ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সেদিনের খোকাই বাংলার মহানায়ক

প্রকাশিত: ১১:৩১, ১৭ মার্চ ২০২০

সেদিনের খোকাই বাংলার মহানায়ক

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ শতবর্ষ পরেও হয়তো কোন পিতা তাঁর পুত্রকে বলবেন- ‘জানো খোকা, আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন, যাঁর দৃঢ়তা ছিল ইস্পাত কঠিন, মানুষটির বিশাল হৃদয় ছিল, মানুষকে ভালবাসতেন অন্ধের মতো। দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে, তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্না রাতে রুপালি কিরণধারায় মায়ের ¯েœহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি ও নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে, তা হলো তাঁর ভালবাসা। জানো খোকা, তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’ গোপালগঞ্জের অজপাড়াগাঁ টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া এক শিশু। তাঁর নামও ছিল খোকা। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শিশু থেকে দুরন্ত কৈশোর। মধুমতি নদীতে সাঁতার কেটে টগবগে যুবকে পরিণত হয় সেই শিশুটি। কালক্রমে সেই খোকাই হয়ে ওঠেন বাংলার মহানায়ক। তিনি আর কেউ নন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু। তিনি জাতির পিতা। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম নেয়া শিশুটি খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে যে ইতিহাস সেটার পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখে তাঁর অদম্য সাহস, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালবাসা আর অসীম ত্যাগ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ, একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলেই আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিত পূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে। শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের তৃতীয় সন্তান আদরের ছোট্ট এই খোকা একদিন বিশ্বনন্দিত নেতা হবেন কিংবা স্বাধীনতায় নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ত্রাণকর্তা হবেনÑ কেউ কী ভেবেছিল। বাঙালীর হাজার বছরের জীবন-কাঁপানো ইতিহাস হচ্ছে স্বাধীনতা। দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম আর ৯ মায়ের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সেই খোকা নামক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাঙালী জাতিকে উপহার দিয়েছে বিশ্বের ভাষাভিত্তিক প্রথম স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আজ মঙ্গলবার সেই ক্ষণজন্ম মহাপুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। শততম জন্মদিনে শত কোটি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা হে বঙ্গবন্ধু। খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু (১৯২০-১৯৭৫) ॥ ১৯৩৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ পরিদর্শনে যান। তাঁদের আগমনে এক সংবর্ধনার আয়োজন করে কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ। মিশন স্কুল পরিদর্শন শেষে প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন বাংলাতো ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন রোগা পাতলা একটি বালক তাঁদের পথ আগলে দাঁড়ালেন। হতভম্ব সব ছাত্র ও শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক বারবার ধমক দিচ্ছেন, কিন্তু জেদি, একরোখা, লিকলিকে ছেলেটি নাছোড়বান্দা। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি আদায় না করে রাস্তা ছাড়বেন না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলার বাঘ খ্যাত প্রধানমন্ত্রীও অবাক। এতটুকুন ছেলে, অথচ কি অসম সাহসী, যে কি না শের-ই-বাংলার পথ আগলে দাঁড়ায়! তবুও কণ্ঠে মাধুর্য এনে বললেন- ‘কি চাও তুমি?’ লিকলিকে বালকের সপ্রতিভ উত্তর, ‘আমাদের স্কুলের একমাত্র ছাত্রাবাসের ছাদ নষ্ট। পানি পড়ে টপটপ করে। ছাত্রদের বিছানাপত্র নষ্ট হয়ে যায়। এ কাজে প্রয়োজন মাত্র ২০০ টাকা। এটা সারাবার ব্যবস্থা না করে দিলে আমি পথ ছাড়ব না।’ অসম্ভব সাহসী, বিনয়ী আর পরোপকারী ছাত্রটির কথায় মুগ্ধ প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে সরকারী ত্রাণ তহবিল থেকে ১২শ’ টাকা মঞ্জুর করে দেন। তিনিই হচ্ছেন টুঙ্গিপাড়ার খোকা, পরবর্তীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। মধুমতি, বাইগার নদীতে সাঁতার কেটে কেটেছে যার দুরন্ত শৈশব। সময়ের পরিক্রমায় এই খোকাই একদিন হয়ে উঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব নেয়ার মতো মহান গুণ হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন শৈশবেই। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠিয়ে গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার খরচ বহন করা, বস্ত্রহীন পথচারী শিশুকে নিজের নতুন জামা পরাতেন। রাজনৈতিক দীক্ষাও নেন স্কুল জীবনেই। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ের কথা বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে নিজেই তুলে ধরেছেন- ‘দিন রাত রিলিফের কাজ করে কুল পাই না। লেখাপড়া মোটেই করি না। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। আব্বা একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘বাবা রাজনীতি কর, আপত্তি করব না। পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ, এত সুখের কথা। তবে লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবা না।’ মহাকালের আবর্তে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া এ নিয়মের মধ্যেও অনিয়ম হয় কিছু স্মৃতি, গুটিকয়েক নাম। বাংলা ও বাঙালীর কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামটি যেমন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এ বাঙালীর অবদানের পাশাপাশি তাঁর জন্মের তিথিও চিরজাগরূক থাকবে বাঙালীর প্রাণের স্পন্দনে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বাঙালীর জন্য আশীর্বাদের একটি দিন। আনন্দের দিনও বটে। এদিন হাজার বছরের শৃঙ্খলিত বাঙালীর মুক্তির দিশা নিয়ে জন্ম নিয়েছিল মুজিব নামের এক দেদিপ্যমান আলোক শিখার। এ আলোক শিখা ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র, নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে পরাধীনতার আগল থেকে মুক্ত করতে পথ দেখাতে থাকে পরাধীন জাতিকে। অবশেষে বাংলার পুব আকাশে পরিপূর্ণ এক সূর্য হিসেবে আবির্ভূত হয়, বাঙালী অর্জন করে মুক্তি। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আজ নেই, কিন্তু সে সূর্যের প্রখরতা আগের চেয়েও বেড়েছে অনেকগুণ। তাঁর অবস্থান এখন মধ্যগগনে। সেই সূর্যের প্রখরতা নিয়েই বাঙালী জাতি আজ এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। টুঙ্গিপাড়া গ্রামেই খোকা থেকে জাতির পিতায় পরিণত হওয়া শেখ মুজিবুর রহমান ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা শস্য শ্যামলা রূপসী বাংলাকে দেখেছেন। আবহমান বাংলার আলো-বাতাসে লালিত ও বর্ধিত হয়েছেন। তিনি শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। শৈশব থেকে তৎকালীন সমাজ জীবনে বঙ্গবন্ধু জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজা পীড়ন দেখেছেন। গ্রামের হিন্দু, মুসলমানদের সম্মিলিত সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসাম্প্রদায়িকতার। বস্তুত পক্ষে সমাজ ও পরিবেশ তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী জীবনে কোন শক্তির কাছে, যে যত বড়ই হোক, আত্মসমর্পণ করেননি; মাথানত করেননি। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের তৃতীয় সন্তান। ৭ বছর বয়সে তিনি পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরবর্তীতে তিনি মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, গোপালগঞ্জ সরকারী পাইলট স্কুল ও পরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে লেখাপড়া করেন। মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনার সময় বঙ্গবন্ধু চোখের বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে কলকাতায় তাঁর চোখের অপারেশন হয়। এই সময়ে কয়েক বছর তাঁর পড়াশুনা বন্ধ থাকে। ১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে কলকাতায় গিয়ে বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং সুখ্যাত বেকার হোস্টেলে আবাসন গ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাস করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এই সময়ে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই সময়ে তিনি শীর্ষ রাজনীতিক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের মতো নেতাদের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে গ্রেফতার হন তৎকালীন যুব নেতা শেখ মুজিব। এরপর দেশে খাদ্য সঙ্কটের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়েও গ্রেফতার হন তিনি। ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হলে কারাগারে থাকা অবস্থায় দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে কারাগার থেকেই নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি প্রাদেশিক সরকারের কৃষি, বন ও সমবায় মন্ত্রী হন। ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও দুর্নীতি দফতরের মন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ছাত্র জীবন থেকেই স্বাধীনতার জন্য বাংলার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু প্রতিটি বাঙালীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন স্বাধীনতার শিকল ভাঙ্গার গান। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে ফের গ্রেফতান হন শেখ মুজিব। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সবার প্রিয় ‘মুজিব ভাই’। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে বাঙালীর মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি ঘোষণা করেন। ওই বছরেই তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ নামে এক মামলায় পুনরায় গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশের ছাত্র-জনতা। ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনের চাপে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হয়। ঊনসত্তরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তাঁকে দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পুরো বাঙালী জাতির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন তৎকালীন ডাকসু ভিপি বর্তমান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ। স্বাধীনতার জন্য পুরো জাতিকে এক সুতোই গাঁথতে থাকেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করার কথা। কিন্তু তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সংসদ অধিবেশন ডাকার পর স্থগিত ঘোষণা করে। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। পূর্ব বাংলায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে পশ্চিম পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলিহেলনে পূর্ব বাংলা পরিচালিত হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক করেন। এতে কোন সুরাহা না হওয়ায় ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, চালায় ইতিহাসের কলঙ্কজনক গণহত্যা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা দেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয়ে যায় মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার (মুজিবনগর সরকার) গঠন করা হয়। এই সরকারের নেতৃত্বেই ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় মহার্ঘ্য স্বাধীনতা। বাংলাদেশ পায় একটি স্বাধীন দেশ, স্বাধীন মানচিত্র। দেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ সংক্ষেপে বাকশাল নামে সর্বদল ভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন। তিনি শিল্পকারখানা, ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণ করে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে নোবেলখ্যাত ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত করেন। কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতিই শুধু নয়, তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা; হিসেবে স্বীকৃতি দেন। দেশকে স্বাধীন করতে জীবনের মূল্যবান ১৩টি বছর কারাগারে কেটেছে বঙ্গবন্ধুর। দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামে তিনি শত যন্ত্রণা, দুঃখ, কষ্ট-বেদনা সহ্য করেছেন, ফাঁসির মঞ্চও যাঁর কাছে ছিল তুচ্ছ- তিনি হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমান। একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানী জল্লাদরা কারাবন্দী রেখে কবর খুঁড়েও যাঁকে হত্যা করার সাহস পায়নি; অথচ স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেই হিমালয়সম ইস্পাতদৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একাত্তরের পরাজিত শক্তির পেতাত্মা নরপিশাচ ঘাতকরা হত্যা করে ক্ষমতার পালাবদল করেছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের হয়ে কাজ করা ঘাতকচক্রের বুলেটে সেদিন ঝাঁঝড়া হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের হৃদপি-। কিন্তু তারপরও একটি জাতি ও অবহেলিত মানুষের মুক্তির অগ্রদূত হিসাবে বঙ্গবন্ধু শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বেই ইতিহাস হয়ে রয়েছেন। কারণ বঙ্গবন্ধু যে চিরঞ্জীব, চির অমলীন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম দেশের জন্য তাঁর সুমহান আত্মত্যাগের ইতিহাস পড়ে নতুন শপথে বলীয়ান হবে, দেশকে ভালবাসবে, স্বাধীনতাবিরোধীদের সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে ব্রতী হবে।
×