ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ছিনতাইকারী ধরতে গিয়ে বাসচাপায় পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু

জীবন বিপন্ন করে দায়িত্ব পালনের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত

প্রকাশিত: ১১:০৯, ২০ মার্চ ২০২০

জীবন বিপন্ন করে দায়িত্ব পালনের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জীবন দিয়ে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলেন পুলিশ কর্মকর্তা মোঃ জাহাঙ্গীর আলম। নিজের জীবন বিপন্ন করে দায়িত্ব পালনের এমন দৃষ্টান্ত নজিরবিহীন। ছিনতাইকারীদের হাত থেকে অন্যের জীবন ও মালামাল বাঁচাতে দুর্বৃত্তদের ধাওয়া করে ধরার চেষ্টা করছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। এমন সময় পেছন থেকে আসা একটি বাস ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে চাপা দেয়। মুহূর্তেই পিচঢালা কালো রাস্তা সৎ এই পুলিশ কর্মকর্তার রক্তে ভিজে যায়। নিভে যায় জীবনের গল্প। শুধু নিজের জীবনই নয়, পুরো পরিবারকে অন্ধকার ভবিষ্যতের হাতে সপে দিয়ে পরপারে চলে গেলেন সাহসী ও কর্তব্যপরায়ন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তার মৃত্যুতে পুলিশ বাহিনীতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ঢাকায় ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে পুলিশ ও র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বুধবার রাত সোয়া আটটার দিকে পুলিশ কর্মকর্তা নিহতের হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে। রুটিন মোতাবেক ঢাকা মহানগর পুলিশের কাফরুল থানার এএসআই (সহকারী উপপরিদর্শক) মোঃ জাহাঙ্গীর আলম রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছিলেন কাফরুল থানার পুলিশ কনস্টেবল মোঃ সিদ্দিকুর রহমান। কনস্টেবল সিদ্দিকুর রহমান বলছিলেন, তারা আগারগাঁওয়ের তালতলা ৯ নম্বর গেট থেকে ১৩ নম্বর গেট পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছিলেন। তারা রাতে ৯ নম্বর গেট থেকে ১৩ নম্বর গেট পর্যন্ত ডিউটিরত ছিলেন। তারা এক গেট থেকে অন্য গেটে ঘন যাতায়াত করছিলেন। যাতে ডিউটিরত স্থানে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা বিশেষ করে ছিনতাই বা এ ধরনের কোন কিছু না হয়। রাত সোয়া আটটার দিকে কুর্মিটোলা পুরনো বিমানবন্দরের ৯ নম্বর গেটের উত্তর দিকে রাস্তায় পাশে কতিপয় ছিনতাইকারী ছিনতাই করছিল। তারা ঘটনাটি দেখে ফেলে। দ্রুত সেখানে যাওয়ার জন্য দৌড় দেয়। এ সময় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়া লোকজনও ছিনতাইকারী ছিনতাইকারী বলে চিৎকার করছিলেন। ছিনতাইকারীরা পুলিশ দেখে দৌড়ে পালাতে থাকে। তারাও ছিনতাইকারীদের পিছু নেয়। তারা ছিনতাইকারীদের ধরার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় দক্ষিণ দিক থেকে আসা যাত্রীবাহী আলিফ পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৮৪০৭ নম্বরের একটি বাস বেপরোয়া গতিতে আসছিল। বাসটি চোখের পলকে পুলিশ কর্মকর্তাকে মারাত্মকভাবে ধাক্কা দেয়। এতে ওই পুলিশ কর্মকর্তা ছিটকে অন্তত দশ হাত দূরে গিয়ে পাকার রাস্তার উপর পড়ে যান। পড়েই তিনি উচ্চৈঃস্বরে চিৎকারে দেন। এরপর সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। তার মুখের বাম পাশের গালে ও বাম কানে গুরুতর জখম হয়। জখমের জায়গা দিয়ে প্রচুর রক্ত ঝরছিল। তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। মুহূর্তেই কালো পিচ ঢালা রাস্তা লাল হয়ে যায়। তাকে দ্রুত উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। রাত আটটা ৫০ মিনিটে দায়িত্বরত চিৎিসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কাফরুল থানা পুলিশ জানায়, হাসপাতালে নেয়ার পথেই পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু হয়। মাথায় মারাত্মক আঘাতের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে রাস্তায়ই তার মৃত্যু হয়। রাস্তায় ছিটকে পড়ার পর মাত্র ৮/১০ মিনিট তিনি বেঁচে ছিলেন। এরপরই তার জীবন প্রদীপ নিভে যায়। শেষ হয়ে যায় জীবনের গল্প। খবর পেয়ে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে ছুটে যান। ততক্ষণে সব শেষ। কাফরুল থানার ওসি মোঃ সেলিমুজ্জামান জনকণ্ঠকে জানান, ঘটনাস্থল থেকে বাসটি জব্দ করা হয়েছে। তবে বাসের চালক ও হেলপারসহ কাউকেই পাওয়া যায়নি। বাসটির প্রকৃত মালিক সম্পর্কে তথ্য জানতে বাসের নম্বরটি বিআরটিএ-এর কাছে দেয়া হয়েছে। সেখানে বাসটির নম্বর দিয়ে সেটির মালিক সম্পর্কে জানার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি মালিকের সন্ধান করা হচ্ছে। কারণ বাসটির চালক ও হেলপারদের সম্পর্কে তথ্য পেতে বাস মালিকের সন্ধান করা হচ্ছে। বাস মালিকের সন্ধান পাওয়া গেলে বাসটির চালক ও হেলপার সম্পর্কে এবং তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। কাফরুল থানার ডিউটি অফিসার এসআই মোঃ আনিছুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, এ ঘটনায় নিহত পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী নাছিমা খাতুন বাদী হয়ে কাফরুল থানায় সড়ক পরিবহন আইনে একটি মামলা দায়ের করেছেন। তিনি আরও জানান, দুপুর দুইটার দিকে লাশ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ মর্গ থেকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। লাশ পুলিশ পাহারায় পুলিশের এ্যাম্বুলেন্সে করে বিশেষ মর্যাদায় গ্রামের বাড়ি পাঠানো হয়েছে। নিহতের বাড়ি পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানাধীন পার করমজা গ্রামে। তার পিতার নাম মরহুম আবু সায়েম। গ্রামের বাড়িতেই পুলিশ কর্মকর্তার লাশ দাফন করা হচ্ছে। নিহত পুলিশ কর্মকর্তা কাফরুল থানার অদূরে উত্তর কাফরুলের বর্ণমালা সড়কের বউবাজার এলাকার ৪৩৩/৩ নম্বর বাড়িতে পরিবার নিয়ে ভাড়ায় বসবাস করতেন। নিহতের একমাত্র ছেলে সাকিবুল হাসান (১৪)। সে কাফরুল শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল এ্যান্ড কলেজের স্কুল শাখার অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা কাফরুল থানার এসআই মোঃ কাজী আরিফুল হক জনকণ্ঠকে জানান, মামলার বাদী বাসটির অজ্ঞাত চালককে মামলার আসামি করেছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মোঃ মাসুদুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, আসামি ও ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে ঢাকায় সাঁড়াশি অভিযান চলছে। নিহত পুলিশ কর্মকর্তা ২০০৪ সালে বাংলাদেশ পুলিশে কনস্টবল পদে যোগদান করেছিলেন। দায়িত্বরত অবস্থায় নিহত পুলিশ কর্মকর্তার যাবতীয় সুবিধা পাবেন। তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মহানগর পুলিশের কল্যাণ শাখার তরফ থেকে নিহতের পরিবারকে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ দেয়া হয়েছে।
×