ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মশতবার্ষিকী ॥ পিতা ও পুত্রী

দাবায়ে রাখতে পারবা না

প্রকাশিত: ১১:২৬, ১৭ মার্চ ২০২০

দাবায়ে রাখতে পারবা না

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ॥ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহেরুকে বলা হয় আধুনিক অসাম্প্রদায়িক ভারতের স্থপতি। বেশ কয়েক বছর আগে তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় বলেছিলেন, ‘প-িত নেহেরুকে স্মরণ করতে গেলে তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকেও স্মরণ করতে হয়। কারণ, নেহেরুর আধুনিক ভারত গঠন ইন্দিরা গান্ধীকে ছাড়া সমাপ্ত হতো না।’ আজ ১৭ মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে তাকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে গিয়ে আমারও মনে হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ার কাজ কন্যা শেখ হাসিনাকে ছাড়া বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকত। ইন্দিরাকে ভারতের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র রক্ষার কাজে সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হয়নি। হাসিনাকে দীর্ঘকাল জেল-জুলুম ও হত্যা চেষ্টা মোকাবেলা করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ রক্ষা ও উদ্ধারের কাজে লড়াই চালাতে হয়েছে। আজ যে আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে পারছি তাকে জাতির পিতার আসনে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি, তার মূলেও রয়েছে শেখ হাসিনার অবদান। একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করার পর তার হাতে গড়া অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ভিত্তি ধ্বংস করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এক ঘাতক খলনায়ককে দেশের ত্রাতা ও স্বাধীনতা ঘোষণাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দানের চেষ্টা করেছিল। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগকেও বিলুপ্তির পথে নিয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ভূলুণ্ঠিত পতাকা আবার তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ পুনর্গঠন করেন। দলটিতে আবার প্রাণ সঞ্চার করেন। বঙ্গবন্ধু যেমন পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন, তেমনি শেখ হাসিনা দুই দুইটি সামরিক শাসন ও খালেদা জিয়ার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে অপহৃত স্বাধীনতা এবং জাতির পিতার মর্যাদা পুনরুদ্ধার করেছেন। তাই বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কথা আসবেই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নাদর্শ এবং শেখ হাসিনার স্বপ্নাদর্শ কি অভিন্ন? এই প্রশ্নের জবাব হলো, মৌলিক আদর্শের ক্ষেত্রে তা অভিন্ন। কিন্তু তার বাস্তবায়নের কাজে দু’জনের পথ একটু ভিন্ন। এই ভিন্নতা কেন তা জানতে হলে বঙ্গবন্ধুর মৌলিক আদর্শের দিকে তাকাতে হবে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন দেশে গণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্রকে পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ করা। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অনুসরণের জন্য আগে মিশ্র অর্থনীতি চালু করা এবং আমলাতন্ত্র নির্ভর প্রশাসনের বদলে তৃণমূল পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন গড়ে তোলা। এই আদর্শের পূর্ণ বাস্তবায়ন বঙ্গবন্ধু করে যেতে পারেননি। তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর অর্থনৈতিক মুক্তির পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন। বুর্জোয়া অথবা আধা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পথ ছেড়ে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ ধরেছিলেন। এটাই ছিল তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধুর এই দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জন যদি সফল হতো তাহলে আজকের বাংলাদেশ হতো পূর্ব ইউরোপীয় সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো একটি অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন এবং সামাজিক সাম্যের দেশ। বুর্জোয়া ও ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর চাকচিক্য তাতে থাকত না। কিন্তু তার অর্থনীতি ও সামাজিক সাম্যের ভিত্তি হতো শক্তিশালী। তবে এই রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্র রক্ষার নামে সোভিয়েত সৈন্যের পাহারা প্রয়োজন হতো না। দেশের মানুষই এই রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার হতো অতন্দ্রপ্রহরী। প্রণতি পিতা জয়তু বঙ্গবন্ধু তোয়াব খান ॥ ওই মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে...। আজ সতেরোই মার্চ। দক্ষিণ এশিয়ার সব থেকে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে উন্মুখ গোটা জাতি। কৃতজ্ঞ জাতি নানা অনুষ্ঠানে নিবেদন করছে বিনম্র শ্রদ্ধা। জন্মশতবর্ষের সূচনালগ্নে তাই পিতার প্রতি প্রণতি। জয়তু বঙ্গবন্ধু। ভয়াবহ রকম যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং পাকি সেনা বাহিনীর নৃশংস তা-বে ল-ভ- যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি দেশকে আবার দাঁড় করানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো একে একে সবই তিনি গ্রহণ করেছিলেন। সড়ক রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলাÑ যুদ্ধে অচল হয়ে যাওয়া বন্দরগুলো চালু করা, এক কোটি ছিন্নমূল মানুষসহ দেশের বিপুলসংখ্যক জনগণের জন্য খাদ্যের সংস্থান, প্রশাসনিক কাঠামোকে স্বাধীন দেশের উপযোগী করে গড়ে তোলাÑ বঙ্গবন্ধুর প্রশাসনিক দূরদর্শিতারই পরিচায়ক। আর এসবের জন্য বঙ্গবন্ধু সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এই সময়ের মধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং স্টেট ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেশবাসী স্বগর্বে প্রত্যক্ষ করেছে। পাকিস্তানীদের নির্মম লুটপাট ও শোষণে ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে নিজের পায়ে- দাঁড় করানো এবং স্বাধীন বিকাশ এবং অগ্রগতির সোনালি সড়কে নিয়ে যাওয়ার জন্য শুরুতেই বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু পাকিস্তান এবং তার বিশ্ব মুরুব্বিরা নানা চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপগুলো বানচালের অবিরাম চেষ্টা চালায়। এ কথা আজ দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট স্বাধীনতার প্রথম বছরেই সংবিধানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু জাতির অগ্রগমনের পথরেখাটি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তার মূল ভিত্তিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চারটি মৌলনীতিÑ (১) জাতীয়তাবাদ (২) গণতন্ত্র (৩) ধর্মনিপেক্ষতা (৪) সমাজতন্ত্র। ’৭২ সালের সংবিধানে বিধৃত নীতিমালায় ঘোষিত ছিল দুনিয়ার শোষিত নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার। জাতিসংঘে ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এমন এক বিশ্ব ব্যবস্থা গঠনে বাঙালী জাতি উৎসর্গীকৃত, যে ব্যবস্থায় মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচার লাভের আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হবে এবং ‘আমি জানি আমাদের এই প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মধ্যে আমাদের লাখ লাখ শহীদের বিদেহী আত্মার স্মৃতি নিহিত রয়েছে।’ বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে ভাষণে আরও বলেছিলেন, বাংলাদেশের সংগ্রাম ন্যায় ও শান্তির জন্য সার্বজনীন সংগ্রামের প্রতীক স্বরূপ। সুতারাং বাংলাদেশ শুরু থেকেই বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের পাশে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু ফিলিপিনের জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার অর্জনের পক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমাদের আন্তর্জাতিক দায়িত্ব এমনভাবে পালন করতে হবে যাতে প্রতিটি মানুষ নিজের ও পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় জীবন ধারণের মান প্রতিষ্ঠা অর্জনের নিশ্চয়তা লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের পঞ্চাশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী প্রায় একই সময়ে পালিত হতে চলেছে। পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠাকালে অন্ন-বস্ত্রের দুঃখ-কষ্টের দারিদ্র্যক্লিষ্ট দিন আজ অতীতের বিষয়। ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ আর বস্ত্র সঙ্কট, রংপুরের বাসন্তী জাল পরানো ফেক ছবির কথা এখন আর কেউ ভুলেও বলেন না। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই শুধু নয়, কিছু চাল রফতানি করতে চায়। বস্ত্র তথা পোশাক শিল্পে অন্যতম শীর্ষ রফতানিকারক দেশ। বিদেশী সাহায্য ছাড়াই নিজস্ব অর্থে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু এখন স্বগর্বে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নানা অভিধায় বন্দিত। কিউবার রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কাছে হিমালয়। আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের অব্যবহিত পরেই সংসদে ঘোষণা করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীÑ ঢাকা এখন স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত রাজধানী। আর এই নতুন রাষ্ট্রের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চরম ক্ষুব্ধ আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ জায়েদ আল নাহিয়ান বাংলাদেশকে দেয়া সকল সুবিধা বাতিল করেছেন। প্রেসিডেন্ট টিটো ঘাতক মোস্তাককে স্বীকৃতিদানে অস্বীকৃতি জানান। জাতির ক্রান্তিকালে বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী পালনে জাতি কি শুধু শ্রদ্ধা নিবেদনেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে। এমন কিছু চিন্তা-ভাবনা কি করা যায় না যাতে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত পথেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামোয় পরিবর্তন এনে প্রশাসনের সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া যায়। সচিবালয়ভিত্তিক আমলা প্রশাসন যারা করেছিলেন উপনিবেশের সেই ব্রিটিশ শাসকরা এবং পরবর্তীকালের তাদের অনুসারীরা ফলগুলো ভোগ করেছেন। স্বাধীন ও মুক্ত মানুষের জন্য নতুন চিন্তা-ভাবনা দরকার। জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আমরা কি একটু অন্যভাবে চিন্তাভাবনা করতে পারি না? তুরস্ক কিন্তু তাদের আধুনিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা আতাতুর্ক মোস্তফা কামাল পাশাকে সেই মর্যাদা দিতে ভোলেনি। এমনকি মোস্তফা কামাল পাশা নামটির পরিবর্তে লোকে এখন আতাতুর্ক (তুরস্কের পিতা) বলেই চেনে। তুরস্ক তাদের সংবিধানে এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে যে সরকারের পরিবর্তন হলেও বা সংবিধান সংশোধন হলেও এ ধারাটি বজায় রাখা বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। আজ আমরা কি মহাভারতের কর্ণপুত্রের মতো পিতা প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য নিঃসঙ্কোচে উদ্ধত খড়গের নিচে মাথা পেতে দিয়ে কি বলতে পারব : ‘পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতা হি পরমান্তপঃ?’
×