ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বড়পুকুরিয়ায় কয়লা গায়েব- দুই কমিটির দু’ধরনের রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ১৫ মার্চ ২০২০

বড়পুকুরিয়ায় কয়লা গায়েব- দুই কমিটির দু’ধরনের রিপোর্ট

রশিদ মামুন ॥ সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি বলছে দেশের একমাত্র কয়লাখনি বড়পুকুরিয়ায় এক থেকে তিন ভাগ সিস্টেম লস হয়ে থাকতে পারে। সঙ্গত কারণে গায়েব হয়ে যাওয়া এক লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা চুরি হয়নি বলে মনে করছে তদন্ত কমিটি। সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি গায়েব হওয়া পুরো কয়লাকে সিস্টেম লস হিসেবে উল্লেখ করছে। অন্যদিকে কনজুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) গঠিত তদন্ত কমটি বলছে বড়পুকুরিয়ায় কয়লার প্রকৃত ঘাটতি হয়েছে পাঁচ লাখ ৪৮ হাজার টন। সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির সিস্টেম লস হিসেবের পরে এই পরিমাণ ঘাটতি দেখিয়েছে ক্যাবের বিদ্যুত ও জ¦ালানি অভিযোগ অনুসন্ধান ও গবেষণা কমিশন। দুই কমিটির দুই ধরনের প্রতিবেদনে নতুন করে আলোচনায় এসেছে কয়লা কেলেঙ্কারির এই ঘটনা। ক্যাব বলছে অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে আলোচিত এই ঘটনার সুরাহা হতে পারে। বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রে কয়লা ঘাটতি দেখা দিলে প্রকাশ পায় কয়লা গায়েবের ঘটনা। গ্রীষ্মের শেষ দিকে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে অনেকটা আকস্মিকভাবে দেশের একমাত্র তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কর্তৃপক্ষ জানায় তাদের মজুদ ফুরিয়ে গেছে। ফলে তারা কেন্দ্র চালানোর মতো কয়লা দিতে পারছে না। ওই সময় কয়লার নতুন স্তর থেকে ঠিকাদার কোম্পানি কয়লা তোলার কারণে তিন মাস কয়লা উত্তোলন বন্ধ ছিল। কিন্তু বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কাগজে কলমে এক লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা মজুদের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল। আকস্মিক বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উত্তরবঙ্গের বিদ্যুত পরিস্থিতির অবনতি হয়। বিকল্প পন্থায় বিদ্যুত সরবরাহ করা হলেও ওই সময় উত্তরাঞ্চলের মানুষকে সঙ্কটে কাটাতে হয়। যাতে সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি মামলা দায়ের করে। পরে কয়লা গায়েবের ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয় আদালতে। কয়লা গায়েবের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং পেট্রোবাংলা পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। তবে পেট্রোবাংলার দুটি পৃথক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জ¦ালানি বিভাগে জমা দেয়া হয়েছিল। বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের এই তদন্ত কমিটিতে পেট্রোবাংলার তৎকালীন পরিচালক (পিএসসি) মাহবুব ছারোয়ারকে আহ্বায়ক করা হয়। অন্য তদন্ত কমিটিতে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন এ্যান্ড মাইন্স) মোঃ কামরুজ্জামানকে প্রধান করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২০১৮ সালের আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি দুটি। কমিটির প্রতিবেদন বলছে গায়েব হওয়া কয়লা সিস্টেম লস। দুটি কমিটি তাদের দেয়া প্রতিবেদনে বলছে, এই কয়লা চুরি হওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। কোল ইয়ার্ডের চারদিকে আট ফুট উচ্চতার দেয়াল দেয়া রয়েছে। এছাড়া পাঁচ শিফটে ১২ জন আনসার এবং ৩ জন নিরাপত্তা কর্মী সর্বক্ষণিক পাহারা দেয়। তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কোন দুর্বলতা উঠে আসেনি। বরং কিভাবে গায়েব হওয়া কয়লাকে সিস্টেম লস হিসেবে দেখানো যায় সেই চেষ্টাই করা হয়েছে। তবে পিডিবির কয়লার ঘাটতির জন্য তিনটি কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তদন্ত কমিটি বলছে খনি কর্তৃপক্ষ কোন দিন কি পরিমাণ কয়লা মজুদ রয়েছে তা মেপে দেখেনি। এছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে সিস্টেম লস হিসেব করে দেখা হয়নি। আর পিডিবির চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বও দেয়া হয়নি। কমিটি বলছে উত্তোলিত কয়লার মধ্যে ৬৬ ভাগ পিডিবির কাছে আর ৩৩ ভাগ বিক্রি করা হয়েছে অন্য গ্রাহকের কাছে। কয়লা গায়েবের পর বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রও বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে বলেছে কয়লাতে ১০ ভাগের ওপর পানি দিয়ে খনি কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে কয়লার দাম নিয়ে গেছে। এ বিষয়ে তখন বিদ্যুত বিভাগ বৈঠক করেছে। কিন্তু একই মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা হলেও কোন সমাধানের জায়গাতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে ক্যাব গঠিত তদন্ত কমিশন বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কয়লা উত্তোলনের শুরু ২০০৫ থেকে ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত বিক্রয়ের হিসাব এবং কয়লার মধ্যে থাকা ময়েশ্চার (জলীয় অংশ) হিসাব করে বলছে সাত দশমিক ৯ লাখ মেট্রিক টন কয়লার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। কমিশন মনে করছে গত ১৩ বছর ধরেই এই পরিমাণ কয়লা নিয়ে নয়-ছয় করা হয়েছে। বর্তমান বাজার দর ধরে হিসাব করলে এই কয়লার মূল্য ৯২৭ কোটি টাকা। তবে দীর্ঘ সময় ধরে চুরি যাওয়াতে রাষ্ট্রের কত ক্ষতি হয়েছে কমিশন সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন অঙ্ক নির্ধারণ করেনি। কমিশন বলছে হদিস না পাওয়া কয়লার মধ্যে দেড় ভাগ সিস্টেম লস হিসেব করলে এক লাখ ৬১ হাজার টন সিস্টেম লস বা লোকসান হয়েছে। বাকি পাঁচ লাখ ৪৮ হাজার টন কয়লার হিসাবে গোঁজামিল রয়েছে। বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা তোলে চীনা কোম্পানি। এই কোম্পানির কাছ থেকে নির্দিষ্ট দরে কয়লা কিনে নেয় বড় পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষ (বিসিএমসিএল)। কয়লার সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণ ময়েশ্চারও হিসাব করা হয়। কিভাবে চুরি সংঘটিত হয়েছে তা সহজে বোঝার জন্য কমিশনের সদস্য ভূতাত্ত্বিক অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, চীনা কোম্পানির কাছ থেকে ১০০ টন কয়লা কেনার সময় বলা হয়েছে কয়লাতে ৫ দশমিক ১ ভাগ পানি রয়েছে। এভাবে চীনা কোম্পানিকে বিল দেয়ার সময় ৯৫ টনের বিল দেয়া হয়েছে। কিন্তু কাগজপত্রে দেখানো হয়েছে ১০০ টন কয়লা রয়েছে। এবার সেই ১০০ টন ধরে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এভাবে হিসাবে গোজামিল দিয়ে বিপুল পরিমাণ কয়লা চুরি করা হয়েছে। তদন্তের ফল তুলে ধরার সময় অধ্যাপক বদরুল ইমাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাস্তবে ৫ দশমিক ১ ভাগ জলীয় অংশ থাকার কথা বলা হলেও বাস্তবে যা রয়েছে ১০ দশমিক ৫ ভাগ। সেই হিসাবে বিসিএমসিএল এর কাছে কয়লা থাকার কথা ১০৭ দশমিক ৩১ লাখ মেট্রিক টন। গত ১১ বছরে কয়লা বিক্রি করা হয়েছে ১০০ দশমিক ২২ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ঘাটতি রয়েছে ৭ দশমিক ৯ লাখ মেট্রিক টন। গড় সিস্টেম লস দেড় ভাগ বিবেচনা করে এক দশমিক ৬১ লাখ মেট্রিক টন বাদ দিয়ে ঘাটতি ৫ দশমিক ৪৮ লাখ মেট্রিক টন হিসাব করা হয়েছে। এই বিতর্ক সৃষ্টির পর অধ্যাপক বদরুল ইমামের কাছে জানতে চাওয়া হয়, খনি কর্তৃপক্ষ তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের কাছে কয়লা বিক্রি করলে সেই টাকা কোন ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবে নয় বরং খনি কর্তৃপক্ষের ব্যাংক হিসাবে যোগ হওয়ার কথা। এখানে কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার কথা নয়। এক্ষেত্রে কেন তারা এমনটি করবেন। অধ্যাপক বদরুল ইমাম জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা একটি পদ্ধতির গোজামিলের কথা বলেছি। কোন ব্যক্তিকে আমরা অভিযুক্ত করিনি। আমরা বলেছি এই পদ্ধতিতে খনি কর্তৃপক্ষ কয়লার বদলে পানি দিয়ে তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রর কাছ থেকে অর্থ নিয়ে গেছে। আমরা বলিনি কখন কোন কর্মকর্তা এই কাজটি করেছেন। এ বিষয়ে সরকার অধিকতর তদন্ত করলে দায়ী ব্যক্তিরা বের হয়ে আসবে বলে মনে করেন তিনি। অন্যদিকে সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী কামরুজ্জামানের কাছে জানতে চাওয়া হয় বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের কাছে বিক্রি করা কয়লার জলীয় অংশ বিবেচনা করে সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না জানতে চাইলে বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক সব তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা মনে করেছি এক থেকে তিন ভাগ পর্যন্ত সিস্টেম লস হতে পারে। অতীতে কোন দিন সিস্টেম লস হিসাব করা হয়নি বলেই এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। ক্যাবের প্রতিবেদন সম্পর্কে তিনি বলেন, এই বক্তব্যটি কোন মাইন ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে আসতে হবে। ক্যাবের তদন্ত কমিটিতে কোন মাইন ইঞ্জিনিয়ার ছিল না বলে মন্তব্য করেন। তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের কাছে দেয়া কয়লার জলীয় অংশ সম্পর্কে বলেন, খনি কর্তৃপক্ষ তো তাদের কয়লা দিয়ে দিয়েছে। এরপরতো সেই কয়লার দায় দায়িত্ব তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের।
×