ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

১৭ মার্চ- বিশ্বশীর্ষ মানবমনীষার আবর্ত

প্রকাশিত: ০৮:০৭, ১৭ মার্চ ২০২০

  ১৭ মার্চ- বিশ্বশীর্ষ মানবমনীষার আবর্ত

মহান স্রষ্টার মায়াবী মাটি ও মানুষ নির্মিত বৈচিত্র্যময় গ্রহ এই পৃথিবী। ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে গড়ে তুলেছেন ধর্ম-বর্ণ-অঞ্চল নির্বিশেষে জাগতিক ইন্দ্রিয়বৃত্ত। জ্ঞানমানসের দুর্জ্ঞেয় সত্তায় তপস্যানির্ভর ক্ষণজন্মা স্বল্পসংখ্যক কৃতিমানব এই ধরিত্রীকে করেছেন নতুন অভিধায় অভিসিক্ত। রচিত হয়েছে সমাজ-সভ্যতার ক্রৌর্য-পরিক্রমার দিদৃক্ষা। গৌরবদীপ্ত ঐতিহ্যিক ঐশ্বর্যের দিগ¦লয় যাঁরা নির্মাণ করেছেন, তাঁরাই বিশ্বখ্যাত এবং ইতিহাসের অধ্যায়ে যুগান্তর প্রবাহে অতিশয় প্রৌজ্জ্বল। তাঁদের সমাজ-জীবন-রাজনীতি-ধর্ম ও রাষ্ট্রদর্শন যেমন নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ; তেমনি মনন-সৃজনের বিস্ময়কর নমস্যভব্য। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভবার্ণব জন্ম বাঙালী জাতির জীবনে তেমন এক আলোকরশ্মির প্রতিসরণ। শৈশব-কৈশোর থেকে প্রচ্ছন্ন প্রকীর্তির আড়ালে দেশপ্রেম, মানবকল্যাণ এবং আত্মপ্রত্যয়ের সজীব দৃষ্টান্ত স্থাপনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন কিংবদন্তি ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ১৪৭৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিপ্লবসূচক নিকোলাস কোপারনিকাস, ১৪৮৩ সালে ১০ নবেম্বর খ্রীস্টান ধর্মে প্রোটেস্টানিজম মতবাদের প্রবক্তা মার্টিন লুথার, ১৭৩২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং আমেরিকানদের মুক্তিদাতা জর্জ ওয়াশিংটন, ১৭৭৪ সালের ১০ মে ব্রাহ্মধর্ম মতবাদ ও সতীদাহ প্রথার নিবারক ভারতের নবযুগের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায়, ১৮২০ সালের ১২ মে আর্তমানবতা সেবাধর্মের মাতৃস্বরূপা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, ১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর নোবেল পুরস্কার প্রণেতা আলফ্রেড নোবেলের জন্ম উল্লেখ্য সন-তারিখকে করেছে চিরঞ্জীব এবং চিরস্মরণীয়। আবৃত প্রচ্ছাদনে ১৮৬১ সালের ৭ মে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৮৭২ সালের ১১ মে মানবতার সীমাহীন মর্মবেদনা ও জ্ঞানের অপরিসীম অনুসন্ধানী বারট্রান্ড রাসেল, ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী, ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ মহাজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, ১৮৮৯ সালের ১৪ নবেম্বর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা জওহরলাল নেহরু, ১৮৯৯ সালের ২৪ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ প্রমুখ এই ধরিত্রী সভায় প্রতিপদন্বরূপ আবির্ভূত হয়েছিলেন বলেই সমগ্র বিশ্ব হয়েছে পরিকাম্যসমৃদ্ধ। বপ্র আবরণে নিপীড়িত, নির্যাতিত স্বাধীনতা-মুক্তিকামী মানুষের কাছে বিশ্বপরিম-লে সর্বোচ্চ সমাদৃত পরিকর্ষ নেতৃত্বের কালোত্তীর্ণ প্রাণপুরুষ বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা মহাকালের মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিদ্যুদর্ষী জন্ম। কবিগুরু রবীঠাকুরের ‘আমি’ শিরোনামে কবিতার প্রথম কয়েকটি পঙ্ক্তি যেন বঙ্গবন্ধুর জন্মকেই উৎসর্গ করা। ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে।/আমি চোখ মেললুম আকাশে - জলে উঠল আলো পুবে পশ্চিমে।/গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, ‘সুন্দর’Ñ সুন্দর হলো সে।/তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা, এ কবির বাণী নয়।/আমি বলব এ সত্য, তাই এই কাব্য।/এ আমার অহঙ্কার, অহঙ্কার সমস্ত মানুষের হয়ে।/মানুষের অহঙ্কার-পটেই বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প।’ বস্তুতপক্ষে দীর্ঘ তিন হাজার বছর প্রাচীন বাংলা নামক জনপদে সমাজ-ইতিহাস ভিনদেশী শাসক-শোষকদের নিপীড়ন-নির্যাতন-যন্ত্রণা-বঞ্চনা-বৈষম্যের এতাদৃশী। তেজস্বী এই বাংলার প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রনায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গুণকীর্তন, ত্যাগ মহিমার একনিষ্ঠ ঘনিমার প্রাসঙ্গিকতা অতিশয় দিব্যোদক। জীবনপঞ্জিকার ন্যায়োপেত মহাকাব্য ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের সূত্রমতে বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন ফরিদপুর জেলার দক্ষিণ অঞ্চলের সর্বশেষ ইউনিয়ন মধুমতী নদীর পাশেই গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। সুপরিচিত এবং সম্মানিত মধ্যবিত্ত শেখ পরিবারেই বঙ্গবন্ধুর জন্ম। ১৪৬৩ সালে এই জনপদে পদার্পণ করেছিলেন অতি উচুঁ মার্গের আধ্যাত্মিক সাধক হযরত সুলতান বায়েজিদ বোস্তামী (র)। তাঁর দক্ষিণহস্তখ্যাত দরবেশ শেখ আউয়ালের বংশধর শেখ বোরহানউদ্দিন এই শেখ বংশের গোড়াপত্তন করেছিলেন। প্রায় দু’শ বছর প্রাচীন দালানসমূহের ধ্বংসাবশেষ এই বংশের ঐতিহ্যকে নিরন্তর জানান দিয়ে চলেছে। এই শেখদের নৌযানের ব্যবসা এবং সংশ্লিষ্ট নৌকার বহর আটকে রেখে মাঝিদের দিয়ে অমানুষিক কাজ করিয়ে নিতেন জনাব রাইন নামক ব্রিটিশ বেনিয়ার কুখ্যাত প্রতিনিধি। আদালতে জয়ী হয়ে জরিমানা আদায়ের মাধ্যমে শেখ পরিবার প্রথম অত্যাচারের প্রতিশোধ নিলেন এই প্রতিনিধির বিরুদ্ধে। গৃহশিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মহোদয় গঠিত ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র মাধ্যমে সহপাঠীদের সমন্বয়ে মুষ্টি ভিক্ষার চাল সংগ্রহ ছিল জীবনের প্রথম জনকল্যাণমুখী কাজ এবং তা বিক্রি করে গরিব শিক্ষার্থীদের বই ও পরীক্ষা সংক্রান্ত খরচ মিটানো দিয়েই মাঙ্গলিক ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্রত যেন তখনই বপন করেছেন। প্রসঙ্গত রবীঠাকুরের প্রয়াণ পূর্ব ‘প্রথম দিনের সূর্য’ শিরোনামে কবিতায় উচ্চারিত পঙ্ক্তি ‘প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল/সত্তার নতুন আবির্ভাবÑ কে তুমি মেলেনি উত্তর।/বৎসর বৎসর চলে গেল।/দিবসের শেষ সূর্যশেষ প্রশ্ন উচ্চারিল/পশ্চিম সাগর তীরে নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়- কে তুমি? পেল না উত্তর।’ জীবন সায়াহ্নে রচিত রবিঠাকুরের কবিতায় যেন বঙ্গবন্ধু খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর জন্মসত্তার যথার্থ উপাদান এবং বিশ্বমানবতার জয়গানে নিজেকে নিবেদন করার স্বয়ম্ভু দর্শন। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখক ও সমাজচিন্তক বাট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, ‘যখন কেউ সাধারণ প্রশ্ন করেন তখন দর্শনের সৃষ্টি হয় এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তাই।’ বঙ্গবন্ধুর হৃদয় গভীরে প্রোথিত ছিল এসব অমরবার্তা। বাংলা ও বাঙালীর স্বরূপ সন্ধানে সম্ভাবিত বলয় তৈরি করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায়। ধারাবাহিকতায় বলা যায় বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনায় আরেক মহান রাজনীতিকের প্রভাব ছিল অফুরন্ত। তিনি হলেন রবিঠাকুরের ভাষায় ‘যৌবনের মূর্ত ও চিরবসন্তের উজ্জ্বল প্রতীক’ জওহরলাল নেহরু। অপরিমেয় প্রতিভা, বিনয়ী আচরণ, নির্মল আদর্শ নিষ্ঠা এবং বিশ্বজনীন সৌহার্দের অবিচল কারিগরি কৌশল নেহরুকে যেমন প্রতিষ্ঠিত করেছিল বিশ্ব দরবারে অনন্য ব্যক্তিত্বে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন দুর্বার যৌবনের বৃত্যাভাসে উদ্ভাসিত কঠিন তরঙ্গ যা কিছুতেই হার না মেনে এগিয়ে চলাকে ঋদ্ধ করেছেন। হয়েছেন জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শিক বিশ্বনেতার কীর্তনআবর্ত। বঙ্গবন্ধু মাত্র পঞ্চান্ন বছরের জীবনকালে প্রায় বার বছর কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। ব্রিটিশ মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা প্রয়াত লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে বলেছিলেন, ‘এক অর্থে জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী ও ডি ভ্যালেরার চেয়ে শেখ মুজিব ছিলেন বড় নেতা।’ ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের আলজির্য়াসে অনুষ্ঠিত শীর্ষ বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে আবেগপ্লাবিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতার দিক থেকে এই মানুষটি হিমালয়। তাই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা পেলাম।’ মিঞা মুজিবুর রহমান রচিত ‘জাতির জনক’ গ্রন্থসূত্রে মিসরের ‘আল-আহরাম’ পত্রিকার খ্যাতিমান সাংবাদিক হাসনাইন হেইকলের কালোচিত বক্তব্য সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য- ‘নাসের কেবল মিসর ও আরব জগতের নন। তার আরব জাতীয়তাবাদও আরব জনগণের জন্য একটি মুক্তির বার্তা। একইভাবে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের একার নন। তিনি সব বাঙালীর মুক্তির অগ্রদূত। তার বাঙালী জাতীয়তাবাদ বাংলার সভ্যতা ও সংস্কৃতির নতুন অভ্যুদয়। মুজিব বাঙালীর অতীত ও ভবিষ্যতের একজন বীর।’ এভাবেই মুজিব বন্দনায় স্মরণার্থ অমীয় বাণী এবং সোপাধিক কাব্যগাঁথা শুধু বঙ্গবন্ধুকে মহান করেনি, পুরো বাঙালী সমাজ, জাতি-রাষ্ট্র, কৃষ্টি-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে করেছে বিশ্বপরিমন্ডলে নিরন্তর মর্যাদাসীন। সম্বোধি অনুধাবন এবং ইতিহাস অধ্যয়নে বুদ্ধিদীপ্ত অন্তদৃষ্টি বঙ্গবন্ধুকে করেছে অপরিসীম প্রোৎসাহিত। এরই ভিত্তিতে দীর্ঘ সময় জনগণমন বিজয়ী বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালীকে একতাবদ্ধ করেননি, স্বাপ্নিক স্বদেশের স্বাধীন ভূখন্ড ও লাল-সবুজের মানচিত্র অর্জনে নির্ব্যাজ চিত্রকরের অনবদ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ধর্ম-বর্ণ, উচ্চ-মধ্যবিত্ত-দরিদ্র, অঞ্চল নির্বিশেষে বিভাজিত জনগোষ্ঠীর খন্ডিত বিরোধ-বিচ্ছেদ নির্বাণে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদান আজ বিশ্বখ্যাত। বঙ্গবন্ধুর নির্বিকল্প নতুন আদর্শের নবতর নিলয় হয়েছে বাঙালীর আজন্ম লালিত গন্তব্য। নিবন্ধের শেষ করছি জাতীয় কবি নজরুলের ‘জাতের বজ্জাতি’ কবিতার পঙ্ক্তি দিয়ে - ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জ্বালিয়াত খেলছে জুয়া।/ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।।/হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতই জাতির জান।/তাই তো বেকুব করলি তোরা এক জাতিকে এক শ’খান।’ ১৭ মার্চ এই মহামানবের জন্মশত বার্ষিকীর শুভক্ষণে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হোক- জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×