকার। পুত্রশোকে কাতর রাবণের প্রতিচ্ছবি এই গ্রন্থে আশা করা কঠিন। কেননা, বীরবাহু ও মেঘনাদের হত্যার সঙ্গে রাসেলের হত্যা-ঘটনার বৈশাদৃশ্য রয়েছে। মেঘনাদবধ কাব্যে যে-যুদ্ধের পটভূমি ও রূপায়ণ দেখা যায়, তা এখানে অনুপস্থিত। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকা- অত্যন্ত মর্মান্তিক এবং অপ্রত্যাশিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার ও বিষয়ের যে-ব্যাপকতা, মহাকাব্যিক যে-আবেদন, তা এখানে পাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধ নামক এক অমর মহাকাব্যের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ মার্চের অনন্য-কবিতাসম ভাষণ থেকে শুরু করে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত যে মহাকাব্যিক আবহ, তা নিঃসন্দেহে অতুলনীয়। আর ১৫ আগস্ট সম্পূর্ণ এক ভিন্ন ঘটনা। এর পরিপ্রেক্ষিত এবং কাব্যময়তার উপাদান ভিন্নতর। কাব্যটির গঠনে আরো খানিকটা সাবধানতা অবলম্বন করতে পারতেন এর ¯্রষ্টা। প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধু গ্রন্থটিতে বাংলার ও বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংগ্রাম তুলে ধরার চেষ্টা আছে। পলিমাখা এই ব-দ্বীপ সৃষ্টির ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক, নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্রমধারা বিবরণে লেখক বেশ পরিশ্রম করেছেন। এদেশে ভিনদেশিদের আগমন, নানা জাতির বিচরণ, বাণিজ্য ও সংস্কৃতির বিস্তার, জীবনধারণের প্রয়োজনে পেশার বৈচিত্র্য, ধর্মীয় বোধ ও বোধির উদ্ভব-বিকাশ, ভেদনীতি ও সম্প্রীতি, মানুষের ঐক্য ও আন্তরিকতা এবং সর্বোপরি মানবিক ও উন্নয়নমুখী জাতিরাষ্ট্রে রূপান্তরের যে বিরাট ইতিহাস, তার দিকে কবি সতর্ক চোখ প্রসারিত রেখেছেন। প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধু গ্রন্থটি একটি ঐতিহাসিক কাব্যনাট। নাটকের উপাদান, চরিত্র, সংলাপধর্মিতা এখানে রয়েছে। আছে প্রতিবেশ-বর্ণনাও। এখানে কোরাস, দ্রষ্টা, প্রমিথিউস, সহযোগী, ছাত্রনেত্রী, প্রবীণ মহিলা কবি, জননী জন্মভূমি, আলোর পাখিরা, মজলুম জননেতা, যুবনেতা, ছাত্রনেতা, দেবরাজ জিউস, সাগরকন্যা, লুব্ধক, দার্শনিক, কবর খনন কর্মীগণ, গণকবরবাসী, পাতাল-আশ্রয়ী, প্রতিক্রিয়াশীল, নতুন প্রজন্মের জনৈক তরুণী প্রভৃতি চরিত্র-নির্মাণের মধ্য দিয়ে নাট্যকার প্রচলিত অর্থে মানবকণ্ঠ, গ্রন্থিক বা কথক, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, নারীর ক্ষমতায়ন, শেখ ফজিলাতুন্নেসা, স্বদেশ, স্বাধিকার-চেতনা, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, রণসঙ্গীত, মিছিল, পাক-শাসক, মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ-নেয়া বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক বাহিনীর সদস্য, সুবিধাভোগী, চিন্তাবিদ, ষড়যন্ত্রকারী, শহিদ, হত্যাকারী, রাজাকার, বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ক্যানভানে হাজির করেছেন। গ্রিক মিথলজি থেকে কাহিনি-উপাদান সংগ্রহ করেছেন কবি। বঙ্গবন্ধুকে মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করেছেন প্রমিথিউসের সঙ্গে। গ্রিক পুরাণে বর্ণিত আছেÑ দেবরাজ জিউস ও দেবদূত প্রমিথিউস এক সময় একই দলভুক্ত ছিল। দেবতাদের রথের মিছিল থেকে প্রমিথিউস সবার অজান্তে আগুন চুরি করে এনে মানুষকে দেয়। আগুন পেয়ে মানুষ সচেতন হয়ে ওঠে, বিজ্ঞানের চর্চা শুরু করে। তারা ধাপে ধাপে উন্নত বুদ্ধির চর্চার দিকে অগ্রসর হয়। দেবরাজ জিউস এ কারণে প্রমিথিউসকে শাস্তি দান করে। আর বর্তমান কাব্যনাট্য প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধুতে দেখা যায়Ñ শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালীকে অধিকার সচেতন করেছেন। পাকিস্তানী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন। ক্রমে ক্রমে স্বাধিকার চেতনা থেকে স্বাধীনতার চিন্তার দিকে ধাবিত হয় বাঙালী জাতি। তখন ক্ষিপ্ত হয়ে শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে কারাবন্দী করে। মিথ অনুযায়ী অনেক অত্যাচারের পর এক সময় জনতার ভালবাসায় ও প্রচেষ্টায় মুক্ত হয় প্রমিথিউস। বর্তমান কাব্যে দেখা যায়, বহু মানুষের রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়। জনতার বিজয়ে পাক-কারাগার থেকে মুক্ত হন বঙ্গবন্ধু। এ পর্যন্ত মিথলজিকে সমর্থন করে। কিন্তু পরের ঘটনা? গ্রন্থটিতে ১০টির মধ্যে মাত্র ৫টি সর্গে বর্ণিত হয়েছে প্রমিথিউসের ব্যাপরাদি। অন্য সর্গ বা অধ্যায়ে সম্প্রসারিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, তাঁর শাসন-কালের সামান্য চিত্র, ধানম-ির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের মির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনা এবং শেষত বঙ্গবন্ধুপুত্র রাসেলের জন্য আকুতি। একজন বীরশ্রেষ্ঠকে ভারতীয় পুরাণের বীরবাহুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠদের কথা তুলে ধরা হয়েছে বিছিন্নভাবে। ইতিহাসের কোন কোন ঘটনাকে কৌশলে পরিত্যাগ করেছেন বলেই মনে হয়েছে। বাঙালীর সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক ঐতিহ্যের প্রসঙ্গও এসেছে। কিন্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতিক ধারাক্রমিক পর্যবেক্ষণ এখানে অনুপস্থিত। দ্বি-জাতিতত্ত্বের প্রসঙ্গ বাদ রেখে কীভাবে বাঙালীর জাতিতত্ত্ব উদ্ভাসিত হতে পারে, সে-কথা বোধগম্য হয় না। যেমন, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মওলানা ভাসানীর কথা এলেও ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক চরিত্র শের-এ-বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রসঙ্গ এই উপাখ্যানে উপেক্ষিত। আবার, ছয়দফার প্রাসঙ্গিকতার মতো লাহোর প্রস্তাবের সত্যসত্য এই কাব্যের জন্যই এক অনন্য উপাদান হতে পারত। প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধুর বর্ণনাভঙ্গি বেশ সাবলীল। মিলহীন ছন্দে কবি তার কথাগুলোকে অনর্গল বলে গেছেন। প্রমিথিউসের জবানি থেকে একটি পাঠ নেয়া যেতে পারেÑ জিউসের অত্যাচারে ভীত নই আমি, অনির্বাণ আমার সত্তা, চির দুর্জয়। এশিয়ার শান্ত, ধীর কোটি জনগণ অগ্নিমন্ত্রহীন ছিল, অস্ত্রবিহীন! প্রত্যাঘাত শক্তি ছিল নগণ্য, নধর। আমি-ই দিয়েছি বুকে চেতনা ও বল, ধীশক্তির নব গতি। কূপম-ূকতা ত্যাগ করে গৃহ থেকে বের হলো তা’রা আমার জাগানি’ মন্ত্রে। (পৃ. ৩৬) কথকের ভাষ্যে মাঝে মাঝে কিছু পৌঢ়োক্তি প্রকাশ করেছেন মোস্তফা তোফায়েল। কথাগুলো সরল কিন্তু কঠিন সত্যে উদ্ভাসিত। একটি উদ্ধৃতিÑ বহ্নিমান প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধু তিনি সমগ্র জাতির বন্ধু, প্রাণের প্রতিমা, আত্মার আত্মীয়, দুঃখের সাথী। ক্ষমতার সিঁড়ি নয়, আরোহণ নয়Ñ প্রাণ তার সমতল ঘাসের শিশির। (পৃ. ৫৩) প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধুতে বর্ণনা, কাহিনী-উপস্থাপন আর পরিবেশনশৈলীতে কোথাও কোথাও অস্পষ্টতা রয়েছে। সত্যের অপলাপও আছে। ‘একতাবদ্ধ আজ সাত কোটি লোক’ (পৃ. ৬০); ‘মুক্তিযুদ্ধের মূলশক্তি হয়ে দাঁড়ালো ছাত্ররা, সঙ্গে যোগ দিল কৃষকের ছেলেরা, কৃষক-জনতা’ (পৃ. ৬২), ‘সৈন্যরা পুলিশেরা প্রস্তুত হলো’ (পৃ. ৮৮)Ñ কথাগুলোতে কাব্যিক সৌন্দর্য আছে বটে, কিন্তু ইতিহাসের সত্য নেই। বাস্তবতা হলোÑ ৭ কোটি লোক কিংবা সেদিনের সমগ্র দেশবাসী যুদ্ধে যোগ দেয়নি। সকলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেও ছিল না, অনেকে ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধশক্তি কিংবা পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষের শক্তি। আর যুদ্ধে সাধারণ নিরস্ত্র জনতা এবং বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক বাহিনীর সশস্ত্র অংশগ্রহণই ছিল প্রধান প্রেরণা। জনতার ব্যাপক সমর্থন আর বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণই স্বাধীনতার সংগ্রামকে কার্যত সহজ করে তুলেছিল (মনে রাখতে হবে, তারা কিন্তু পাকিস্তান সরকারের চাকরিজীবী ছিল এবং অস্ত্র-গোলাবারুদও ছিল পাক-সরকারের। তারপরও তারা বিপুল সাহস ও ঝুঁকি নিয়ে কেবল দেশপ্রেমের কারণে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে)। সৈন্যরা যুদ্ধে নেমেছে এ কথা সত্য। কিন্তু একজন সৈনিকের কণ্ঠে শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার হয়েছিল মার্চ মাসে। সে-বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক কাব্যে সেদিকে গভীর ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিপাত ও আলো-প্রক্ষেপণ আশা করাই যায়। এখানে তার ধারেকাছেও যাননি নাট্যকার। তাহলে তিনি কি কিছুটা অস্পষ্টতা রেখেই ইতিহাসকে আলোকিত করতে চান? আবার ‘আমার ভাইয়েরা চিটাগাং বন্দরে প্রাণপণ লড়ে’ (পৃ. ৯৫) বলে খানিকটা দায়মুক্তি কিংবা সরল ব্যাখ্যা হাজির করার চেষ্টা করেছেন কি-না, তাও বুঝা যায় না। ১১টি সেক্টরের কমান্ডারদের প্রসঙ্গও তেমন গুরুত্ব পায়নি এই গ্রন্থে। আবার হাজার বছরের ঐতিহাসিক পরিভ্রমণে তিনি কিছুটা বিভ্রমেও পড়েছেন বলে মনে হয়। ‘সংস্কৃত থেকে আসা বাংলা ভাষার/ অহঙ্কার করে ওরা বাঙালী জাতি’ (পৃ. ১০০)Ñ এই তথ্য তিনি কোথায় পেলেন? বাংলা ভাষার ইতিহাস কি এই বিবরণ সমর্থন করে? আবার, গ্রন্থটির বয়নে, কালচেতনায় খানিকটা গড়বর আছে বলেই মনে হয়। একটা বর্ণনা এ রকম : ‘সীমান্তবর্তী এক গৃহস্থ বাড়ির/ পশ্চাতে, গোয়ালঘরে, ছিল কাল রাতে/সাময়িক আশ্রিত মুক্তিযোদ্ধার দল।/... কঠিন মাঘের রাত, বরফ কুয়াশা’Ñ এই বিবরণের সত্যতা কতটুকু কে জানে? মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মার্চ থেকে ডিসেম্বরে। এর মধ্যে কি মাঘ মাস পড়ে? আর, কবি এখানে গোয়ালঘরের প্রসঙ্গ টেনেছেন ইসলাইলের বেথেলহেম নগরীর এক গোয়ালঘরে শীতকালে যিশুর জন্ম এবং প্রাকৃতিক অস্বাভাবিকতা ও যুগ-পরিবর্তনের প্রাকৃতিক আভাসকে প্রকাশ করার জন্য। (টিকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ১০২) গ্রন্থটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সঙ্গীতময়তা। বর্ণনায় যেমন সাঙ্গীতিক আবহ আছে, তেমনই পাশাপাশি বেশকিছু কবিতা, স্লোগান এবং গানের উপাস্থাপনা কাব্যটিকে করেছে কার্যকর, প্রাণবন্ত। মহান মুক্তিযুদ্ধে অমিয়বাণীর মতো ব্যবহৃত হয়েছে মিছিলের, পোস্টারের স্লোগান, শিল্পীরা ও যোদ্ধারা গেয়েছেন গান, আবৃত্তি করেছেন কবিতা। সেগুলোর উপস্থিতি এখানে ইতিহাসের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। প্রাসঙ্গিক কারণেই যুক্ত হয়েছে গণসঙ্গীতের প্রবহমানতাও। যুদ্ধের নাটকীয়তা পরিবেশনেও কবিকে বেশ সতর্ক বলেই মনে হয়। বাংলার মতো প্রকৃতির শোভাম-িত দেশে, মানুষের আবেগে আবেগে যখন বঙ্গবন্ধু প্রমিথিউসের আবেগ সঞ্চারিত, যখন সারাদেশে পাক-বাহিনীর প্রায় বেহাল দশা, তখন পাক-শাসকের কণ্ঠে নাট্যকার তুলে দেন নাটকীয় ভঙ্গি ও তেজ। তিনি জানাচ্ছেন দেবরাজ জিউসের উক্তিতেÑ জনতার সমর্থন ছিন্ন হয়ে গেছে। পরোয়া করি না তা-তে! সামরিক বল এখনও আমারই হাতে। সাথে আছে আরো স্বার্থ কুশলীগণ, তাঁবেদারগণ, ভূ-স্বামী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ীগণ। বাংলাকে শোষণের সুবিধাভোগীরা আমার সাথেই আছে। (পৃ. ৭৭) ‘জননী জন্মভূমি’ চরিত্রটিকে কবি আরবীয় লোককথার আদমসুরাতের কল্পিত প্রেয়সী সুরাইয়া হিসেবে তুলে ধরেছেন, যে কি-না মুক্তিকামী বীররূপী আদমের প্রতিক্ষায় দিন গোনে। বাঙালীর মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠদের বন্দনা প্রসঙ্গে তিনি এই ধারণার অবতারণা করে থাকবেন হয়ত। যুদ্ধ এবং সংগ্রামের দিন-ওয়ারি কিছু বর্ণনার চিত্র এখানে ফুটে উঠলেও ইতিহাসের ঘটনারাজির দিকে কবি অভিনিবেশ স্থাপন করতে পারেননি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও কাহিনীতে স্থান পায়নি। বিশেষ করে, তথ্যগত বিভ্রান্তি পাঠককে খানিকটা অস্বস্তিতে ফেলে। যেমন তিনি লিখছেনÑ ছাব্বিশ বছর যারা করেছে শোষণ শান্তিপ্রিয় লোকদের, সেই শোষকেরা ঠেকাতে না পারে আর শেষ বিপর্যয়। সুশীল, সুবোধ, শান্ত মানবতাবাদী বাঙালী সন্তান তার প্রতিরোধ বলে ক্রমান্বয়ে বিতাড়ন করেছে শোষকে।(পৃ. ১৩৭) Ñএই বর্ণনা থেকে মনে হতে পারে, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর পাকিস্তানের শোষণ থেকে ক্রমে ক্রমে বাঙালী মুক্তি পেয়েছে। এই বিষয়ে অন্তত বিতর্ক আছে যে, ১৯৭১ সালের মার্চের আগে মুক্তির চিন্তা স্বাধীনতার প্রশ্নে আসেনি, ছিল স্বাধিকারের মর্যাদার কথা। ছিল ৬ দফার কথা। ভীষণ নাটকীয়তার ভেতর দিয়ে ১৯৭১ সালে বাঙালী মুক্তি-সংগ্রামের দিকে এগোয়Ñ এমন ধারণাও ঐতিহাসিকভাবে জোরালো-যুক্তিতে অসমর্থিত নয়। আবার, ৪৭-এর আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৪ বছর ২ মাস প্রায়; মার্চ পর্যন্ত বিবেচনা করলে ২৩ বছর ৭ মাস প্রায়। তাহলে, কবি এখানে কোন ২৬ বছরের কথা বলতে চেয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। বর্তমান গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা স্থান পায়নি। তাঁর সাফল্য-ব্যর্থতার বিবরণ আরও বিস্তৃত হতে পারতো। শুধু হত্যার পরিপ্রেক্ষিতকে কিছুটা কার্যকারণের ছকে ফেলবার জন্য একটা চিন্তা-কল্প-বাস্তব তুলে ধরেছেন কবি। লিখেছেনÑ তিনি চান আজীবন রাষ্ট্রপতি পদ; দেশ থেকে গণতন্ত্র পুরো নির্বাসিত। উচ্চাভিলাষ তা’র আকাশ ছুঁয়েছে। আকাশ থেকেই তা’কে পাতালে নামাবো।(পৃ. ১৮১) বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের মানচিত্রে স্থাপনের জন্য, প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধুকে পরবর্তী-প্রজন্মের কাছে পরিচিত করে তোলার জন্য, স্বাধীনতার স্বাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ক্রম-সম্প্রসারিত করার জন্য ‘নতুন প্রজন্মের জনৈক তরুণী’ নামাঙ্কিত চরিত্রটি সৃষ্টি করা হয়েছে বলে মনে হয়। কবি লিখছেনÑ এমন করুণ ভাগ্য, এমন এতিম এ ধরায় আর কেউ দ্বিতীয়টি নেই! পিতামাতা, ভ্রাতাগণ, জায়াগণসহ অকস্মা’ এক রাতে হয় কি নিহত?... কী হবে আমার ভাগ্যে? আমার দেশের? ছন্নছাড়া, দিশেহারা সমস্ত মানুষ! সমগ্র দেশব্যাপী ত্রাসের শাসন চলছে চরম ক্রোধে, চূড়ান্ত দাপটে!... হায়রে অভাগা পিতা মহানেতৃবর! নশ^র ভূধরে তুমি কবি কল্পনায় বাংলার মানচিত্র বক্ষে জড়িয়ে কি প্রশান্তি খুঁজে নিলে? (পৃ. ১৮৯-১৯১) প্রমিথিউস-কল্পনায় বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা জানার জন্য আকুতি, তার সহচরের বর্ণনায় শেষত প্রাপ্ত-প্রশান্তি এবং এক সফল বাংলাদেশের কথা-বর্ণনের ভেতর দিয়ে, ছোট্ট রাসেলসম সেদিনের শিশুর পরবর্তী প্রজন্ম হয়ে-ওঠা এবং নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন-বাসনার ভেতর দিয়ে কাব্যটির পরিসমাপ্তি ঘটে। ঘটনার বিছিন্ন বিবরণ এবং একটি দর্শনগত বিশ্লেষণের বিভায় গ্রন্থটির বিশেষ তাৎপর্য আছে। তবে, সামগ্রিক অর্থে কবির চিন্তা ও প্রকাশ-কৌশলের অপূর্ণতা কল্পিত বিষয়ের বিশালতাকে যথার্থভাবে স্পর্শ করতে পারেনি।
×