ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আরও তিন করোনা রোগী শনাক্ত ॥ ১৯ জন আইসোলেশনে

প্রকাশিত: ১১:১২, ২০ মার্চ ২০২০

আরও তিন করোনা রোগী শনাক্ত ॥ ১৯ জন আইসোলেশনে

নিখিল মানখিন ॥ দেশে আরও নতুন তিন করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়েছে। তারা ইতালিফেরত এক পরিবারের সদস্য। ইতালিফেরত ব্যক্তি দ্বারাই বাকি দু’জন সংক্রমিত। এ নিয়ে দেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১৭ জনে। তাদের মধ্যে তিনজন ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এবং মারা গেছেন একজন। করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম পর্যায় (বিদেশফেরত) পেরিয়ে দ্বিতীয় স্তরে(স্থানীয় সংক্রমণ) রয়েছে বাংলাদেশ। পরবর্তী পর্যায় ‘সম্প্রদায়গতভাবে সংক্রমণ (অনির্দিষ্ট বাহক দ্বারা সংক্রমিত) ’ যাতে না ঘটে, তা মোকাবেলা করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। কোয়ারেন্টাইনের বাইরে রয়ে যাওয়া বিদেশফেরত এবং তাদের সংস্পর্শে যাওয়া লোকদের খুঁজে বেড়াচ্ছে করোনা প্রতিরোধ কমিটি এবং এলাকাবাসী। করোনা টেস্টের কিট তৈরির অনুমতি পেল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। দেশে এখন মোট ১৯ জনকে আইসোলেশনে রাখ হয়েছে। অনেক হাসপাতালের বিরুদ্ধে সাধারণ সর্দি-কাশি, জ্বরে আক্রান্তদের চিকিৎসা প্রদানে অস্বীকৃতি জানানোর অভিযোগ উঠেছে। চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত থাকার আহ্বান জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম পর্যায় মোকাবেলায় বাংলাদেশ বেশি সফল হতে পারেনি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গত ৭ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার আগে কোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার বিষয়টি বিদেশফেরতদের প্রতি বিশ্বাস রেখে তাদের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের বড় অংশ সরকারী নির্দেশনা অমান্য করে অবাধে ঘুরে বেড়িয়েছেন, কেউ কেউ এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশকে মুখোমুখি হতে হয়েছে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায় স্থানীয় সংক্রমণে। এখান থেকে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সম্প্রদায়গত সংক্রমণে চলে গেলে করোনা প্রাদুর্ভাবের পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এদিকে করোনা সংক্রমণের বিভিন্ন স্তর উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, এই রোগ সংক্রমণের চারটি স্তর রয়েছে। প্রথম পর্যায় বিদেশ থেকে রোগের সংক্রমণ। এখানে সংক্রামিত দেশগুলো থেকে এই ধরনের রোগী দেশে প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে যারা বিদেশ ভ্রমণ করেছেন কেবল তাদেরই ইতিবাচক পরীক্ষা করানো হয়। দ্বিতীয় পর্যায় স্থানীয় সংক্রমণ। এখানে আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ হয়। উদাহরণস্বরূপ, যারা বিদেশ ভ্রমণ করেছেন তাদের আত্মীয় বা পরিচিতজনের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। স্থানীয় সংক্রমণে কম লোক আক্রান্ত হয়। কেননা ততক্ষণে ভাইরাসটির উৎস জানা যায়। ফলে এর সঙ্গে লড়াইটা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। তৃতীয় পর্যায় কমিউনিটি সংক্রমণ। এই স্তরে রোগ কোন সম্প্রদায়গতভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং বৃহত্তর অঞ্চলের মানুষ সংক্রমিত হয়। সম্প্রদায়ের সংক্রমণ তখনই হয় যখন কোন রোগী কোন সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শে না আসা সত্ত্বেও বা আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে কোন একটি দেশে সফর না করা সত্ত্বেও তার শরীরে ওই রোগের সংক্রমণ ঘটেছে। এই পর্যায়ে, সংক্রামিতদের শরীরে কোথা থেকে এই ভাইরাস এসেছে তা শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। যেমন, ইতালি এবং স্পেন রয়েছে তৃতীয় স্তরে। চতুর্থ পর্যায় যখন মহামারী। এটি সবচেয়ে খারাপ পর্যায়। যখন এই রোগটি কোন স্পষ্ট কারণ ছাড়াই মহামারীর আকার ধারণ করে। চিনেও এই ঘটনাই ঘটেছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সম্প্রদায়গতভাবে সংক্রমণের ঘটনা ঘটেনি জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতি প্রতিমূহুর্তে পর্যালোচা করে দেখা হচ্ছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী করোনা প্রতিরোধ কমিটির কর্মপরিকল্পনাতেও পরিবর্তন আসছে। আইইডিসিআর’র ব্রিফিং ॥ করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) আয়োজিত ব্রিফিংয়ে অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, নতুন করে যে তিনজন আক্রান্ত হয়েছেন, তারা ইতালিফেরত এক ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিলেন। নতুন আক্রান্ত তিনজনের মধ্যে একজন নারী, বয়স ২২ বছর। আর দুইজন পুরুষ। তাদের একজনের বয়স ৬৫ বছর, অন্যজনের ৩২। আক্রান্ত নারীর মধ্যে উপসর্গ খুবই মৃদু। বাকি দুজনের জ্বর রয়েছে, তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া অন্য কোন সমস্যা তাদের নেই। দেশে এখন মোট ১৯ জনকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। আর প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৪৩ জন। কিট তৈরির অনুমতি পেল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ॥ করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) শনাক্ত করার জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যে কিট তৈরি করেছে, তা উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে সরকার। এর আগে বুধবার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এ কিট তৈরির ঘোষণা দেয়। প্রতিষ্ঠানটি থেকে দাবি করা হয়, স্বল্পমূল্যের ওই কিট দিয়ে মাত্র ১৫ মিনিটে করোনা শনাক্ত করা সম্ভব। বৃহস্পতিবার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, আজ(বৃহস্পতিবার) আমরা সরকারের কাছ থেকে এ কিট তৈরির অনুমোদন পেয়েছি। এর কাঁচামাল যুক্তরাজ্য থেকে আসতে সাতদিনের মতো সময় লাগবে। কাঁচামাল এলেই আমরা উৎপাদনে যাব বলে জানান তিনি। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ জনসংযোগ কর্মকর্তা মোঃ ফরহাদ স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। ওই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন ড. বিজন কুমার শীল। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের নবেম্বরে চীনের উহানে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। এ ভাইরাসের টেস্ট কিট উৎপাদনের জন্য এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই কাজ শুরু করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ তাদের প্রয়োজনে করোনাভাইরাসের কিট তৈরি করলেও বাংলাদেশে এমন কাজ অন্য কেউ এখনও করেনি। গণস্বাস্থ্যের সুদক্ষ টিম এই কিটের ডিজাইন এবং উৎপাদন করার কাজ করছে। এর আগে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের ডায়াগনোসিস কিট তৈরির সময় সিঙ্গাপুরে কাজ করেছেন ড. বিজন কুমার শীল। তিনিই গণস্বাস্থ্যের এই টিমের অধিনায়কত্ব করছেন। আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে এই কিটে ভাইরাস শনাক্ত করা যাবে। এর জন্য স্পুটাম নেয়ার প্রয়োজন নেই। প্রথমে সন্দেহজনক ব্যক্তির রক্তের নমুনা নেয়া হবে। সেই রক্ত থেকে ‘সিরাম’ আলাদা করতে হবে। কিটে সেই সিরাম রেখে তার ওপর এন্টিজেনের বিক্রিয়া ঘটানো হবে। যদি বিক্রিয়া হয় তাহলে সন্দেহজনক ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসের প্রাথমিক উপস্থিতি রয়েছে বলে প্রমাণ হবে। বিক্রিয়া না করলে তিনি আক্রান্ত নন বলে বিবেচিত হবে। হোম কোয়ারেন্টাইন মানছেন না অনেক বিদেশফেরত ॥ করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কমিটির সক্রিয় উদ্যোগ এবং এলাকাবাসীর তৎপরতার কারণে প্রতিদিন কোয়ারেন্টাইনে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নিয়ম অমান্যকারীদের আটক করে, অর্থদ- দিয়ে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হচ্ছে। এসব কিছুর পর বিদেশফেরতের বড় অংশ এখনও কোয়ারেন্টাইনের বাইরে রয়ে গেছে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, দেশে এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে এসেছেন কয়েক লাখ যাত্রী। যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন তাদের অনেকেই সঠিকভাবে এর শর্ত মানছেন না। এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের একার কাজ নয়। আমরা সবসময়ই বলছি স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্ব আমাদের। বাকি দায়িত্ব অন্যদের নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, কোন জায়গায় যদি স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ হয়; তা ঠেকানোর জন্য ওই জায়গা ‘ব্লক’ করতে হবে। আমাদের দেশের গ্রামগুলোকে ‘লকডাউন’ করা খুবই কঠিন। রাস্তা কীভাবে ‘লকডাউন’ করা হবে? মানুষ তো বাড়ি থেকে বেরুবে। তাদের কীভাবে ঠেকানো যাবে? তবে যেভাবেই হোক গ্রাম ও ইউনিয়ন পরিষদের সহযোগিতায় আমাদের এই কঠিন কাজটি করতে হবে। সবাইকে বলতে হবে যাতে তারা বাড়ির বাইরে না যায়। কোনে বাড়িতে কেউ আক্রান্ত হলে সেই বাড়ির কেউ যাতে বাইরে না বের হয়। আত্মীয়স্বজনরা তার খাবার বাড়িতে না ঢুকে বাইরে দিয়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সহযোগিতা দরকার। তবে জাতীয় করোনা প্রতিরোধ কমিটিসহ এ সংক্রান্ত ১১টি কমিটি ব্যাপকভাবে কাজ করছে। ফলে কোয়ারেন্টাইনে আসা বিদেশফেরতদের সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। হাসপাতালগুলোতে সাধারণ জ্বরে আক্রান্তদের ফিরিয়ে দেয়ার অভিযোগ ॥ দেশে করেনা রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই হাসপাতালগুলোতে সর্দি, কাশি ও জ্বর উপসর্গ থাকা রোগীদের দেখতে এবং চিকিৎসা প্রদানে অস্বীকৃতি জানানোর অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি স্বীকার করে বুধবার আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সাংবাদিকদের জানান, আমাদের কাছেও এ ধরনের খবর এসেছে। হাসপাতালগুলোর সঙ্গে একের পর এক আলোচনা চলছে। আশা করি সমাধান হয়ে যাবে। হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসকদের নিরাপত্তা এবং তাদের করণীয় সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা চলছে। সব ঠিক হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দেন পরিচালক। বৃহস্পতিবার মহাখালীতে আইইডিসিআর’র সংবাদ ব্রিফিংয়ে এবিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত থাকার আহ্বান জানিয়ে মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, এটা জাতীয় দুর্যোগ। জাতির স্বার্থে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করুন। সকল চিকিৎসক-নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর পার্সোনাল প্রটেকটিভের (পিপি) সকল ব্যবস্থা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কেউ আতঙ্কিত হবেন না, ঘাবড়াবেন না। কিটের অভাব হবে না, পিপিরও অভাব হবে না। আমরা এ কথা বলতে পারব না, তিন মাসের পিপি মজুদ আমাদের কাছে আছে। কিন্তু প্রতি সপ্তাহের কিংবা দৈনিকভিত্তিতে তাদের নিরাপত্তার সব ধরনের ব্যবস্থা স্বাস্থ্য অধিদফতরের রয়েছে।
×