ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ২০ মার্চ ২০২০

কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

মৌসুমী আক্তারের যখন বিয়ে হয়, তখন ওর বয়স ছিল ১৬ বছর। ভালবেসে গার্মেন্টস চাকরিজীবী আরমানকে বিয়ে করে সে। মিরপুরে এক রুমের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকে। বিয়ের দুই বছরের মাথায় একটি কন্যাসন্তান জন্ম হয়। একদিন প্রতারক স্বামী স্ত্রী-সন্তানকে রেখে পালিয়ে যায়। মৌসুমী ও তার মেয়ের আর কোন খোঁজ নেয়নি। ছোট সন্তানকে নিয়ে বিপদে পড়ে মৌসুমী। ঘরভাড়া বাকি পড়ে যায় কয়েক মাসের। বাড়িওয়ালার কটুকথা ও বকাঝকা সহ্য করতে না পেরে আবার মেয়েকে নিয়ে বাবা-মার কাছে ফেরত আসে মৌসুমী। এ সময় তার বাবা-মা মৌসুমীকে হাতের কাজ শেখার পরামর্শ দেন। বাবা-মার পরামর্শ মতো নতুন কিছু শেখার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে মৌসুমী। ইউসেপ মিরপুর টেকনিক্যাল স্কুল থেকে মৌসুমী রেফ্রিজারেটর এবং এয়ার কন্ডিশনারের ওপর ভোকেশনাল ট্রেনিং গ্রহণ করে। এখন সে একটি প্রতিষ্ঠানে ফ্রিজ ও এসির টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছে। ভাল বেতন পাচ্ছে। মৌসুমীর মতো হতাশাগ্রস্ত জীবন থেকে উঠে আসার গল্প বাংলাদেশের অনেক নারীর আছে। যদিও তাদের অসহায় অবস্থার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নন। দুর্ঘটনা বা স্বামীর প্রতারণায় যারা জীবনের এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়ান যখন নিজেদের উপার্জনহীন অবস্থার জন্য নিজেকে অকর্মণ্য বা অথর্ব মনে হয়। যা তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে। পুথিবীজুড়ে নারীদের শ্রমবাজারে অংশীদার হতে বা কর্মসংস্থানের যোগ্য করে তুলতে নানাবিধ বাধা-বিপত্তি এবং প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশের নারীদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাওয়া এবং দারিদ্র্যকে জয় করা খুবই কঠিন। ভোকেশনাল বা টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ পুরুষ শিক্ষার্থীদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত অনেক কম। আবার গুরুত্বপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ এসব কোর্সে নারীরা ভর্তি হতে চায় না। সামাজিক এবং নিজের ভেতরের এক ধরনের বাধা থেকে। কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের ২০১৯ সালের তথ্যানুযায়ী, কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীর হার বর্তমানে ১৫ শতাংশ। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে কারিগরি শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সরকার কারিগরি শিক্ষায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ছেলেমেয়েদের কারিগরিতে পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে সারাদেশে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। হেল্প ডেস্ক স্থাপন, এলাকায় মাইকিং করাসহ বিভিন্ন তৎপরতা চালানো হচ্ছে। সরকারী পলিটেকনিক্যালের আসন ছিল ৩১ হাজার ৭৮০টি। বর্তমানে এ আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৫৭ হাজার ৫০০টি করা হয়েছে। আশা করা যায় এসব উদ্যোগের ফলে কারিগরিতে মেয়েদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। বর্তমানে দেশে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ৭ হাজার ৭৭০টি। এর মধ্যে ১১৯টি সরকারী। সরকারীভাবে ছাত্রীদের জন্য ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনায় চারটি পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট আছে। ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য আরও তিনটি ইনস্টিটিউট ও প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে মেয়েদের টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়ন ও সম্প্রসারণে স্কিলস এ্যান্ড ট্রেনিং এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট ২০১০ সাল থেকে বাস্তবায়িত হচ্ছে। চলতি বছরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক হওয়ায় বিশ্বব্যাংক নতুন করে ১০ কোটি মার্কিন ডলার এবং এক বছর মেয়াদ বাড়িয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় সরকারী ৪৯টি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ১৬৩টি প্রতিষ্ঠানের সব নারী শিক্ষার্থীকে মাসে ৮০০ টাকা করে মাসিক বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। নারী এবং পিছিয়ে পড়া এলাকার মানুষকে স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের উপযোগী ও দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এ প্রজেক্টের আওতায় এ পর্যন্ত দেশের ৪ লাখ ২০ হাজার যুবক-যুবতী বিভিন্ন ট্রেনিং নিয়ে দেশ এবং বিদেশে নিজেদের দক্ষতা অনুযায়ী চাকরি পেয়েছেন। সরকার সারাদেশে উপজেলা পর্যায়ে ৩২৯টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ তৈরির প্রকল্প অনুমোদন করেছে। সরকারের উদ্দেশ্য হলো কারিগরি শিক্ষার পরিধি বাড়ানো। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আমরা এ প্রকল্পটি পাস করেছি, এর মূল লক্ষ্য হচ্ছেÑ কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে কর্মমুখী করে গড়ে তোলা। আর কারিগরি শিক্ষা দেশে ও বিদেশে সব জায়গাতেই কাজে লাগে। স্কুল ও কলেজ তৈরির কাজ এ বছর থেকেই শুরু হবে। সরকারী অর্থায়নে এ প্রকল্পে আন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি একটি করে কারিগরি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বর্তমানে বেশিরভাগ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রিক এ্যান্ড ইলেক্ট্রনিকস, মেকানিক্যাল, অটোমোবাইল, রেফ্রিজারেশন এ্যান্ড এয়ার কন্ডিশন মেইনটেনেন্স, পোশাক কারখানার ইন্ডাস্ট্রিয়াল সুইং চালনা, ওয়েল্ডিং ইত্যাদি বিষয়সমূহ পড়ানো হয়। বাংলাদেশে বেকারত্ব দূরীকরণে বহু বছর ধরে কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। সেই সঙ্গে প্রতিবছর শ্রমবাজারে নতুন করে ১৮ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক কোটি ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, যাদের একটি বড় অংশ অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ শ্রমিক। দক্ষতা বাড়ানোর সরকারী এ উদ্যোগের ফলে বিদেশে যেতে মানুষের আগ্রহ বাড়বে এবং দক্ষ শ্রমিক হিসেবে মানসম্মত কাজ ও বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারবে। গত দশ বছর বর্তমান সরকার বেশিসংখ্যক নারীদের শ্রমবাজারে প্রবেশের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১২ সালের মার্চে বাংলাদেশ দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচী গ্রহণ করে। যা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ওখঙ) কর্তৃক অনুমোদিত এবং এর পূর্ণ সহায়তা ও সমর্থন প্রাপ্ত। এই কর্মসূচী শ্রমশক্তিকে আরও দক্ষ করবে। পাশাপাশি ভোকেশনাল ট্রেনিং বা টেকনিক্যাল কোর্সে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষ এবং নারীর অনুপাতে যে অসমতা রয়েছে তা দূর করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নারীদের ‘নন ট্রাডিশনাল’ কোর্সে অন্তর্ভুক্ত করা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে এ কর্মসূচী। সরকারের দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচীর মাধ্যমে নারী প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য নারী প্রশিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ ভোকেশনাল ও ট্রেনিং কোর্সে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করার জন্য সচেতন করা হচ্ছে। বিগত ২০০১ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মহিলা টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার চালু হয়। মিরপুরে অনুষ্ঠিত এই মহিলা টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে তরুণীরা নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ পাচ্ছে। এখানকার কোর্স শেষ করা মেধাবী ছাত্রীরা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার সুযোগ পেয়ে থাকে। এখানে দুবছর মেয়াদি এসএসসি ভোকেশনাল ট্রেনিং কোর্স এবং সংক্ষিপ্ত কোর্সে ২১ দিন থেকে ৬ মাস পর্যন্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে ১০ হাজার ছাত্রী ভর্তির সুযোগ রয়েছে। এখান থেকে কোর্স শেষ করা শিক্ষার্থীরা ৭৫ থেকে ৯৫ শতাংশের ভাল চাকরির সুযোগ হয়েছে। টেকনিক্যাল এবং ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে সরকারের পাশাপাশি প্রচেষ্টা থাকতে হবে পরিবার এবং সমাজের। আশার কথা সরকারের ব্যাপক উদ্যোগের ফলে কারিগরি শিক্ষার প্রতি ঢাকার বাইরেও গ্রামীণ নারীদের আগ্রহ বাড়ছে। সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য সরকারের কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়াস পুরোপুরি সফল হলে বিদেশে যে বিপুল পরিমাণ নারী শ্রমশক্তির চাহিদা রয়েছে তা পূরণ করা সম্ভব হবে এবং নারীর ভাগ্যের পরিবর্তন দ্রুত হবে।
×