ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বুড়িগঙ্গাকে বাঁচান

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ১৬ মার্চ ২০২০

 বুড়িগঙ্গাকে বাঁচান

অনুরূপ শিরোনামে আমরা একটি সম্পাকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলাম বুড়িগঙ্গাকে নিয়ে বছর তিনেক আগে। তখন প্রধান ইস্যু ছিল হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পের যাবতীয় কঠিন এবং বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ গিয়ে পড়ত নদীটিতে। একই সঙ্গে অন্যান্য শিল্পকারখানাসহ মনুষ্যনিক্ষিপ্ত বর্জ্য তো ছিলই। অনেক দেনদরবার ও টালবাহানার পর হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো স্থানান্তরিত হয়েছে সাভারে। তবে সেখানেও চামড়াজাত কঠিন ও তরল বর্জ্যরে অধিক্ষিপ্ত হওয়ার অভিযোগ আছে ধলেশ্বরীতে। কেন্দ্রীয়ভাবে সেখানে একটি ইটিপি স্থাপন করা হলেও তা তেমন কার্যকর নয়। সম্প্রতি দেশের সব নদ-নদীর সুরক্ষায় সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে গ্রহণ করা হয়েছে ক্রাশ প্রোগ্রাম তথা উচ্ছেদ অভিযান। এর আওতায় প্রভাবশালী এমপি এবং ব্যবসায়ীরাও বাদ থাকছেন না। নদীরক্ষা কমিশন সরেজমিন পরিদর্শনে দেখতে পেয়েছে যে, অন্তত ৫৪টি শিল্পকারখানার যাবতীয় কঠিন ও তরল বর্জ্য নিক্ষিপ্ত হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়। এর পাশাপাশি রাজধানীর অধিবাসীদের বর্জ্য তো আছেই। অনতি বিলম্বে এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেছে হাইকোর্ট। ত্বরিত কঠোর পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা না নিলে শেষ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার প্রাণপ্রবাহ বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো যাবে না। বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে থাকা তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যার অবস্থাও যে ভাল এমন কথা বলা যাবে না। নদ-নদীর সতত প্রবাহ সর্বদাই একটির সঙ্গে অন্যটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অবশ্য বুড়িগঙ্গার এহেন করুণ দুর্দশা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। গত দু’শ’ বছর ধরেই এককালের প্রমত্তা স্রোতস্বিনী বুড়িগঙ্গা ক্রমাগত দূষিত ও শীর্ণকায় হয়ে উপনীত হয়েছে বর্তমান নর্দমাতুল্য অবস্থায়। ঐতিহাসিক নগরী ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার করুণ দুর্দশার চালচিত্র প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯৬ সালের একটি পত্রিকায়। নদী সুরক্ষায় কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৮৬৬ সালে। যেখানে বলা হয়েছিল বুড়িগঙ্গার মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে পানির প্রবাহ। অন্যদিকে যাবতীয় কঠিন ও তরল বর্জ্য নিক্ষিপ্ত হওয়ায় দূষিত হচ্ছে বুড়িগঙ্গা। তৎকালীন কবি নবীনচন্দ্র সেনের একটি লেখায় পাওয়া যায়, শ্রীমতী বুড়িগঙ্গার কলেবর এত সঙ্কীর্ণ যে, তা অতিক্রম করার জন্য গামলারও প্রয়োজন হয় না। এ থেকেই দখল-দূষণে শীর্ণ হয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার হদদরিদ্র দশা ও চূড়ান্ত সর্বনাশের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, শেষ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো না গেলে রাজধানী হিসেবে টিকিয়ে রাখা যাবে না ঢাকাকেও। বুড়িগঙ্গা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে দীর্ঘদিন থেকে। এ বিষয়ে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই যে, রাজধানী হিসেবে ঢাকার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে যে কোন মূল্যে, যে কোন উপায়ে বাঁচিয়ে তুলতে হবে বুড়িগঙ্গাকে। তবে বাস্তবতা হলো, মানুষ স্বপ্ন দেখে নিরন্তর। এরই একটি নমুনা বোধ করি বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে আরও একটি হাতিরঝিল নির্মাণের স্বপ্ন। ঢাকা ইনটিগ্রেটেড আরবান ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড স্মার্ট সিটি ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় নেয়া হয়েছে এই প্রকল্প। প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করবে বিশ্বব্যাংক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। পরামর্শ সংস্থা নিয়োগও চূড়ান্তপ্রায়। প্রকল্পের আওতায় রয়েছে শিকদার মেডিক্যাল থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত নদীর দু’পাড়ের আধুনিকায়ন, দু’পাশে সিরামিকের তৈরি ওয়াকওয়ে, পর্যটকদের জন্য বিনোদন সুবিধা সংবলিত বিলাসবহুল প্রমোদতরী, বিনোদন পার্ক, অবকাশ যাপনের জন্য আলিশান রিসোর্ট, হোটেল-রেস্তরাঁ, সর্বোপরি সর্বাধুনিক নৌবন্দর ও টার্মিনাল। উপরোক্ত পরিকল্পনা যে খুব অভিনব, আকর্ষণীয়, চিত্তাকর্ষক ও দুর্দান্ত, এ কথা বলতে হবে এক বাক্যে। তবে এর জন্য সর্বাগ্রে যা করণীয় তা হলো একদার স্রোতস্বিনী বুড়িগঙ্গার পরিপূর্ণ পুনরুদ্ধার, যা দুঃসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। উদাহরণ হিসেবে হাতিরঝিলের কথা বলা যায়। সেখানে এর মধ্যেই নানা অনিয়ম-অব্যবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেসব বন্ধ করতে হবে অবিলম্বে। বুড়িগঙ্গাকেও সর্বাগ্রে পুনরুদ্ধার করতে হবে নাব্য পূর্বাবস্থাসহ। এর পরই না হয় অন্যান্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা নির্মাণ, সবুজায়ন, পার্ক ও বিনোদন ব্যবস্থা, থ্রিস্টার-ফাইভস্টার হোটেল করার পরিকল্পনা নেয়া যাবে। তা না হলে ‘পরি’ ‘কল্পনা’ হয়ে অচিরেই উড়ে যাবে আকাশে! মনে রাখতে হবে যে, লন্ডনের টেমস, প্যারিসের শ্যিন, কলকাতার গঙ্গাও একদার চরম দুর্দশা থেকে পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে। সেক্ষেত্রে বুড়িগঙ্গাইবা হবে না কেন?
×