ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নাটেশ্বরে পিরামিড স্তূপ হতে যাচ্ছে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ২০ মার্চ ২০২০

নাটেশ্বরে পিরামিড স্তূপ হতে যাচ্ছে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ টঙ্গীবাড়ি উপজেলার নাটেশ্বরে উৎখননে দেশের সর্ববৃহৎ দুই হাজার বর্গমিটার আয়তনের পিরামিড আকৃতির বৌদ্ধস্তূপ আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি প্রায় ১২শ’ বছর আগের। এর ওপর রয়েছে প্রায় ৯শ’ বছরের প্রাচীন ইটের মন্দির। একই সঙ্গে দুটি নির্মাণ যুগের প্রাচীন এই নিদর্শন বিস্ময়কর। নান্দনিক স্থাপত্যটির অনেক রূপ ফুটে উঠেছে এখন। চারটি অংশ নিয়ে একটি স্তূপ হয়। ‘মেদি’, ‘অন্ড’, ‘হারমিকা’ ও ‘ছত্রাবলী’। এই স্তূপের নিচের দুটি অংশ ‘মেদি’ ও ‘অন্ড’র অস্তিত পাওয়া গেছে। তবে ‘হারমিকা’ ও ‘ছত্রাবলী’ আগেই ভেঙ্গে পড়ে বিনষ্ট হয়েছে। স্তূপের সদ্য আবিষ্কার ৪৪ মিটার দীর্ঘ দক্ষিণ বাহুটির ‘মেদি’র দেয়াল ৬৪ সেন্টিমিটার উঁচু এবং প্রশ্বস্ততা প্রায় ৩ মিটার। ‘অন্ড’ অংশে কোন কোন জায়গায় ৩ মিটার পর্যন্ত টিকে রয়েছে। দেয়ালের বাইরেরপাশের চারটি প্যানেলে বিভক্ত করে মনোরম নক্সা তৈরি করা হয়েছে। কেন্দ্র অংশ মাটি দ্বারা ভরাট করা হয়েছে। এর ফলে স্তূপটি নিরেট (সলিট) আকার ধারণ করেছে। আবিষ্কৃত পিরামিড আকৃতির স্তূপ স্থাপত্যের উচ্চতা প্রায় ৪৪.৬৪ মিটার। অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় এবং ঐতিহ্য অন্বেষণে গবেষণায় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে চলছে এই খনন কাজ। বিক্রমপুর অঞ্চলে ২০১০ সাল থেকে খনন শুরু হলেও এই নাটেশ^রে খনন শুরু ২০১৩ সাল থেকে। বিগত এই সাত বছরে খননেও নানা কিছু আবিষ্কার হয়েছে। বুধবার বিকেলে নাটেশ^রে এক সংবাদ সম্মেলনে এই আবিষ্কার তুলে ধরে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও খনন কাজের প্রকল্প পরিচালক ড. নূহ-উল-আলম জানান, বৌদ্ধ ধর্মে স্তূপটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য। স্তূপটি মুখ্যত সমাধি। তবে এটি বৌদ্ধ ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতিকেও প্রতিনিধিত্ব করে। এই স্থাপত্যের মাধ্যমে গৌতম বুদ্ধ ও তার প্রবর্তিত বৌদ্ধ ধর্মকে প্রতীকায়ন হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়। স্তূপটি স্থাপত্যের মূল অংশ ‘অন্ড’ সাধারণত গম্বুজাকৃতি হয়। কিন্তু নাটেশ্বরে আবিষ্কৃত স্তূপটি ব্যতিক্রমী ও দুষ্প্রাপ্য পিরামিড আকৃতির। দুষ্প্রাপ্য পিরামিড আকৃতিই নিজে একটি তাৎপর্য বহন করে এবং বাংলাদেশে এটিই প্রথম। অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের জন্মভূমি বিক্রমপুর; প্রায় ১২০০ বছরের প্রাচীন। ২০০০ বর্গমিটার আয়তনের একটি স্তূপ আবিষ্কার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বিশালত্বের দিক থেকে এটি সাঁচি, ভারহুত, অমরাবতী, সারনাথের পৃথিবী বিখ্যাত মহাস্তূপগুলোর সঙ্গে তুলনীয়। বাংলাদেশে এত বড় আর কোন স্তূপ নেই। একের পর এক আবিষ্কারের কারণে নাটেশ^র হতে যাচ্ছে বিশ^ ঐতিহ্যের অংশ। তিনি জানান, বিগত দু’বছর চীনের গবেষকগণ যৌথভাবে এই খননে অংশ নেয়। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের কারণে অংশ নিতে পারেনি। তিনি আরও জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নাটেশ্বরের দেউলে খননের মাধ্যমে দেশের সর্ববৃহৎ পিরামিড আকৃতির নান্দনিক স্তূপের দক্ষিণ পাশের ৪৪ মিটার দীর্ঘ এ বাহু নতুনভাবে আবিষ্কার হয়েছে। এর আগে গত দু’বছর এ স্থাপত্যটির উত্তর ও পূর্ব বাহুর অংশবিশেষ উন্মোচিত হয়। এবছর উৎখননে দক্ষিণ বাহুটির প্রায় পুরো অংশ উন্মোচিত হয়। তিনি জানান, পিরামিড আকৃতির স্তূপটির সময়কাল জানার জন্য আমেরিকার বেটা এনালাইটিক ইনক ল্যাবে পাঠানো হয়। কার্বন-১৪ তারিখ নির্ণয়ের মাধ্যমে জানা যায় স্তূপটি ৭৮০-৯৫০ খ্রিস্টাব্দ মধ্যের। ইতোমধ্যে মেদির চারপাশে ইট বিছানো প্রদক্ষিণ পথের চিহ্নও আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রদক্ষিণ পথটি এখনও ২.৫ মিটার টিকে আছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই পথ আরও প্রশস্ত ছিল। বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রতœতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, প-িত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জীবনীগ্রন্থে উল্লেখিত নগর ও অট্টালিকার সঙ্গে নাটেশ্বরে আবিষ্কৃত বিশাল আকৃতির স্তূপের অনেকটা মিল পাওয়া গেছে। অতীশ দীপঙ্করের জীবনীতে লেখা হয়েছিল ‘‘ভারতের পূর্বদিকে একটি দেশ আছে, যার নাম জিয়া বাং লাও। সেই নগরে হাজার হাজার ভবন রয়েছে। নগরের প্রাসাদটি সোনার অলঙ্করণে সাজানো। সাম্প্রতিক প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণায় আবিষ্কৃত বিশাল আকৃতির পিরামিড আকৃতির স্তূপ তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ সময় তিনি আরও বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে খনন ও গবেষণা কাজের জন্য যে অর্থ পাওয়া যাচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। সহযোগিতার পরিমাণ বাড়ানো হলে খনন কাজ আরও বেগবান হবে। স্তূপ সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়া যাবে। তিনি জানান, বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রতœতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণায় ৯টি প্রতœস্থানে পরীক্ষামূলক উৎখনন কাজ পরিচালনা করা হয়। এতে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়নের রঘুরামপুর গ্রামে বিক্রমপুরী বৌদ্ধ বিহারের ৬টি ভিক্ষু কক্ষ, একটি ম-প ও পঞ্চস্তূপ আবিষ্কৃত হয়। ২০১৩ সাল থেকে প্রায় ১০ নাটেশ্বর দেউলে প্রতœতাত্ত্বিক খননে বেরিয়ে আসতে থাকে বৌদ্ধ মন্দির, অষ্টকোণাকৃতি স্তূপ, ইট-নির্মিত রাস্তা, ইট-নির্মিত নালা প্রভৃতি। ২০১৩-২০১৯ পর্যন্ত উৎখননে ছয় হাজার বর্গমিটারের বেশি এলাকা উন্মোচিত হয়েছে। ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মেদি, অন্ড, হারমিকা ও ছত্রাবলীÑ স্থাপত্যের ইতিহাসে এই শব্দগুলো ব্যবহার হয়েছে। এই চারটি অংশ নিয়ে একটি স্তূপ হয়। স্তূপটির মূল স্থাপত্যে চারদিকে প্রদক্ষিণ পথ পাওয়া গেছে। এই পথও আকর্ষণীয়। তিনি জানান, সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তাদের এবারের আবিষ্কার ঘোষণা করা হলো। সামনে বৃষ্টি-বাদলের দিন। তাই খনন ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সাময়িকভাবে এটি মাটি-বালুর বস্তা দিয়ে ঢেকে বৃহস্পতিবার থেকেই সংরক্ষণ করা হবে। পরবর্তী অর্থ সংগ্রহ সাপেক্ষে এটি আগামী শুষ্ক মৌসুমে সংরক্ষণ করে প্রদর্শন করা হবে। একই সঙ্গে ১০ একর এই দেউলের অন্যান্য অংশে খনন অব্যাহত থাকবে বলেও তিনি জানান। তিনভাগের একভাগ খনন করা গেছে। যত খনন হচ্ছে ততই আবিষ্কার হচ্ছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
×