ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কিছু কথা ॥ কিছু স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৭:৫৭, ১৬ মার্চ ২০২০

 বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কিছু কথা ॥ কিছু স্মৃতি

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। নবজাতকের ন্যায়। বঙ্গবন্ধুর মাথায় হাজারটা চিন্তা, ঘুম নেই, খাওয়া নেই। দৈনিক ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজে ব্যস্ত থাকেন। কত তাড়াতাড়ি নব্য স্বাধীন বিধ্বস্ত দেশটাকে স্বাভাবিক করা যায়। পাশাপাশি ৬ দফার ভিত্তিতে ড. কামাল গংকে দিয়ে সংবিধান রচনার দায়িত্ব দিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের যে সব নেতা ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনার পক্ষে বঙ্গবন্ধু তাদের নিয়ে একটা মতবিনিময় সভার আয়োজন করলেন। স্থানটা ছিল শাহবাগ হোটেল (বর্তমান পিজি হাসপাতাল তখন ছিল শাহবাগ হোটেল)। এ সভায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উপস্থিত ছিলেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াব জাদা নসরুল্লাহ খান, সহসভাপতি কাজী ফয়েজ মোহাম্মদ, সিন্ধুর নেতা লেঘারী, বেলুচ নেতা নওয়াব আকবর খান বুগতি, বেলুচ নেতা পীর পাগারোসহ অনেকে। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ, জামায়াত ছাড়া আর সব নেতৃবৃন্দ এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, ভুট্টো এবং কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি মিয়া মমতাজ দৌলতানা ছাড়া বাকিরা সবাই যাতে ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান সমর্থন করেন এবং এই মতবিনিময় সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল এটাই। এ সভায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সভায় রাতের খাবার শেষে মুক্ত আলোচনা হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধ গেটের পাশে কাঠের চেয়ারে বসে পাইপ টানছিলেন। আমি অযাচিত লোকজন যাতে ঢুকতে না পারে এ জন্য গেটের পাশে দাঁড়িয়ে। বঙ্গবন্ধু ইশারায় আমাকে ডাকলেন। বললেন, টুলটা টেনে বস। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু প্রতিটি কর্মীকে অন্তর থেকে ভালবাসতেন। কোন আনুষ্ঠানিকতা (formality) ছিল না তার ভেতর। আমি বললাম, লিডার ‘এ্যাডভোকেট সালাম খান’ ৬ দফার বিপক্ষে চউগ (নূরুল আমীনের নেতৃত্বে পিপলস ডেমোক্র্যাটিভ মুভমেন্ট)-এর সমর্থনে বিবৃতি দেন। পাকিস্তানের প্রখ্যাত ব্যারিস্টার ড. একে ব্রোহী, লন্ডনের বিখ্যাত আইনজীবী টমাস উইলিয়ামের মতো আইনজীবীরা থাকার পরও সালাম খানকে কেন? আবার আজকের সভায় তিনি দাওয়াতীও। বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন- পাগল, ছালাম যাতে প্রকাশ্যে আমার বিরোধিতা না করে, তার জন্য। বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষের অনেক নেতাকে তিনি কৌশলী হয়ে দলের পক্ষে এনেছেন। এর অন্যতম উদাহরণ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহমান খান, মনসুর আহমেদ, ফরিদপুরের মোহন মিয়া, লাল মিয়া প্রমুখ। আমাকে উদ্দেশ করে বললেন ‘তুই তো শীঘ্রই ইঞ্জিনিয়ার হবি’। পাইপে একটা টান দিয়ে বললেন ‘ইঞ্জিনিয়ার’রা বেশি আওয়ামী লীগ করে না। কিন্তু আমার তো ইঞ্জিনিয়ারদের দরকার।’ আমি কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার ৩২ নম্বর বাড়ি কোন্ ইঞ্জিনিয়ার বানাইছে?’ উনি হেসে দিলেন এবং বললেন গোপালগঞ্জের সিদ্দিক ইঞ্জিনিয়ার। ঘটনাটা শোন- আমি তখন আলফা ইন্স্যুরেস কোম্পানিতে চাকরি করি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সারাদেশের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি আর প্রয়োজনে দৌড় দেই। বিশেষ করে নেতা (সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব) যখন আসেন তাকে নিয়েই ব্যত্ত থাকতে হয়।’ বঙ্গবন্ধু স্বগোক্তি করে বলতে থাকেন- ৩২ নম্বর জায়গাটা সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের। আমি পাহারাদার মাত্র। তবে নেতা অনেকবার বলেছেন- তুমি তো ঘর তুলে এখানে থাকতে পার। ঘরটা কেমনে হলো শোন- আমি অফিসে বসে ফোন করছি। এক লোক ঢুকে বলে আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ স্যার, রাজমিস্ত্রির কাজ করি। আপনার ধানমন্ডির জায়গাটা খালি পড়ে আছে। বঙ্গবন্ধু বললেন- জায়গাটা আমার না, আমার নেতার। আপনি বললে- ওখানে একটা বিল্ডিং বানাইয়া দিতাম। কিভাবে? ২ গাড়ি ইটা, ১ গাড়ি বালি আর কিছু সিমেন্ট কিন্যা দেন হয়ে যাবে। যে টাকা দিয়া- ইট, বালি কিনব ওগুলো আমার কর্মীদের দিলে আমি বেশি খুশি হব। সিদ্দিক মিস্ত্রি নাছোরবান্দা- তাই বাড়িটা হয়েছে তবে অনেক সময় লেগেছে। ততক্ষণে রাত বেশ হয়েছে। অনেকেই বিদায়ের অপেক্ষা। বঙ্গবন্ধু চেয়ার থেকে উঠে বললেন- তুই খাইছস, না খাবার আছে। নেতা সবার মাঝে মিশে গেলেন। ’৭০-এর নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে একক সংখ্যা গরিষ্ঠ হওয়ায় বাঙালী জাতির চূড়ান্ত বিজয়ের ঘণ্টা বেজে উঠল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্বয়ং বললেন- ‘আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান খুব শীঘ্রই দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। আরও বলেন- উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থা আমি শেখ মুজিবের হাতে দিয়ে যাচ্ছি। দেশে শীঘ্রই শেখ মুজিবের সরকার হবে।’ এটা সন্দেহের কারণ ছিল না কিন্তু ভুট্টো সাহেব, কাউন্সিল মুসলিম লীগ সভাপতি মিয়া মমতাজ দৌলতানারা আইয়ুব খানের সঙ্গে আতাত করে ষড়যন্ত্র শুরু করলে বাঙালী জাতি ফুঁসে উঠল। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ভাষণে বলেছিলেন- নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা ক্ষমতায় বসতে পারি নাই। বাংলার সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ দীপ্ত শপথে বলীয়ান। এবার আর ছাড় নাই। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য। ঠিক এমনি সময় আমার হলো এক ঝামেলা। আমি তখন নারায়ণগঞ্জ ঢাকেশ্বরী কটন মিলের ইঞ্জিনিয়ার। ’৭০-এর নির্বাচনে অফিস ফেলে আমাকে ৪ মাস জামালপুর মহকুমার নির্বাচনের কাজ করতে হয়েছিল। নির্বাচন শেষে ঢাকায় ফিরে EPIDC প্রধান কার্যালয়ে গেলে আমাকে চিটাগং বদলির একটা চিঠি হাতে তুলে দিল। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। শেখ শহীদ ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট এবং তার সঙ্গে আমি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ’৬৯-এর গণআন্দোলনে নূর খান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের ওপর সব আলোচনায় শেখ শাহীদ ও আমি ছাত্রলীগের প্রতিনিধিত্ব করেছিলাম। পরদিন ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ খুব সকালে ৩২ নম্বরে হাজির হই। বৈঠকখানায় ঢুকে দেখি বঙ্গবন্ধু বৈঠকখানা সংলগ্ন ডাইনিং টেবিলে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে কুরআন বন্ধ করে ‘কিরে এত সকালে তোরা, কোন Problem?’ শহীদ বলতে লাগলেন- মামা, মোহাম্মদ আলী ঢাকায় দলীয় অনেক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত। বুয়েট ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ আলী আর আব্দুল করিম সেক্রেটারি। পুলিশ যখন আমাদের ওপর হামলা চালায়, তখন Shelter দেয় বুয়েটের কর্মচারীরা। মোহাম্মদ আলী না থাকলে এটুকুন পাব না। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের শামসুজ্জোহা সাহেবের শ্রমিক ফ্রন্টের বিভিন্ন মিটিংয়ে প্রতিনিধিত্ব করে মোহাম্মদ আলী। ওকে ঢাকায় রাখতে হবে। নেতা বললেন ‘কফিল উদ্দিন মাহমুদকে লাগাও’। শহীদ ইপিআইডিসির চেয়ারম্যানকে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে ঘটনাটা বললেন। উত্তর এলো আপাতত যোগদান করে দরখাস্ত দিক। আমার আর দরখাস্ত দেয়া হয়নি। কারণ এর পর মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ চট্টগ্রাম আমার ঝবপড়হফ ঐড়সব হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ’৭২-এর ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণকালে জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্ন- আজকের দিনে জাতির প্রতি আপনার বাণী কি? তার উত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান : ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বুঝলাম রাজনীতিবিদ মুজিব আর রাষ্ট্রপ্রধান মুজিবের পার্থক্য কি? বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এখন আর যখন তখন দেখা করা যায় না। তোফায়েল ভাই বঙ্গবন্ধুর Political Secretary. ভাবলাম আমাদের প্রস্তাবটা বঙ্গবন্ধুকে বলার আগে তোফায়েল ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলি। সচিবালয়ে তোফায়েল ভাইয়ের সামনে হাজির হলাম। প্রধানমন্ত্রী নেই। তিনি ভিয়েনায় অবস্থান করছেন। রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল ভাই আমার রাজনৈতিক মুরব্বি। তাদের সহায়তায় ১৯৬৫ সালে ইটঊঞ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু একটা নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের স্নেহ ভালবাসা আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে থাকবে। তোফায়েল ভাইয়ের কক্ষে ঢুকতেই- কি খবর মোহাম্মদ আলী, তোমাকে দেখছি না। আমি তো আপনার সামনেই আছি। চিটাগংয়ে চাকরি করি। চা-না কফি। কফি খাও। ভাল বিদেশী কফি আছে। বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝে খান। আমি কফির কথা বলে প্রস্তাবটা উত্থাপন করলাম- বিশ্ব এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভরশীল। তাই আমরা বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ারদের দাবি বিজ্ঞান ও প্রযক্তি বিষয়ক একটা মন্ত্রণালয় থাকুক। তিনি বললেন- প্রস্তাবটা তো যৌক্তিক। ডাক্তারদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, কৃষিবিদদের কৃষি মন্ত্রণালয়, ইঞ্জিনিয়ারদের একটা মন্ত্রণালয় থাকতে তো পারে। শেখ শহীদকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা কর। বঙ্গবন্ধু ৩ দিন পর ভিয়েনা থেকে ফিরেছেন। আমি শেখ শহীদকে ধরলাম। আলাপ অনুযায়ী পরদিন কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ৩২ নম্বরে হাজির হলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন বিষয়টা আমরাও ভেবেছি এবং ড. কুদরত-ই-খোদা অথবা ড. মফিজকে দায়িত্ব দেব। খুশি মনে ফিরছি। পল্লী কবি জসীমউদ্দীন লাঠি ভর দিয়ে গেটের ভেতর ঢুকছেন। বঙ্গবন্ধু লাফ দিয়ে কবিকে জড়িয়ে ধরলেন, স্যার এত সকালে আপনি? ফোন করলেই তো হতো। খুব জরুরী মনে করে চলে এলাম। হাসুর জামাই মওদুদ এখনও জেলে, ওকে একটু মুক্তির ব্যবস্থা কর। মেয়েটা একা একা কান্নাকাটি করে। ইতোমধ্যে ডাইনিং টেবিলে নাশতা আসছে। স্যার আসেন নাশতা খাই। উল্লেখ্য, কবি জসীমউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক ছিলেন। তুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আগে বলে দে, তারপর নাশতা খাব। অগত্যা শেখ শহীদকে আবার টেলিফোন করতে হলো। মান্নান চাচা মামার নির্দেশ মওদুদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে। পরের দিনই মওদুদ আহমদ জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসলেন। এক মানবিক বঙ্গবন্ধু আজীবন সমাজ, দেশ ব্যক্তির কল্যাণে কাজ করেছেন, আর তাই তো জাতির কাছে শ্রদ্ধার হয়ে আছে থাকবেন চিরকাল। লেখক : প্রকৌশলী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা [email protected]
×