ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিবিজড়িত মুজিবনগরে একদিন

প্রকাশিত: ১২:০৬, ১৫ মার্চ ২০২০

স্মৃতিবিজড়িত মুজিবনগরে একদিন

বছরের পুরোটাজুড়ে ক্লাস, এ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে পার হলেও মাঝে মধ্যে মনে হয় চেনা গ-ি পেরিয়ে ভিন্ন কোথাও ঘুরে আসি। যান্ত্রিকজীবনের অবসাদ থেকে মুক্তি পেতেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের তৃতীয়বর্ষের শিক্ষার্থীদের ছুটে চলা মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের দেশে। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ক্যাম্পাস থেকে বের হতে হবে সকাল ৮টায়। যেহেতু অনেক বেশিদূরের পথ নয়, তবুও ভ্রমণ ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধিদের কড়া নির্দেশ কোনভাবেই দেরি করা যাবে না। কথামতো ঠিক ৭টার মধ্যেই প্রায় সকলেই টিএসসিসির সামনে উপস্থিত হলাম। সকালে সকলের জন্য টিসসিসির ক্যান্টিনে নাস্তার ব্যবস্থা ছিল তাই সবাই মিলে নাস্তা সেরেই ফেললাম। তারপর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাসে তুলে যাত্রা শুরু করলাম। পথে নামতেই ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা গায়ে এসে লাগল। আহা কী সুন্দর চারদিক। কিছুদূর যেতেই আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন- সকলের প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুন্সি মুরতজা আলী। বাস চলতে থাকল আর ভেতরে সাউন্ড সিস্টেমের শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল যেন বাসের ভেতরে ভূমিকম্প হচ্ছে। যে যেভাবে পারে ড্যান্স করতে ব্যস্ত। সেটা কী এক রকম ড্যান্স! কত স্টাইলে, কত সিস্টেমে, কত ভঙ্গিতে! আমি নিশ্চিত এর ভাল কোন ভিডিও ক্লিপ থাকলে অস্কারের জন্য আবেদন করা যেত! প্রায় পুরোটা রাস্তা আমাদের ড্যান্স, সঙ্গে যুক্ত হলেন মুরতজা স্যার। স্যারের ড্যান্স এবং বন্ধুসুলভ আচরণ দেখে আমরা বিমোহিত। রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছের মাঝ দিয়ে দুরন্ত গতিতে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলছে আমাদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস। অবশেষে যখন পৌঁছালাম তখন মোটামুটি এগারোটা বাজতে চলছে। প্রথমেই গেলাম আম্রকাননে। আম্রকানন কিংবা আমবাগান বা বৈদ্যনাথ তলা যাই বলেন না কেন, সূর্যের সমস্ত আলোয় আলোকিত আমবাগান দেখে সত্যি বিমোহিত আমরা। এই বাগানেই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা। শপথ গ্রহণ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একটি বিবৃতি পাঠ করেন এবং বৈদ্যনাথ তলার নাম রাখেন মুজিবনগর। আমবাগানের মুগ্ধতা কাটিয়ে আরও মিনিটখানেক হেঁটে গেলাম মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ। স্থাপনার মূল বৈশিষ্ট্য ১৬০ ফুট ব্যাসের গোলাকার স্তম্ভের ওপর মূল বেদিকে কেন্দ্র করে ২০ ইঞ্চির ২৩টি দেয়াল। দেয়ালগুলো উদীয়মান সূর্যের প্রতীক। ৩০ লাখ শহীদকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য স্মৃতিসৌধের মেঝেতে ৩০ লাখ পাথর বসানো হয়েছে। সৌধের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে লাল মঞ্চ, ২৩টি স্তম্ভ, ১ লাখ বুদ্ধিজীবীর খুলি, ৩০ লাখ শহীদ, ১১টি সিঁড়ি, বঙ্গোপসাগর, ২১ ফেব্রুয়ারি, রক্তের সাগর ও ঐক্যবদ্ধ সাড়ে ৭ কোটি জনতা। স্মৃতিসৌধের পাশেই মুজিবনগর মানচিত্র। আমরা সকলে মিলে চলে গেলাম বাংলাদেশের মানচিত্রের কাছে। যুদ্ধকালীন অবস্থার রূপক এই মানচিত্র। কোন্ এলাকায় যুদ্ধ হয়েছে, শরণার্থীরা কীভাবে দেশ ছেড়েছিল সবই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে মহান মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে ভাগ করে দেখানো হয়েছে মানচিত্রে। পুরো কমপ্লেক্স ঘুরে যে যার মতো ছবি তোলা আর নিজের এলাকার অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছিল। মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস। বর্তমান প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার আর শিক্ষণীয় হতে পারে প্রথম সরকারের এই ভূমি। সবকিছু দেখা শেষে পিকনিক স্পটে ফেরার পালা। যে অংশ রান্না-বান্না চলছিল সেখানে এসে দেখি খাবার তৈরি হয়ে গিয়েছে। সবাই বসে পড়লাম খাওয়ার জন্য। খাওয়া শেষে এবার শুরু হলো সারপ্রাইজের পালা। সবাই পুরস্কার পাবে এমন একটা খেলা হলো। সেটা শেষে মূল আকর্ষণ সারপ্রাইজ গেম শুরু হলো। যে জিতবে সে পাবে ব্যাফিং প্যাকেট মোড়ানো সেই কাক্সিক্ষত পুরস্কার। খেলা চলছে টান-টান উত্তেজনাতে কে পাবে সেই পুরস্কার। অবশেষে সাদিয়ার সেই হাসিমাখা মুখে উঠল সেই কাক্সিক্ষত পুরস্কার। যেহেতু সারপ্রাইজ গিফট তাই শর্ত খুলে দেখতে হবে। সবার মধ্য উত্তেজনা বাড়ছে কি সেই গিফট সাদিয়া প্যাকেট টেনে খুলল আর যে দেখল সেটা দেখতে মোটেও সে প্রস্তুত ছিল না। প্যাকেট খুলে দেখতে পেল তার সেই সারপ্রাইজ গিফট ছিল একটি বদনা। এরপর একে একে সবাই নিজের মতো করে কেউ অভিনয় কেউ বা কবিতা আবার কেউ গান ও নাচ পরিবেশন করল। শেষে লটারির মাধ্যমে ১৫ জন পুরস্কার পেল। এবার বিদায়ের পালা। এবার ভ্রমণ নিয়ে সবাই সবার নিজের অভিমত করার পর মাঝপথে আবার শুরু হলো আমাদের তুমুল উল্লাসিত ড্যান্স। আগের মতো মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে চলল আমাদের ড্যান্স। বাকি রাস্তা বেশ আনন্দ-উল্লাস করেই ফিরে এলাম ক্যাম্পাসে। তাসনিমুল হাসান প্রান্ত
×