ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন কবি আশরাফ সিদ্দিকী

প্রকাশিত: ১১:২৬, ২০ মার্চ ২০২০

চলে গেলেন কবি আশরাফ সিদ্দিকী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ লোকগবেষক ও কবি ড. আশরাফ সিদ্দিকী আর নেই। বুধবার রাত সোয়া ৩টায় রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। ধানম-ির শাহী মসজিদে বাদ জোহর জানাজার পর আশরাফ সিদ্দিকীকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। আশরাফ সিদ্দিকীর মেয়ে তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বাবা বেশ কিছুদিন ধরেই শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। এক মাস ধরে শ্বাসনালী এবং খাদ্যনালীতে সমস্যা হয়েছিল। এ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে বাবা যে বাড়িতে থাকতেন বসুন্ধরার সেই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তার মরদেহ ধানম-িতে তার নিজের বাড়ি আশরাফ সিদ্দিকী রূপকথায় নিয়ে আসা হয়। সেখানের ঈদগা শাহী মসজিদে জোহরের নামাজের পরে তার জানাজা হয়। তার পরই বনানী কবরস্থানে নিয়ে যাই। বাংলা একাডেমি থেকে বলা হয়েছিল বাবাকে সেখানে নেয়ার জন্য কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে আমরা নিতে চাইনি। আমরা বলেছি পরে অনুষ্ঠান করব। কারণ করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে আমরা বেশি লোক জমায়েত চাইছি না। এ জন্য বাংলা একাডেমিতে মরদেহ নেয়া হয়নি। বাংলা একাডেমি থেকে মহাপরিচালকসহ অনেকেই ধানম-ির বাড়িতে এসেছিলেন বাবাকে শ্রদ্ধা জানাতে। ড. আশরাফ সিদ্দিকীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। এক শোকবার্তায় মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন প্রতিমন্ত্রী এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। তিনি বাংলাদেশের লোকসাহিত্যচর্চা ও লোকগবেষণায় ড. আশরাফ সিদ্দিকীর অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন যেসব ব্যক্তিত্ব আশরাফ সিদ্দিকী তাদের একজন। চল্লিশের দশকের শুরুতে কবি হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ। সাহিত্যিক জীবনে তিনি রচনা করেছেন পাঁচশ’র অধিক কবিতা। বাংলার লোকঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। একাধারে তিনি প্রবন্ধকার, লোকসাহিত্যিক, ছোটগল্পকার এবং শিশুসাহিত্যিক। রচনা করেছেন ৭৫টি গ্রন্থ এবং অসংখ্য প্রবন্ধ। ১৯৪৮ সালে দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে ‘তালেব মাস্টার’ কবিতা রচনা করে তিনি অল্প সময়ের মধ্যে গণমানুষের কবি হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ‘গলির ধারের ছেলেটি’ ছোটগল্প লেখক হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ছোটগল্প অবলম্বনে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘ডুমুরের ফুল’ চলচ্চিত্রটি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। বাংলার মৌখিক লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতিকে লিপিবদ্ধ করার জন্য ড. আশরাফ সিদ্দিকী বিশেষভাবে সমাদৃত। তার লেখা বইগুলো- ‘লোকসাহিত্য’, ‘বেঙ্গলী ফোকলোর’, ‘আওয়ার ফোকলোর আওয়ার হেরিটেজ’, ‘ফোকলোরিক বাংলাদেশ’ এবং ‘কিংবদন্তীর বাংলা’ দক্ষিণ এশিয়ার লোকসাহিত্যের গবেষণায় মৌলিক বই হিসেব বিবেচিত। ‘ভোম্বল দাশ: দ্যা আঙ্কল অব লায়ন’ এবং ‘টুনটুনি এন্ড আদার স্টোরিজ’ প্রভৃতি গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে তিনি বাংলার লোকজ গল্পকে বিশ্ব সাহিত্যের ভা-ারে পৌঁছে দেন। ১৯৫৮ সালে প্রখ্যাত ম্যাকমিলান পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত তার ‘ভোম্বল দাশ’ বইটি ছিল সে বছরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক বিক্রীত শিশুদের বইয়ের তালিকায়। পরবর্তীতে এ বইটি ১১টি ভাষায় অনূদিত হয়। ৭০ দশকে লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন’ ও ‘প্যারিস সুন্দরী’ তরুণ পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়। ড. সিদ্দিকী বহু পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেন। তার মধ্যে ১৯৮৮ সালে সাহিত্যে একুশে পদক, ১৯৬৪ সালে শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৬ সালে সাহিত্যে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার, ইউনেসকো পুরস্কার, লোকসাহিত্য গ্রন্থের জন্য দাউদ পুরস্কার অন্যতম। ১৯২৭ সালের ১ মার্চ টাঙ্গাইলের নাগবাড়ি গ্রামে কবির জন্ম। তিনি পড়াশোনা করেন শান্তিনিকেতন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে তিনি আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় হতে দ্বিতীয় এমএ এবং পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। আশরাফ সিদ্দিকী রাজশাহী কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, ময়মনসিংহের এএম কলেজ, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। পরবর্তীতে তিনি কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক, ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারের প্রধান সম্পাদক ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
×