ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফের প্রশ্নবিদ্ধ বুক বিল্ডিং পদ্ধতি

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ১৯ মার্চ ২০২০

ফের প্রশ্নবিদ্ধ বুক বিল্ডিং পদ্ধতি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ২০১০ সালের ভয়াবহ ধসের পর বাজারে শেয়ার ছাড়তে বুক বিল্ডিং পদ্ধতি প্রচলনের সুপারিশ করা হয়েছিল। কমিটির সুপারিশ মেনে এই পদ্ধতি চালুও করা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের এই পদ্ধতিতেও শেয়ারের দর নির্ধারণে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। কয়েক দফা সংশোধন করা হলেও এই বুক বিল্ডিং পদ্ধতি এখনও পুঁজিবাজার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের যোগসাজশে অর্থ লোপাটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ আছে, ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে মহাধসের আগে ২০০৯ সালে এই বুক বিল্ডিং পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটেছিল অসাধু চক্র। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্টেও উঠে আসে, ধসের অন্যতম কারণ ছিল এই বুক বিল্ডিং। ফলে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই সময় বুক বিল্ডিংয়ের কার্যক্রম বন্ধ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ব্যাপক সমালোচনার মুখে বন্ধ হওয়া বুক বিল্ডিং পদ্ধতি ২০১৬ সালে আবার নতুন করে চালু হয়। তবে বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। ফলে কয়েক দফা পরিবর্তন করা হয় পদ্ধতিটি। এরপরও বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না। সর্বশেষ একটি বিডিংয়ের পর পদ্ধতিটির নীতিমালা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা আবারও বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে সংশোধন আনার দাবি জানিয়েছেন। সম্প্রতি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারবাজারে আসতে বিডিং (নিলাম) সম্পন্ন করা কোম্পানিটির কাট-অফ প্রাইস নির্ধারিত হয়েছে ৩১৫ টাকা। ফলে কোম্পানিটি আইপিওতে মাত্র দশমিক ৯২ শতাংশ শেয়ার ছাড়বে। এই নামমাত্র শেয়ার ছাড়ার কারণে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। এর আগেও বসুন্ধরা পেপার ৮০ টাকা, এডিএন ২৭ টাকা এবং আমরা নেটের বুক বিল্ডিংয়ের অস্বাভাবিক দর উঠেছিল। বিএসইসির পাবলিক ইস্যু রুল অনুযায়ী, শুধু ফেসভ্যালুতে পুঁজিবাজারে আসতে হলে একটি কোম্পানিকে পরিশোধিত মূলধনের কমপক্ষে ১০ শতাংশ অথবা ৩০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি সেই পরিমাণ শেয়ার ছাড়তে হবে। অর্থাৎ ফেসভ্যালুতে পুঁজিবাজারে আসতে একটি কোম্পানিকে কমপক্ষে তার ১০ শতাংশ শেয়ার আইপিওতে ছাড়তে হবে। অপরদিকে প্রিমিয়াম নিতে হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আসতে হবে। এক্ষেত্রে যোগ্য বিনিয়োগকারীরা বিডিংয়ে অংশ নিয়ে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করবেন। তবে এই বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে কোম্পানিকে কমপক্ষে কত শতাংশ শেয়ার ছাড়তে হবে তার কোন নীতিমালা নেই। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমি সবসময় বলে এসেছি আইপিওতে একটি কোম্পানির কমপক্ষে ১০ শতাংশ শেয়ার আসতে হবে। একটি কোম্পানি যদি আইপিওতে ১-২ শতাংশ শেয়ার ছাড়ে তাতে বাজার উপকৃত হবে না। বরং শেয়ারের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে দাম অতিমূল্যায়িত হবে। অতিরিক্ত দামে শেয়ার কেনার কিছুদিন পর দাম কমতে থাকবে এবং বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এমন শেয়ার আইপিওতে ছাড়ার সুযোগ দেয়া উচিত হবে না। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স এ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোঃ বখতিয়ার হাসান বলেন, আইপিওতে একটি কোম্পানি ১ শতাংশেরও কম শেয়ার ছাড়বে এটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আইপিওতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ শেয়ার ছাড়ার বিধান করতে হবে। তিনি বলেন, আইপিওতে নামমাত্র শেয়ার ছাড়ার সুযোগ দিলে তাতে কোম্পানি উপকৃত হবে। এর জন্য বাজার বা বিনিয়োগকারী উপকৃত হবে না। বরং ক্ষতির মুখে পড়বে। সুতরাং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে নীতিমালায় পরিবর্তন এনে কমপক্ষে ১০ শতাংশ শেয়ার ছাড়া বাধ্যতামূলক করা উচিত। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মোঃ রকিবুর রহমান বলেন, আমি মনে করি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আইপিওতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ শেয়ার ছাড়তে হবে। নইলে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির বিশ্বাসযোগ্যতা আসবে না। এটা হবে আমাদের বুক বিল্ডিং পদ্ধতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। ‘আমি আশা করি, অবিলম্বে বিএসইসি এই নীতিমালার সংশোধন করবে এবং পরবর্তীতে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে যে কোম্পানি আসবে তাকে আইপিওতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ শেয়ার ছাড়তে হবে।’ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের আরেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, আমি মনে করি, আইপিওতে একটি কোম্পানির কমপক্ষে ১০ শতাংশ শেয়ার আসতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে নীতিমালা সংশোধন করতে হবে। একটি কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে ১-২ শতাংশ শেয়ার ছাড়লে বাজার উপকৃত হবে না। উল্টো তার দাম অতিমূল্যায়িত হবে এবং বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করে ক্ষতির মুখে পড়বেন। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রশিদ চৌধুরী বলেন, এই কমিশন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কাজ না করে কোম্পানির স্বার্থে কাজ করছে। একটা কোম্পানি বাজারে মাত্র ১ শতাংশ শেয়ার ছাড়লে তাতে বিনিয়োগকারীদের কী উপকার হবে? আমরা মনে করি, কোন কোম্পানিকে ১০ শতাংশ কম শেয়ার আইপিওতে ছাড়তে দেয়া যাবে না। সেই সঙ্গে বাই-ব্যাক আইন কার্যকর করতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ এই কমিশনকে অবিলম্বে পুনর্গঠন করতে হবে।
×