ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রফতানিতে শঙ্কা ॥ করোনার প্রভাব

প্রকাশিত: ১১:০৬, ২০ মার্চ ২০২০

রফতানিতে শঙ্কা ॥ করোনার প্রভাব

এম শাহজাহান ॥ প্রাণঘাতী ভয়াবহ করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের রফতানি খাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সর্বাধিক ঝুঁকির মুখে রয়েছে- রফতানিতে শীর্ষস্থান দখলকারী তৈরি পোশাক খাত। ইউরোপ ও আামেরিকায় ভাইরাসটির প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে ১০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৮৫০ কোটি টাকার রফতানি অর্ডার বাতিল করেছে ক্রেতারা। বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন রফতানির ১৪টি খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সঙ্কটের মুখে পড়েছে চামড়া, হিমায়িত মাছ, প্লাস্টিক, পাট ও পাটজাতপণ্য, শাক-সবজি ও সিরামিকসহ অন্যান্য খাত। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, করোনার কারণে রফতানি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে সরকার দৃষ্টি রাখছে। শিল্প রক্ষায় সব ধরনের নীতিগত সহায়তা দেয়ার জন্য প্রস্তুত সরকার। এদিকে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। একজন করোনা রোগীর মৃত্যুর পর থেকে সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকলে শ্রমিকরা শেষ পর্যন্ত কাজে আসবেন কিনা তা নিয়েই উদ্যোক্তারা শঙ্কিত রয়েছেন। করোনাভাইরাসের প্রভাবে আক্রান্ত সারাবিশ্বের অর্থনীতি। বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন মন্দা চলছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই খাত রেমিট্যান্স এবং রফতানি রয়েছে চ্যালেঞ্জের মুখে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ ফিরে আসায় শীঘ্রই রেমিটেন্সে আহরণে ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যারা এখন বিদেশে অবস্থান করছেন তাদের বেশির ভাগ কাজে যোগ দিতে পারছে না, কিংবা বেকার হয়ে বসে আছেন। ধার দেনা করে তাদের চলতে হচ্ছে। ফলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে আহরণে বড় ধরনের ঝুঁকি আসন্ন। একইভাবে রফতানি অর্ডার বাতিল করছে ক্রেতাদেশগুলো। করোনাভাইরাসের প্রভাবে লন্ডভন্ড এখন ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনীতি। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় ইউরোপের দেশগুলোই। এছাড়া প্রায় সব ধরনের পণ্য রফতানি হয় ইউরোপের ২৮টি দেশে। এ রকমটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হচ্ছে ইতালি। সেই দেশটির সঙ্গে বলতে গেলে এখন বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে, একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সর্বশেষ দেশটির সব অঙ্গরাজ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে দেশটি তাদের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে কার্ফ্যু জারি করেছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। এছাড়া পোশাকের নতুন বাজার খ্যাত লাতিন আমেরিকা, জাপান ও প্রতিবেশী ভারতের বাজারেও সুখবর নেই। ফলে এ অবস্থায় দেশের রফতানি খাত বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করে জনকণ্ঠকে বলেন, করোনার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৈরি পোশাক খাত। ইতোমধ্যে এ শিল্পের রফতানি অর্ডার বাতিল ও স্থগিত করা শুরু করেছেন ক্রেতারা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকা। দুঃখজনক, সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমিত হয়েছে এসব জায়গায়। এ কারণে তৈরি পোশাক খাতের রফতানি কমে যাবে, এটাই সত্য। এখন পরিস্থিতি মোকাবেলায় দ্রুত করণীয় নির্ধারণ করা সম্ভব না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। তিনি বলেন, একটি কারখানার চাকাও যাতে বন্ধ না হয়ে যায় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে সেই উদ্যোগ রয়েছে। এখন সরকারকে এ ব্যাপারে নীতিগত সহায়তা দিতে হবে। বিজিএমইএ থেকে শীঘ্রই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। এদিকে, চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে বড় ধরনের হোঁচট খেল পণ্য রফতানি আয়। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ২ হাজার ৬২৪ কোটি ১৮ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেছে ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ। ইপিবি সম্প্রতি পণ্য রফতানি আয়ের যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবৃদ্ধি ও লক্ষ্যমাত্রা কোনটাই স্পর্শ করতে পারেনি দেশের তৈরি পোশাক খাত। চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে ২ হাজার ১৮৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। একইসঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। একক মাস হিসেবে ফেব্রুয়ারিতে রফতানি আয় অর্জিত হয়েছে ৩৩২ কোটি ২৩ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭২ কোটি ২০ লাখ ডলার। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি আরশাদ জামাল বলেন, রফতানি অর্ডার স্থগিত ও বাতিলের তথ্য যা আসছে ভয়াবহ। গ্রীষ্ম মৌসুমে ব্র্যান্ডগুলো বড় ব্যবসা করে থাকে। তার আগ মুহূর্তে করোনা আঘাত হেনেছে। ইউরোপে এইচএ্যান্ডএমের ৬২ শতাংশ বিক্রয় কেন্দ্র বন্ধ। ফলে সামনে আমাদের জন্য কী আছে, বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশেও দ্রুত করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। এ পরিস্থিতি সবাই জীবন বাঁচাতে সাবধানে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই আগামী দিনগুলো কারখানায় শ্রমিকরা আসতে পারবেন কিনা সেটা বড় উদ্বেগের বিষয়। এদিকে, করোনার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিজেদের সদস্যের কাছ থেকে অর্ডার বাতিল ও স্থগিতাদেশের তথ্য নিচ্ছে পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। সম্প্রতি বিজিএমইএ আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ কারখানার ২ কোটি ৭২ লাখ ডলারের ক্রয় অর্ডার বাতিল ও স্থগিত হওয়ার তথ্য পায়। তাদের সদস্য মোট ৬৯ কারখানার ৯ কোটি ৩০ লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে। অন্যদিকে, বিকেএমইএ জানায়, ১৫ কারখানার ৭৩ লাখ ৮৭ হাজার ডলারের ক্রয় অর্ডার স্থগিত হয়েছে। এদিকে, চীনসহ এখন পর্যন্ত ভাইরাসটি ১৫৯টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাসটির কারণে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছে। জার্মানিও ধুঁকছে। দেশগুলোতে নিত্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ। অতি জরুরী প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাইরে বের হচ্ছে না। অনেক পোশাকের ব্র্যান্ড তাদের শত শত বিক্রয় কেন্দ্র ঘোষণা দিয়ে বন্ধ রেখেছে। এছাড়া পোশাকের পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোই চামড়া, হিমায়িত মাছ, প্লাস্টিক পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং শাক-সবজি রফতানি বন্ধ হওয়ার পথে। এসব খাত থেকে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। চামড়া শিল্পের উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। প্লাস্টিক পণ্যের উদ্যোক্তারা ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আগামী বাজেটে বিশেষ কর ছাড় ও প্রণোদনা দাবি করেছেন। এছাড়া শাক-সবজি রফতানিকারকরা ইউরোপে বিশেষ কার্গো বিমান চাচ্ছেন। তবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে এসব খাতে দীর্ঘমেয়াদে সঙ্কটের কথা বলছেন উদ্যোক্তারা। এদিকে, তৈরি পোশাক এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সতর্ক করেছে ট্যারিফ কমিশন। বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে রফতানির ১৪ খাতকে চিহ্নিত করেছে, যেগুলো করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে মনে করে সংস্থাটি। খাতগুলোর মধ্যে আছে প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এছাড়াা ওষুধ শিল্প, পাট সুতা, ইলেক্ট্রনিক্স, সামুদ্রিক মাছ, প্রসাধনী ইত্যাদি। এসব খাত এখন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে একদিকে যেমন আমাদের পোশাক খাতে কিছু ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে চীন যেসব দেশে রফতানি করত তারা যদি সেখান থেকে রফতানি কমায় তাহলে সেই বাজারগুলো বাংলাদেশ ধরতে পারে কিনা, সেখানে আবার একটা সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বাংলাদেশেও এখন করোনভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। এখন আমাদেরকেও করোনা মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হচ্ছে। অন্যদিকে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের মোট অফিসিয়াল বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি আসে সেখান থেকে। আর বাংলাদেশের রফতানি ১ বিলিয়ন ডলারের কম। বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের মধ্যে বেশির ভাগই পোশাক। এর বাইরে কিছু কৃষিপণ্য ছাড়াও কাঁকড়া কুঁচেও রয়েছে। তবে চীনে করোনার প্রভাব কমে আসায় দেশটির সঙ্গে আমদানি-রফতানি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। তবে ইতোমধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, যারা ভ্যালু চেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা গত প্রায় তিন মাস ধরেই ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে করোনায় বাংলাদেশ আক্রান্ত। এটা আরও ভয়াবহ খবর, মানুষ আগে তার জীবন বাঁচাবে এটাই হওয়া উচিত। আর এ কারণে শিল্পের উৎপাদন কতটা সম্ভব সেটাও কিন্তু ভেবে দেখার বিষয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানের টেকনেশিয়ানরা চীনের নাগরিক। এখন চীন থেকে টেকনেশিয়ানরা আসতে পারছেন না। ফলে ওইসব প্রতিষ্ঠান এখন চলছে না।
×