ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইমপিচমেন্ট সঙ্কট ॥ ক্লিনটন অধ্যায়ের না জানা কথা

প্রকাশিত: ০৭:৫৩, ১৬ মার্চ ২০২০

 ইমপিচমেন্ট সঙ্কট ॥ ক্লিনটন অধ্যায়ের না জানা কথা

লাদেন হত্যার আয়োজন যখন চলছিল ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে ইমপিচমেন্টের কালো মেঘ জমে ওঠার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন পররাষ্ট্র নীতির পুরো দায়িত্বটা কিসিঞ্জারের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে বিল ক্লিনটন একই পরিস্থিতির মুখে পড়ে অধ্যায়জুড়ে পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ১৯৯৮ সালের ৭ আগস্ট সকালে কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসের বাইরে দুটো ট্রাক বোমা বিস্ফোরণে ২২৪ ব্যক্তি নিহত ও ৫ হাজারের বেশি আহত হয়। নিহতদের ১২ জন ছিল আমেরিকান। এফবিআই ও সিআইএর তদন্ত থেকে বেরিয়ে আসে ওটা ছিল ওসামা বিন লাদেনের সংগঠন আল কায়েদার অভিযান। তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন বিল লাদেনকে হত্যার নির্দেশ দেন। ২০ আগস্ট আফগানিস্তানের খোস্ত শহরের কাছে এক বৈঠকে লাদেনের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। সেখানেই তাকে টার্গেট করে সামরিক হামলার প্রস্তুতি চলতে থাকে। এই যখন চলছে তখন একেবারেই ভিন্ন ধরনের এক তদন্ত ক্লিনটনের গদি টলিয়ে দেয়। ১৬ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন জানতে পারেন যে, হোয়াইট হাউসের সাবেক ইন্টার্ন মনিকা লিউনস্কির পোশাকে যে শুক্রাণু পাওয়া গেছে, ডিএনএ পরীক্ষায় তার নিজের শুক্রাণুর সঙ্গে এর মিল রয়েছে। গত ৭ মাস ধরে ক্লিনটন এই মেয়েটির সঙ্গে তার এ্যাফেয়ার থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। পলা জোন্স নামে আরকানসাসের এক সাবেক কর্মচারীর আনীত যৌন হয়রানির পৃথক এক মামলায়ও তিনি শপথ বাক্য পাঠ করে অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। এবার নতুন তদন্তে মনিকার পোশাকে নিজের শুক্রাণুর অস্তিত্ব পাওয়া যাওয়ার পর তিনি স্বেচ্ছায় গ্র্যান্ড জুরির সামনে হাজির হতে রাজি হন। তারিখ ধার্য হয় ১৭ আগস্ট। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করা ছাড়া তার পথ ছিল না। মনিকা কেলেঙ্কারি নিয়ে হোয়াইট হাউস আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেও ক্রুজ মিসাইল মেরে লাদেনকে হত্যার পরিকল্পনায় কোন ছেদ পড়েনি। ১৭ আগস্ট ক্লিনটন গ্র্যান্ড জুরির সামনে উপস্থিত হন এবং তারপর জাতীয় টেলিভিশনে গিয়ে মনিকার সঙ্গে তার অসঙ্গত সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। তিনদিন পর মার্কিন কয়েক ডজন টোমাহক ক্ষেপণাস্ত্র আফগানিস্তানে আল কায়েদা প্রশিক্ষণ শিবিরে ও সুদানের একটি সন্দেহভাজন রাসায়নিক কারখানায় আঘাত করে। লাদেন বেঁচে যান। সুদানের কারখানাটি ওষুধ কারখানা বলে প্রমাণিত হয়। অভিযানের ব্যর্থতা ও অযথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এমন কথাও শোনা যায় মনিকা কেলেঙ্কারির কারণে ভিন্ন উদ্দেশ্যে এই হামলা চালানো হয়েছে। ২০ আগস্ট পেন্টাগনে প্রেস ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিক প্রতিরক্ষামন্ত্রী কোহেনকে প্রশ্ন করেন তিনি হলিউডের ‘ওয়াগ এ্যান্ড ডগ’ ছবিটি দেখেছেন কিনা, যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এক যৌন কেলেঙ্কারির মধ্যে আলবেনিয়ায় ভুয়া যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। মনিকা কেলেঙ্কারি পরাশক্তির যুগে দ্বিতীয় ইমপিচমেন্ট সঙ্কটের রূপ নেয়ায় ক্লিনটন সর্বক্ষণ এই ভেবে উদ্বিগ্ন থাকতেন যে, তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পররাষ্ট্র নীতি এই দুইয়ের মধ্যে বিভেদরেখা গুলিয়ে ফেলছেন বলে অন্যরা মনে করছে কি না। নিক্সন ইমপিচমেন্ট সঙ্কট যেভাবে মোকাবেলা করেছিলেন ২৫ বছর পর একই সঙ্কট ক্লিনটন একেবারেই ভিন্নভাবে মোকাবেলা করেছিলেন। নিক্সন পররাষ্ট্র নীতির দৈনন্দিন দায়িত্বটা কিসিঞ্জারের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্লিনটন তা করেননি। ইমপিচমেন্ট সঙ্কটের গোটা অধ্যায়ে তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নির্ধারণের কাজটা নিজের হাতেই রেখেছিলেন। ১৯৭৪ সালে নিক্সনের যে বয়স ছিল, ১৯৯৮ সালে ক্লিনটনের বয়স ছিল তার তুলনায় ১০ বছরের কম। ওই সঙ্কটে নিক্সন যেমন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিলেন ক্লিনটন তা হননি। তার দৃঢ়তাই তাকে পররাষ্ট্র নীতির প্রতি আরও বেশি এনার্জি ও দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে সহায়ক হয়েছিল। আবার নিক্সন যে ধরনের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন ক্লিনটন হয়েছিলেন, তা থেকে অতি ভিন্ন ব্যবস্থার। আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে বশীভূত করার ক্ষমতা ও সামর্থ্য পরাশক্তিদের দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এক নতুন ও মারাত্মক ধরনের অরাষ্ট্রীয় কুশীলবের উত্থান ঘটেছিল ভিলেন হিসেবে। এরা বিন লাদেনের মতো সন্ত্রাসবাদী। লাদেন ছাড়াও ছিল সার্বিয়ার নেতা স্লোবোদান মিলোসেভিচ ও ইরাকী নেতা সাদ্দাম হোসেন, যারা মার্কিন প্রেসিডেন্টের নাজুক অবস্থার সুযোগ নিতে চাইছিল। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে মনিকা কেলেঙ্কারির গুজব প্রথম প্রকাশ পাওয়ার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে মিলোসোভিচকে নিয়ে প্রথম সমস্যা দেখা দেয়। সাবিশেষ এই স্বঘোষিত নেতা বিদ্রোহী প্রদেশ কসোভোয় সৈন্য পাঠিয়ে শুদ্ধি অভিযান চালায়। মিলোসেভিচকে বিরত রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যাটোকে দিয়ে বিমান হামলার পরিকল্পনা নেয়। কসোভো পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার পাশাপাশি ৯ সেপ্টেম্বর গ্র্যান্ড জুরি কংগ্রেসে মনিকা কেলেঙ্কারি রিপোর্ট পেশ করে ক্লিনটনের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের সুপারিশ করে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রিপাবলিকান প্রধান প্রতিনিধি পরিষদ কোমড় বেঁধে লেগে যায় এবং ইমপিচমেন্টের আনুষ্ঠানিক তদন্ত ৫ অক্টোবর শুরু হয়। এর ৩ দিন আগে ২ অক্টোবর ক্লিনটন কংগ্রেস ও মার্কিন জনগণকে সার্বিয়ায় বিমান হামলার সিদ্ধান্তের কথা জানান। ন্যাটোকে দিয়ে এই হামলা ১৬ অক্টোবর শুরু হওয়ার কথা ছিল। মাঝখানে কূটনৈতিক সমাধানেরও চেষ্টা চলে। হামলার নির্ধারিত তারিখের আগের দিন মিলোসেভিচ কসোভো থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ক্লিনটনের চরম ঝুঁকিপূর্ণ কৌশলটি আপাতত সফল হয়। ইমপিচমেন্টের আশঙ্কা তাকে এ ব্যাপারে অবদমিত করতে পারেনি। ক্লিনটনের ঘরোয়া সঙ্কটের সুযোগ সাদ্দামও নিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ শেষে জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী ইরাকের সকল ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র এবং দেড় শ’ কিলোমিটার পাল্লার বেশি সব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার কথা ছিল। কিন্তু ৭ বছর পরও সাদ্দাম তা করেননি। ক্লিনটন শক্তি প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তার আগে অন্য পথেও চেষ্টা চালান। মরক্কোর বাদশাহ হাসানকে দিয়ে দ্যুতিয়ালি করেন। হাসানকে তিনি বলেন, ‘সাদ্দামকে গিয়ে বলুন তাকে হত্যা বা ক্ষমতাচ্যুত করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আমি শুধু চাই তার অস্ত্র কর্মসূচী নিয়ে যা করার কথা ছিল সেটা যেন করা হয়।’ কিন্তু ক্লিনটনের রাজনৈতিক ভাগ্যের অবনতির সুযোগ নিয়ে সাদ্দাম শুধু বেঁকেই বসেননি, ৫ আগস্ট জাতিসংঘের সকল অস্ত্র পরিদর্শককে দেশ থেকে বের করে দেন। ক্লিনটন তখন জাতিসংঘের বাড়তি অবরোধ দিয়ে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এদিকে ৩ নবেম্বর মধ্যমেয়াদী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা প্রতিনিধি পরিষদে বাড়তি আসন পাওয়ায় রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখলেও তাদের শক্তি অনেক খর্ব হয়। এতে ইমপিচমেন্টের হুমকিও সাময়িকভাবে দূরে সরে যায় এবং সাদ্দামকে মোকাবেলার শক্তি বাড়ে। সাদ্দামের সামরিক হেডকোয়ার্টার ও সম্ভাব্য মারণাস্ত্র ঘাঁটিগুলোতে হামলার প্রস্তুতি নেয়া হয়। এই অভিযানের জন্য বোমারু বিমান ও জাহাজ পাঠানো হয়। এতে কাজ হয়। ১৪ নবেম্বর ইরাকীরা জাতিসংঘ অস্ত্র পরিদর্শকদের আসতে দিতে রাজি হয়ে চিঠি দেয়। এতে অনেক ফাঁক ফোকর ছিল বলে সামরিক প্রস্তুতি অব্যাহত থাকে। তবে শেষ অবধি ক্লিনটন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জয়েন্ট চীফস অব স্টাফের চেয়ারম্যানের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও হামলা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন। হামলা হলে প্রচুর ইরাকী অনিবার্যরূপে নিবৃত হবে এমন আশঙ্কা তাকে প্রভাবিত করেছিল। তাতে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে, এটাই সাদ্দামের শেষ সুযোগ। সাদ্দাম জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ মিশনে হস্তক্ষেপ করলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক শক্তি প্রয়োগ করবে। সাদ্দাম ও মিলোসেভিচের ক্ষেত্রে ক্লিনটনের এ ধরনের কৌশল প্রয়োগ সফল হয়েছিল। সেটা ১৯৯৮ সালের শরৎকাল এবং এমন একটা সময় যখন তার প্রেসিডেন্ট পদের অস্তিত্ব তখনও পর্যন্ত মারাত্মক আঘাতের সম্মুখীন না হলেও বিপন্ন অবস্থায় ছিল। তবে ইমপিচমেন্ট সঙ্কটের প্রথমদিকে পররাষ্ট্র নীতির সকল ক্ষেত্রই যে অভ্যন্তরীণ চাপ থেকে মুক্ত ছিল, তা নয়। নিক্সনের মতো ক্লিনটনও নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণের জন্য পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের কিছু অর্জনে জোর উদ্যমে চেষ্টা করেছিলেন। নিক্সনের মতো তিনিও মধ্যপ্রাচ্যে সাফল্য অর্জন করতে চেয়েছিলেন। তবে তার মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক প্রধান আলোচক ডেনিস রসের কাছে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া কিসিঞ্জারের চেয়েও অনেক বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ক্লিনটন ক্ষমতায় থাকবেন কি না তা নিয়ে নেতানিয়াহু বিশেষভাবে সন্ধিগ্ধ ছিলেন। আরাফাতের নিজেরও উদ্বেগ ছিল। ফলে ফিলিস্তিনের চূড়ান্ত মানচিত্র ও ইসরাইলী সৈন্য প্রত্যাহারের সময়সূচী ১৯৯৮ সালের শরতে অনিষ্পন্নই থেকে যায়। ১৯৭৪ সালে বিখ্যাত শাটল ডিপ্লোম্যাসির সময় কিসিঞ্জার তিনটি পদ কার্যকরভাবে ধরে রেখেছিলেন- পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান মধ্যপ্রাচ্য আলোচক। ২০ বছর ইমপিচমেন্টের ছায়ার নিচে এই তিনটি পদ তিনজনের হাতে ছিল- অলব্রাইট, বার্জার ও রস। নেতানিয়াহু ও আরাফাতের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের জন্য ক্লিনটন চাপ দিতেন বার্জার ও অলব্রাইটের ওপর আর শেষোক্ত দু’জন চাপ দিতেন রসের ওপর। একটা চুক্তি আমার চাই ১৯৯৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গ্র্যান্ড জুরির মনিকা কেলেঙ্কারি রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার এবং কংগ্রেসে ইমপিচমেন্টের চাকা ঘুরতে শুরু হওয়ার পর থেকে ক্লিনটন মধ্যপ্রাচ্য টিমের ওপর জোর চাপ দেন। রসকে তিনি এটা দেখাতে বলেন যে, প্রেসিডেন্ট ঠিকমতোই তার কাজ করে চলেছেন, তার মন উচাটন নয় এবং অত্যন্ত স্পর্শকাতর, গুরুতর ইস্যুগুলো লক্ষণীয়ভাবে মোকাবেলা করছেন। আরাফাত ও নেতানিয়াহু মতৈক্যে পৌঁছা থেকে এখনও বহু দূরে রস এ কথা জানানোর পর ক্লিনটন টেবিল চাপড়ে বলেছিলেন যে, অলব্রাইট ও বার্জার যেন সেই ফলটা অর্জন করেন, যা তার দরকার। ক্লিনটন চাইছিলেন আরাফাত ও নেতানিয়াহু যেন যুক্তরাষ্ট্রে এসে একটা চুক্তিতে সই করেন, যাতে করে তিনি দেখাতে পারেন যে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তার বড় ধরনের বিজয় হয়েছে। (চলবে...)
×