ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কোটি কোটি কৃতজ্ঞ বাঙালীর তীর্থস্থান আজ টুঙ্গিপাড়া

প্রকাশিত: ১১:৩৪, ১৭ মার্চ ২০২০

কোটি কোটি কৃতজ্ঞ বাঙালীর তীর্থস্থান আজ টুঙ্গিপাড়া

উত্তম চক্রবর্তী ॥ “দাঁড়াও পথিকবর যথার্থ বাঙালী যদি তুমি হও/ ক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাও, এই সমাধিস্থলে/ এখানে শুয়ে আছেন, বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা...”। গ্রামের নাম টুঙ্গিপাড়া। বাঘিয়ার-মধুমতী নদীতীরে সবুজে ঘেরা এক সময়ের দুর্গম অজপাড়াগাঁ। এইখানে ঘুমিয়ে আছেন বাঙালীর মহানায়ক। সপরিবারে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের ¯্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর একাত্তরের পরাজিত শত্রু ও তাদের এদেশীয় হন্তারক সামরিক কুলাঙ্গাররা চেয়েছিল তাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মানুষের চোখের আড়াল করতে। তাই বঙ্গবন্ধুর দেহ দ্রুত ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে কবর দেয় তারা। ঘাতকরা ভেবেছিল, দুর্গম এই পথ মাড়িয়ে কে আর তাঁর (জাতির পিতা) খোঁজ রাখতে যাবে? কিন্তু স্বাধীনতার শত্রু এসব ঘৃণ্য ঘাতকের আশা পূরণ হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর টুঙ্গিপাড়াকে দীর্ঘ একুশটি বছর নানা অবহেলা-অযতেœ ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হলেও সেখানে যে ঘুমিয়ে রয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়ী মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। যাঁর ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে এই ভূখ-ের মানুষ হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে এনেছিল স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। আমরা পেয়েছিলাম নিজস্ব জাতিরাষ্ট্র, গর্বিত আত্মপরিচয়। বাঙালী নামক নরপিশাচ-বেঈমান ঘাতকরা ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষের দেহ থেকে প্রাণটুকু কেড়ে নিতে পারলেও বাঙালীর হৃদয় থেকে এতটুকু মুছে ফেলতে পারনি। বরং নানা প্রতিকূলতা, বাধার সৃষ্টি করেও বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমি টুঙ্গিপাড়ায় কৃতজ্ঞ বাঙালীর ঢল কোনদিনই থামাতে পারেনি একাত্তরের খুনীদের দোসর ও পরবর্তী সামরিক স্বৈরশাসকরা। সময়ের ব্যবধানে অসম্ভব দুর্গম সেই অজপাড়াগাঁ টুঙ্গিপাড়া আজ কোটি কোটি কৃতজ্ঞ বাঙালীর প্রাণের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমিতে তাই প্রতিদিন হাজারো মানুষের ভিড়- শ্রদ্ধায়, অবনতচিত্তে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিসৌধে দাঁড়িয়ে বাঙালী স্বচক্ষে অবলোকন করেন বাংলার রূপকে। আর এই কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতির হৃদয়ের শ্রদ্ধা আর শক্তির মধ্যেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী ও ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকবেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম। কারণ বাঙালী ও বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কালজয়ী নাম। বিশ্ববাঙালীর গর্ব, মৃত্যুঞ্জয়ী মহামানব। তিনি বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও বাঙালী মানসে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির নির্মাতা। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালী জাতির জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর টুঙ্গিপাড়া যেতে সেই দুর্গম পথও আর নেই। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীর এই জন্মভূমিতেই শুধু নয়, দেশের সর্বত্র লেগেছে এখন উন্নয়নের ছোঁয়া। আগে ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়া যেতে আড়াই থেকে তিন দিন সময় লাগত, তাও আবার নদীপথে। এখন জাতির পিতার জন্মভূমিতে যাওয়ার পথে নির্মিত হয়েছে বিশ্বমানের মহাসড়ক, আন্তর্জাতিকমানের দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হলে ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্মভিটায় যেতে সময় লাগবে মাত্র দু’থেকে আড়াই ঘণ্টা। আজ মঙ্গলবার জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। পুরো জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রদ্ধা জানাবে বাংলাদেশ নামক ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের মহান স্থপতি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। একটি পৌরসভা ও পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মাত্র ১২৭ দশমিক ২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার নামকরণে রয়েছে অভিনবত্ব। টং থেকে টঙ্গ বা টুঙ্গি। জনশ্রুতি আছে পারস্য থেকে আসা সুফিসাধক জলমগ্ন এ এলাকায় টং-এর ওপর ঘর করে বসবাস শুরু করেন। সেই থেকে এলাকার নাম টুঙ্গিপাড়া। আয়তনে ছোট এবং নামে অবিনবত্ব থাকলেও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টুঙ্গিপাড়ার রয়েছে গৌরবদীপ্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এই গ্রামের শ্যামলিমায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ সম্ভ্রান্ত শেখ বংশের শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুন দম্পতির ঘর আলো করে খোকা নামে যে শিশুটি জন্ম নেয়, তিনি বাঙালীর হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পর হিমালয়সম এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষটি ঘাতকের বুলেটে বুকে রক্তজবা এঁকে ফিরে আসেন ফের নিজ জন্মভিটায়। মানুষের হৃদয় থেকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই সন্তানকে চিরতরে মুছে ফেলতে এবং লোকচক্ষুর আড়াল করতে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ ঢাকা থেকে এনে তৎকালীন দুর্গম এলাকা টুঙ্গিপাড়ায় বাবা-মায়ের কবরে অনেক অবহেলায় দাফন করেছিল। কিন্তু সকল দুর্গম-ব্যূহ ও চক্রান্তের জাল ভেদ করে প্রত্যন্ত সেই টুঙ্গিপাড়া হয়ে উঠেছে বাঙালীর প্রাণের তীর্থ। স্বাধীনতার আগে টুঙ্গিপাড়ায় যাতায়াত যে কত দুর্গম ও দুর্ভেদ্য ছিল, তা ওই সময় বঙ্গবন্ধুর এক চিঠিতেই প্রমাণ মেলে। ১৯৫০ সালে ফরিদপুর কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে লেখা এক চিঠিতে লিখেছিলেন- আমাকে ফরিদপুর জেল থেকে গোপালগঞ্জ আদালতে হাজিরা দিতে হয়। ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ একবার যেতে সময় লাগে ৬০ ঘণ্টা। আর গোপালগঞ্জ থেকে তখন টুঙ্গিপাড়ায় যেতে কত সময় লাগত? ওই এলাকার অশীতিপর বৃদ্ধদের মতে, হেঁটে গেলে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা, আর নৌকায় গেলে আরও বেশি। টুঙ্গিপাড়া ছিল তখন একেবারে অজপাড়াগাঁ। কোন রাস্তাঘাট ছিল না। কিন্তু ছিল নদী। মধুমতী নদী বয়ে যাচ্ছে একপাশ দিয়ে। আর আছে শাখানদী বাঘিয়ার। আছে কাটাগাঙ। সেই নদী দিয়ে স্টিমার চলত। স্টিমারে করেই খুলনা; সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা। স্টিমারে করেই ঢাকা সদরঘাট। তখনকার যুবনেতা শেখ মুজিব এভাবেই টুঙ্গিপাড়া থেকে কলকাতা অথবা ঢাকায় যাতায়াত করতেন। টুঙ্গিপাড়া আজ আর দুর্গম কিংবা অখ্যাত নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান আর সমাধিস্থল এই টুঙ্গিপাড়া। বিবিসির জরিপে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। তিনি আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি। প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর পিতৃপুরুষ জমিদার শেখ কুদরতউল্লা আধুনিক স্থাপত্যের আদলে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে পৈত্রিক এ বাড়িটি নির্মাণ করেন। তখন ইটের তৈরি ঘর, পাকা মেঝে। উপরে ঢেউটিনের চৌচালা। এই রকম একটা ঘরে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম হয়েছিল ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর। পিতৃপুুরুষরা কোঠাবাড়ি বানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শৈশবের নাম ছিল খোকা। বঙ্গবন্ধু যে ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন, সেই ঘরটা এখন নেই। ১৯৭১ সালের ১৯ মে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সেই বাড়িতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। হানাদাররা ওই সময় গ্রামের ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হলে সেখানে নির্মিত হয় দোতলা ঘর। এখন সেটা হয়েছে তেতলা। পিতৃপুরুষদের আদি বাড়ি সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন- ‘শেখ বংশের যে একদিন সুদিন ছিল, তার প্রমাণস্বরূপ মোগল আমলে ছোট ইটের দ্বারা তৈরি চকমিলান দালানগুলি আজও আমাদের বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি করে আছে। বাড়ির চারভিটায় চারটা দালান। বাড়ির ভিতরে প্রবেশের একটা মাত্র দরজা, যা আমরাও ছোট সময় দেখেছি বিরাট একটা কাঠের কপাট দিয়ে বন্ধ করা যেত।’ শুধু বঙ্গবন্ধুই নন, তাঁর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যেও উঠে আসে দুর্গম টুঙ্গিপাড়ার সেই সময়কার বাস্তব চিত্র। ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত নির্মিত বিশ্বমানের এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন- ‘আমরা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। আমরা ছিলাম সব থেকে অবহেলিত। ফরিদপুরের এই ভাঙ্গা পর্যন্ত যেতে হলে এক সময় স্টিমার বা লঞ্চে যেতে হতো। আর স্টিমারে গোপালগঞ্জ যেতে গেলে সময় লাগতো ২৪ ঘণ্টা। লঞ্চ হলে আরও বেশি সময় লাগতো। এমনকি ১৯৮১ সালে যখন দেশে ফিরে আসি, তখনও একই অবস্থা ছিল। আজকে সেদিন আর নেই। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ হয়েছে। পদ্মা সেতু হলে ঢাকা থেকে দ্রুত টুঙ্গিপাড়ায় যেতে পারবো।’ হাজার বছরের নিপীড়িত, নিগৃহীত, বঞ্চিত বাঙালী জাতির জন্য জীবনজয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বকালকে উৎসর্গ করেছিলেন ইতিহাসের মহিমান্বিত মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাঁর ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে এই ভূখ-ের মানুষ হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। আমরা পেয়েছিলাম নিজস্ব জাতিরাষ্ট্র, গর্বিত আত্মপরিচয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাস কারাগারে বন্দী রেখেও পাকিস্তানী জল্লাদরা বঙ্গবন্ধুর কেশাগ্র পর্যন্ত স্পর্শ করার সাহস দেখাতে পারেনি। কিন্তু নিজ স্বাধীন দেশেই একাত্তরের পরাজিত শত্রু এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সপরিবারে হত্যাকা-ের শিকার হন ইতিহাসের এই মহানায়ক। কিন্তু জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব আরও বেশি শক্তিশালী, তা আজ প্রমাণ হয়েছে। ’৭৫-এ একাত্তরের পরাজিত শক্তির ঘৃণ্য সর্বনাশা চক্রান্তে একদল পৈশাচিকের বলি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার। রচিত হয়েছিল ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। এরপরও বাঙালীর হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে কতই না ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চালায় সামরিক লেবাস নিয়ে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক স্বৈরশাসক ও গণতন্ত্রের লেবাসধারী পাকিস্তানের পেতাত্মারা। বঙ্গবন্ধুর জন্মভিটা বলেই ’৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ একুশটি বছর টুঙ্গিপাড়ায় কোন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। এই দীর্ঘ সময়ই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মহান এই স্থপতির জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়া ছিল অবহেলিত, উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত। যার একটাই লক্ষ্য ছিল কৃতজ্ঞ বাঙালীর হৃদয় থেকে জাতির পিতার নাম মুছে ফেলা। সেটা ছিল খুবই কাল একটি সময়। বঙ্গবন্ধুর নাম নিতেও ছিল অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। বঙ্গবন্ধুর কবর পাহারা দিতে রাখত সঙ্গিনধারী। মৃত মুজিবকেও তাদের বড় ভয়। তাঁর কবরের গায়ে কোন নামফলকও ছিল না। দু’তিন বছর কবরটা কাঁচাই ছিল। তারপর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সেটা পাকা করে তাতে বঙ্গবন্ধুর নামফলক স্থাপন করে। ১৯৯৪-৯৫ সালে শেখ হাসিনা তখনও বিরোধীদলের নেত্রী। তিনি ও শেখ রেহানা; বঙ্গবন্ধু পরিবারের দুজন মাত্র জীবিত সদস্য। তাঁদের ৩২ নম্বরের ধানম-ির বাড়ি আর টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির সম্পদ ও সম্পত্তি দান করে দেন বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টকে। তার মাধ্যমে গড়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, বঙ্গবন্ধুর সম্পদ হয়ে ওঠে জাতির সবার। সকল ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায় আসে জাতির পিতার হাতে গড়া রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। এরপরই টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৯৯ সালের ১৭ মার্চ সমাধিসৌধের নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ৩৮ দশমিক ৩০ একর জমির ওপর ১৭ কোটি ১১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ব্যয়ে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সহযোগিতায় প্রতœতত্ত্ব বিভাগ এ সমাধিসৌধ নির্মাণ করে। লাল, সিরামিক ইট আর সাদা-কালো মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত এ সমাধিসৌধের কারুকাজে ফুটিয়ে তোলা হয় বেদনার চিহ্ন। কমপ্লেক্সের সামনে, দুই পাশের উদ্যান পেরোনোর পরই বঙ্গবন্ধুর সমাধি। পাশে তাঁর বাবা ও মায়ের সমাধি। এই তিন সমাধি নিয়েই গড়ে উঠেছে গোলাকার গম্বুজবিশিষ্ট মূল সমাধিসৌধ। সমাধিসৌধের উপরের দেয়ালে জাফরি কাটা। সব সময় আলো-ছায়ার মায়াবী খেলা সেখানে। উপরে থাকা কারুকাজ করা কাঁচের ভেতর দিয়েও আলো ছড়িয়ে পড়ে সমাধিতে। চারদিকে কালো মাঝখানে সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধি বাঁধানো। চমৎকার স্থাপত্য দিয়ে সমাধিকে আবৃত রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু মাটি থেকে উঠে আসা এই মাটির সন্তান। তাই প্রাকৃতিক আলো ও বাতাস প্রবেশ করে বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধকে যেন এক স্বর্গীয় রূপ পায়। আর সৌধের বাইরে তৈরি করা ঝরনার পানি পড়ার শব্দ। যেন অগণন বেদনা আর আর্তনাদ মিশে আছে ওই প্রপাতে। বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে ঢুকতে কোন প্রবেশ মূল্য দিতে হয় না। সমাধিসৌধের প্রদর্শন গ্যালারিতে ঘুরে ঘুরে শ্রদ্ধা জানাতে আসা কৃতজ্ঞ বাঙালীরা অবলোকন করেন জাতির পিতার জীবনের বিভিন্ন সময়ের ছবি। রয়েছে একটি পাঠাগারও। শুধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স নয়, এর আশপাশের এলাকাতেও অনেক কিছু দেখার রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদি পৈত্রিক বাড়ি, ছোটবেলার খেলার মাঠ, বঙ্গবন্ধুর স্কুল, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বালিশা আমগাছ, শেখ বাড়ির জামে মসজিদ (স্থাপিত ১৮৫৪ সাল)। আছে হিজলতলা ঘাট, যেখানে বঙ্গবন্ধু ছোটবেলায় গোসল করতেন। দেখা মিলবে শেখ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী একটি বড় ও একটি ছোট আকারের পুকুর এবং বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের পাশেই নির্মিত শেখ রাসেল শিশু পার্ক। আসলে পুরো টুঙ্গিপাড়াকেই বদলে দিয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স। প্রতিদিনই শ্রদ্ধা জানাতে আসা অগণিত দেশী-বিদেশী মানুষের ভিড়। প্রতিদিনই মানুষ ছুটে আসেন তাদের প্রিয় নেতা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। এ কারণে সেখানে গড়ে উঠেছে একাধিক হোটেল-মোটেল, পর্যটন কেন্দ্র, বড় বড় স্থাপনা। দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসা মানুষ স্বাধীনতার মহানায়কের জন্মভিটায় শ্রদ্ধা জানাতে এসে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি, তাঁর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন, সুমহান আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানতে পেরে নতুন শপথে উজ্জীবিত হন। মুজিব আদর্শের সৈনিকরা বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, তাঁর জন্য কাঁদেন এবং বিশেষ মোনাজাত করেন প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে। আর সে কারণেই একদা দুর্গম অজপাড়াগাঁ টুঙ্গিপাড়া আজ স্বাধীনতার পক্ষের কোটি কোটি মানুষের প্রাণের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে।
×