ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কোয়ারেন্টাইন যথাযথ হচ্ছে না, ঝুঁকিপূর্ণ দেশ

প্রকাশিত: ১১:৩২, ১৭ মার্চ ২০২০

কোয়ারেন্টাইন যথাযথ হচ্ছে না, ঝুঁকিপূর্ণ দেশ

আজাদ সুলায়মান ॥ করোনার কোন ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়ায় এখন পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইনই প্রতিরোধের একমাত্র পথ। বাংলাদেশও কোয়ারেন্টাইনকেই প্রাধান্য দিয়ে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করলেও এ নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যে ৮ জন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে দুই জন ইতালি ফেরত। তারা ইতালি থেকে এই ভাইরাস বহন করে এনেছেন। বাকি ৬ জন তাদের সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন। এই দুই ইতালি ফেরত ব্যক্তিকে সঠিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা গেলে বাকিরা আক্রান্ত হতেন না। সরকারীভাবে হোম কোয়ারেন্টাইনের কথা জোর দিয়ে বলা হলেও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অভিযোগ আসছে, যেসব রোগী ঘরে থাকার কথা তারা স্বাভাবিক কাজকর্মে মিশে যাচ্ছে সমাজে। ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে ফিরে সকলকে সর্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখার তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগই চোখে পড়ছে না। এতে শুধু বিদেশ ফেরত মানুষই নয়, গোটা সমাজকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারী কোয়ারেন্টাইন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে বিদেশ থেকে যাত্রীরা আসার পর প্রথমেই নেয়া হয় আশকোনা হজ ক্যাম্পে। ক্যাম্পে অবস্থানকারী অনেকেই ওখানকার পরিবেশ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। কোয়ারেন্টাইনের যেসব শর্ত সরকারী বিধিমালায় দেখানো হচ্ছে ওই ক্যাম্পে তাও নিশ্চিত নয়। কয়েক মাস ধরে করোনা নিয়ে অনেক আলোচনা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে অথচ প্রাথমিক কোয়ারেন্টাইনের স্থানটিই উপযোগী করে তোলা যায়নি। সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলো যথাসাধ্য বলা হলেও বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন গ্রামে নিজ বাড়িতে হোম কোয়ারেনটাইন নিয়ে। বিদেশ ফেরত যাত্রীদের বিমানবন্দরে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কোন ধরনের লক্ষণ না থাকলেও অন্তত ১৪ দিন হোম কোয়ারেনটাইনে থাকার নিশ্চয়তায় প্রায় দুই সহ¯্রাধিককে ঘরে ফিরতে দেয়া হয়। ভয়টা তাদের নিয়েই। তারা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার আশ্বাস দিয়ে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। অনেককেই বাজারে, বাইরে, সভা-সমিতি এমনকি বনভোজনেও যেতে দেখা যাচ্ছে। বিদেশ ফেরত অনেকেই বলছেন, বাড়ি যাবার পরও তাদের কাছে কোন স্বাস্থ্যকর্মী বা প্রশাসনিক কেউ যাননি। শরিয়তপুরের ইতালি ফেরত এক প্রবাসী তো জোর দিয়েই বলছেন, আমি সুস্থ আছি। কেন থাকব বদ্ধ ঘরে। একটি সংবাদ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নরসিংদীর পলাশ উপজেলার একটি গ্রামে সম্প্রতি কয়েকজন ইতালি থেকে ফিরেছেন। একজন এসেছেন এক সপ্তাহ আগে। তারা এলাকায় ঘোরাফেরা করায় আশপাশের মানুষের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করছে। ওই গ্রামের একজন বাসিন্দাকে উদ্ধৃত করে তারা বলছে, তারা বাজারে যাচ্ছে, চায়ের দোকানে আড্ডা মারছে। তারা আমাদেরই আত্মীয়-স্বজন। এ কারণে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করলেও চক্ষুলজ্জায় কেউ কিছু বলছে না। কিন্তু সবার মধ্যেই একটা অস্বস্তি-আতঙ্ক কাজ করছে। হয়ত তারা এই রোগের জীবাণু বহন করছেন না, তারপরও সতকর্তা হিসেবে বাড়িতে অবস্থান উচিত ছিল। একটি টিভি চ্যানেল মানিকগঞ্জের একটি গ্রামে সরেজমিন ঘুরে সংবাদ দিয়েছে, ওই গ্রামে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে ফিরেছেন অন্তত ১২ জন। কোয়ারেন্টাইনের শর্তে তাদের বাড়ি পাঠানো হলেও তারা সমাজে মিশে গেছেন। কেউ নিজের গৃহস্থালি কাজে যোগ দিয়েছেন, কেউ কেউ বাজারে যাচ্ছেন, দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। এদের সতর্ক করা কিংবা শর্তের কথা মনে করিয়ে দেয়ার মতো কেউ নেই। আরও বিভিন্ন জেলায় বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের অবাধ বিচরণের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ নজরুল এ সম্পর্কে বলেন, বিদেশ ফেরতরা যদি হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম সঠিকভাবে পালন করেন, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আমরা যাদের বাড়িতে থাকতে বলছি, তারা সেটা ঠিকভাবে পালন করতে পারছে কিনা। এই অসচেতনতার কারণে রোগ দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এই ভাইরোলজিস্ট। আবার বাংলাদেশের বাড়িগুলোতে কোয়ারেন্টাইন সফল হবে কিনা, তা নিয়ে তার ঘোর সংশয় রয়েছে। বাসায় কোয়ারেন্টাইনের সময় কেউ না কেউ তাকে সেবা-শুশ্রƒষা করছে। যারা এ কাজটা করছে তারা তো প্রশিক্ষিত না, বাসারই লোক। তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণও নেই। সেবাদানকারী পার্সোনাল প্রটেকশন না নিলে তারাও ইনফেক্টেড হয়ে যেতে পারে। হোম কোয়ারেন্টাইনে এই ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞরা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের অনেক ঘাটতি রয়েছে বলে দাবি করছেন বিদেশ ফেরত যাত্রীরা। তাদের মতে- চিকিৎসা শাস্ত্রের সংজ্ঞানুসারে কোয়ারেন্টাইনের প্রকৃত অবস্থা আশকোনা হজ ক্যাম্পে নেই। বিমানবন্দরের সামনে অত্যাধিক ঘনবসতি এলাকার এই ক্যাম্প প্রকৃত অর্থে একটি আবাসিক ক্যাম্প বলা চলে। এখানে শুধু হজের মৌসুমে হজযাত্রীরাই থাকেন না। সারাবছর এ্ই ক্যাম্পে সপরিবারে বসবাস করছেন এখানে কর্মরত বেশ কজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের বাইরে এ ক্যাম্পে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, হজ অফিস, বিজনেস আইটি অফিস, হাব, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বিমান ও আরও কটি ব্যাংকের সর্বক্ষণিক অফিস। সারাবছর সারাক্ষণই এখানে মানুষের ভিড়ভাট্টা লেগে থাকে। এমন পরিবেশে তিন দোতলা ও তিন তলার বড় দুটো হলরুমের ফ্লোরে ম্যাট বিছিয়ে পাশাপাশি গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছে উহান ফেরত ৩১২ বাংলাদেশীকে। তাদের মতো একইভাবে ইতালি ফেরত ১৪২জনকে থাকতে হবে এটা শুনেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তারা। ওখানে অবস্থানকারী একজন ফোনে তার অভিভাবককে জানান, মশা ও পোকা মাকড়ের উৎপাতে দিনেই অবস্থা খারাপ। রাতে কেমন হবে সেটার ব্যাখ্যা না শোনার অনুরোধ করেন। মেঝেতে পাশাপাশি থাকার ঝুঁকি তো আরও বেশি। যদি কারোর শরীরে সুপ্ত অবস্থায় করোনাভাইরাস থেকে থাকে তাহলে সেটাতে সংক্রমিত ঝুঁকিও থাকে। পরিস্থিতি যদি এমনই থাকে তবে প্রশ্ন উঠেছে, গত দুই মাসে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে প্রস্তুতির কথা বলে আসছে, সেটি কি। যেখানে করোনা প্রতিরোধে প্রধান উপায় কোয়ারেন্টাইন সেখানে দুই মাসে সরকার কি প্রস্তুতি নিয়েছে। রাজধানীতে সর্বশেষ গত শনিবার পূবাইলে চালু করা হয়েছে একটি অস্থায়ী কোয়ারেন্টাইন। যা তুলনামূলক অত্যন্ত নির্জন, নিরিবিলি ও জনমানবশূন্য এলাকায়। ইতালি থেকে গত দুদিনে ফেরত আসা দেড় শতাধিক রোগীকে পাঠানো হয়েছে ওখানে। জানা গেছে, টঙ্গী এজতেমা ময়দানেও চলছে একটি সেন্টার স্থাপনের কাজ। বিশাল ছামিয়ানার নিচে হাজার হাজার রোগী রাখার মতো পৃৃথক পৃথক বেড সংবলিত আরও উন্নত ও কার্যকর কোয়ারেন্টাইন গড়ে তোলা হবে। যদি তাই হয় তবে গত দুই মাসে এই উদ্যোগ নেয়া হয়নি কেন। দুই মাসে এমন একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত জায়গা প্রস্তুত করা গেলে ঝুঁকিপূর্ণ দুই হাজার বিদেশ ফেরত মানুষকে হোম কোয়ারেন্টাইনের নামে বাড়ি পাঠাতে হতো না। আর ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হতো না গোটা সমাজকে।
×