ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার বস্তি যেন সোনার খনি

প্রকাশিত: ১১:২১, ১৬ মার্চ ২০২০

  ঢাকার বস্তি যেন সোনার খনি

শংকর কুমার দে/ গাফফার খান চৌধুরী ॥ বিভিন্ন বস্তিতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। যারমধ্যে অগ্নিকান্ড অন্যতম। বস্তিবাসীদের দাবি, এসব অগ্নিকান্ডের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী ও সুবিধাভোগীরা জড়িত। বস্তির জায়গা দখল করতেই পরিকল্পিতভাবে বস্তিতে আগুন লাগানো হয়। আগুন বস্তির ঘর পুড়ে যাওয়ার পর স্বাভাবিক কারণেই পুড়ে যাওয়া ঘরের মালিক দ্রুতই ঘর তুলতে পারেন না। এই সুযোগ সুবিধাভোগী প্রভাবশালী শ্রেণী জায়গা দখলে নেয়। তারা সেখানে ঘর তুলে আবার ভাড়া দেয়। আবার কোন কোন সময় দোকান তুলে ভাড়া দিয়ে থাকে। বস্তির ঘর ভাড়া ছাড়াও মাদক ব্যবসা থেকে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। ঢাকার শতাধিক বস্তি নিয়ন্ত্রণ করছে এমন প্রভাবশালী অন্তত পাঁচ হাজার ব্যক্তি। এসব বস্তি যেন টাকা রোজগারের সোনার খনি। পল্লবীর চলন্তিকা বস্তির পর সর্বশেষ পল্লবীর শিয়ালবাড়ি বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পরেও এমনই অভিযোগ উঠেছে। গত ১১ মার্চ ঢাকার রূপনগরের শিয়ালবাড়ি বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে অন্তত সাত হাজার ঘর পুড়ে যায়। গ্ৃহহীন হয়ে পড়েন প্রায় ত্রিশ হাজার বস্তিবাসী। যদিও কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। নিকট অতীতে এতবড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা আর ঘটেনি। ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের গঠিত পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। এর আগে চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি ঢাকার রূপনগরে চলন্তিকা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের তিন শতাধিক ঘর পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট টানা প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে দগ্ধ হয়ে পারভীন আক্তার (৩৫) নামের এক গৃহকর্মী পরদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্তায় মারা যান। গৃহহীন হন শত শত মানুষ। এর আগে গত বছরের আগস্ট বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে অন্তত এক হাজার বস্তি ঘর পুড়ে যায়। প্রতিটি ঘটনায়ই ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। দুইটি ঘটনার পরই বহু বস্তিবাসী অভিযোগ করেছেন, সামান্য কোন ঘরে আগুন লাগার পর এভাবে শত শত ঘর পোড়া সম্ভব নয়। বস্তিতে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। স্থানীয় প্রভাবশালীরা বস্তি উচ্ছেদ করতেই পরিকল্পিতভাবে এমন ঘটনা ঘটায়। এছাড়া বস্তিবাসীদের ঘর পুড়িয়ে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়। তারা তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে ঘর তুলতে পারে না। এমন সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা ওই জায়গাটি তাদের দখলে নেয়। সেখানে আবার বস্তি ঘর তুলে বা দোকান তৈরি করে ভাড়া দেয়। প্রতিমাসে বস্তি থেকে ঘর ভাড়া, দোকান ভাড়া থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসা থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় স্থানীয় প্রভাবশালীরা। চলন্তিকা বস্তিতে গত বছরের ১৬ আগস্টের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর গত বছরের ২২ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকের উদ্যোগে আয়োজিত এক সংলাপে বক্তারা বস্তিতে আগুন লাগে, না লাগিয়ে দেয়া হয়, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেন। তারা বস্তিতে কেন বার বার আগুন লাগে তা খতিয়ে দেখা জরুরী বলে মত দেন। আলোচনায় জাতীয় বস্তি কমিশন গঠনের দাবিসহ ১২ দফা দাবির আহ্বান জানানো হয়। ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, বস্তি কেন পুড়ে তা খতিয়ে দেখতে হবে, নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসনের জন্য জাতীয় বস্তি কমিশন গঠন করতে হবে। বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন না করা পর্যন্ত উচ্ছেদ না করতে হাইকোর্টের রুল থাকার পরেও প্রতিবছরই বস্তিতে আগুন লাগে। একটি পৃথক কমিশন গঠন করে সব অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুধাবন ও বস্তিবাসীর আবাসনের ব্যবস্থা করার দাবি করেন তিনি। ১২ দফা দাবির মধ্যে চলন্তিকা বস্তিতে ভয়াবহ অগিকাণ্ডে আনুমানিক ৫ হাজার পরিবারকে ১৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়ার দাবি জানানো হয়। একই জায়গায় বস্তিবাসীদের পুনবাসনের কথাও ওঠে। বস্তিকে নগরের দুর্যোগ ও ঝুঁকি হিসেবে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করার দাবিও করা হয়। বড় বস্তির কাছে সার্বক্ষণিক ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট রাখার দাবি জানানো হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার শতাধিক বস্তি যেন সোনার খনি। সরকারী জমিতে গড়ে ওঠা বস্তির ঘর থেকে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রভাবশালীরা। স্থানীয় সন্ত্রাসী, মাস্তান, বিদ্যুত, গ্যাস, পানি বিভাগের দুর্নীতিবাজ এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত বস্তি নিয়ন্ত্রণকারী চক্রগুলো বস্তি থেকেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বস্তির জায়গা দখল করার জন্য এবং মাদক ব্যবসার রমরমা ব্যবসার আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রায়ই বস্তিগুলোতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। চলন্তিকা ও শিয়ালবাড়ি বস্তিু দুইটি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অধিগ্রহণ করা অন্তত ৫০ একর জমির উপর গড়ে উঠেছে। দুইটি বস্তিতে অন্তত ২০ হাজার বস্তিঘর আছে। প্রতিটি ঘরেই অবৈধ বিদ্যুত সংযোগ আছে। কোন কোন বস্তিতে অবৈধ তিতাস গ্যাসের সংযোগও আছে। প্রতিটি বস্তি ঘরের ভাড়া কমপক্ষে দুই হাজার টাকা। এছাড়া বিদ্যুত ও গ্যাস মিলিয়ে আরও প্রতি ঘর থেকে অন্তত পাঁচ শ’ টাকা প্রতি মাসে আদায় করা হয়। সে হিসেবে ঢাকার ছোট বড় এক শ’ বস্তিতে প্রতিটি বস্তিতে গড়ে পাঁচ শ’ বস্তি ঘর আছে। প্রতি মাসে বস্তি থেকে প্রভাবশালীরা কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বাস্তবে এর চেয়েও অনেক বেশি। সারাদেশের চিত্র আরও ভয়াবহ। স্থানীয় সরকারের অধীনে কাজ করা বিভিন্ন দাতা সংস্থার পরিসংখ্যান মোতাবেক, দেশের ২৪ জেলার ২৯ শহরে ৪৫ হাজার বস্তি আছে। এরমধ্যে টঙ্গী ও সাভারে বস্তির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বস্তিগুলো প্রায় ৫ হাজার একর সরকারী জমির ওপর গড়ে উঠেছে। রেলওয়ে বিভাগের তথ্য মোতাবেক, সারাদেশে সরকারী, আধা সরকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি প্রায় সাড়ে ৪ হাজার একর রেলওয়ের জমি অবৈধভাবে দখলে রেখেছে। বেদখলে থাকা জায়গাগুলোতে ভারি ও হালকা আধাপাকা স্থাপনা ছাড়াও বস্তি গড়ে উঠেছে। ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার রেলপথের দুই ধারের প্রায় ৫৮ একর জমিতে রয়েছে হাজার হাজার অবৈধ স্থাপনা আর বস্তি। এসব স্থাপনা ও বস্তি নিয়ন্ত্রণ করছে প্রায় ৫ হাজার স্থানীয় প্রভাবশালী। স্থানীয় সরকারের অধীন কাজ করা দাতাসংস্থা ইউপিপিআর (আরবান পার্টনারশীপস ফর পোভার্টি রিডাকশন্স প্রজেক্ট) এর জরিপ অনুযায়ী, বস্তিগুলোতে প্রায় ৫ লাখ হতদরিদ্র মানুষ বাস করছেন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের হিসেব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় ছোট বড় একশটি বস্তি আছে। গত প্রায় চার বছরে ছোট ছোট ১০ বস্তি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ওইসব বস্তির বাসিন্দারা বড় বড় বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন। এরমধ্যে রেলওয়ের জায়গার ওপরই গড়ে উঠেছে ৭০ বস্তি। অন্যান্য বস্তিগুলো সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে। ঢাকায় বস্তিতে বসবাস করছেন অন্তত ২ লাখ দরিদ্র মানুষ। বস্তিবাসীদের অনেকেই ভোটার। সিটি কর্পোরেশনের তথ্য মোতাবেক, যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন শাখা দেশের বস্তির সার্বিক উন্নয়নের জন্য ৭২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এসব অর্থ ব্যয় হচ্ছে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগের তদারকিতে বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে। প্রজেক্টের কৌশলগত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে ইউএনডিপি (জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা)। পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে য্ক্তু ও অধীন ৩০টি সংস্থা, সুশীল সমাজ, হাজারখানেক এনজিও ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা জড়িত। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দফতরের অপারেশনস শাখার তথ্য মোতাবেক, দেশে থাকা বস্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার। যদিও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বস্তির সঠিক পরিসংখ্যান, বস্তিতে থাকা মানুষের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। বেশিরভাগ সময়ই বস্তিতে আগুন লাগলে সেখানে ভারি কোন যানবাহন দিয়ে কাজ করা সম্ভব হয় না। ফলে আন্তরিকতা থাকলেও ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। এতে করে সরকারের প্রতি মানুষের এবং বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
×