ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেনারসি বাঁচাতে সীমা হামিদের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ১৫ মার্চ ২০২০

বেনারসি বাঁচাতে সীমা হামিদের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আঙ্গিনাতে যে আছে অপেক্ষা করে- তার পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ঢাকাই শাড়ির উল্লেখই প্রমাণ করে শাড়ির জন্য বিখ্যাত ছিল এই ঢাকা। এই অঞ্চলের তাঁতিদের নিখুঁত বুননে ঐতিহ্যের ছোঁয়া ছিল বরাবর। কিন্তু ইদানীং যেন সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। সময়ের বিবর্তনে মসলিনের করুণ ভাগ্যই কি বরণ করবে ঢাকাই শাড়ি! অন্তত মীরপুরের বেনারসি পল্লীতে গিয়ে তাঁতিদের জীবনের বিবর্ণ বর্ণনা শুনে তাই মনে হয়েছে সীমা হামিদের। দেশীয় ঐতিহ্য বেনারসি সংরক্ষণে এগিয়ে এসেছেন তিনি। বেনারসি শাড়ি মানেই এক ধরনের আভিজাত্যের ছোঁয়া। ঈদ, পূজা পার্বণতো আছেই। সব থেকে বড় কদর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায়। কনের পরনে বেনারসি না থাকলে কি আর বিয়ে হলো সেটা। কিন্তু এখন যেন ভাটা পড়েছে। অভিজাত বিয়েতে শাড়ি আসে দেশের বাইরে থেকে। আর মধ্যবিত্তও খোঁজেন কম দামের কলের শাড়ি। বাজার ছয়লাব যেখানে নকল আর বিদেশী শাড়িতে সেখানে বেনারসি প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। প্রচারে প্রসার বাড়ে ঐতিহ্য বেঁচে থাকে। সেই চিন্তা থেকে বেনারসি বাঁচাতে ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিভাবে এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার চিন্তা করছেন জানতে চাইলে সীমা হামিদ বলেন, বেনারসিকে শুধু শাড়ির মধ্যে সীমিত না রেখে বেনারসি দিয়ে নানা ধরনের পোশাক তৈরির চিন্তা করছি। মেয়েদের জন্য স্যালোয়ার-কামিজ, বাচ্চাদের পোশাক থেকে শুরু করে বিয়ের শেরোয়ানি সব কিছুই বেনারসি দিয়ে তৈরির পরিকল্পনা করে সফল হয়েছেন। দারুণ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। ঐতিহ্যের দিকে তাকালে বাংলার মাটিতে বেনারসি এসেছে ৭২ বছর আগে। কথিত রয়েছে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় ভারতের বেনারাস থেকে ৩০০টি মুসলিম তাঁতি পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। তারা মূলত ঢাকার মিরপুর ও পুরান ঢাকায় বসতি স্থাপন করে। তারা তাদের আদিপেশা এই তাঁত শিল্পের কাজ এদেশে এসেও অব্যাহত রাখে। নান্দনিক ডিজাইন, উন্নত রুচি এবং নিপুণ বুননের কারণে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ক্রমান্বয়ে এই পেশায় বহু লোক সম্পৃক্ত হয়। নিজেদের বেনারসির কারিগর হিসেবে গড়ে তোলেন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এই পেশার এখন রুগ্ন দশা। যা থেকে কেউ বের হতে পারছেন না। কেন এই উদ্যোগ জানতে চাইলে সীমা হামিদ বলেন, আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাকগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় মসলিন ছিল। এখনও মানুষের মুখে মুখে মসলিনের ঐতিহ্য গল্প বেঁচে রয়েছে। কিন্তু সেই মসলিন হারিয়ে গেছে। এভাবে আমরা অবহেলায় অনাদরে আমাদের ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছি। এখনও উদ্যোগ নিলে আমাদের ঐতিহ্যকে আমরা ধরে রাখতে পারি। তিনি মনে করেন বেনারসি, জামদানি, রাজশাহী সিল্ক আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। জামদানি নিয়ে অনেক কাজ হলেও বেনারসি নিয়ে তেমন কোন কাজই হয়নি। সঙ্গত কারণে বেনারসিকে বাঁচিয়ে রাখতে এই উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান তিনি। সীমা হামিদ জানান, তিনি মিরপুরে তাঁত পল্লীতে গিয়ে বেনারসির কারিগরদের দুর্বিসহ জীবনের গল্প শুনেছেন। এতে মনে হয়েছে বিশ^ব্যাপী কদর থাকা এই শাড়িকে নানা ভাবে তুলে ধরাগেলে শুধু ঐতিহ্যই রক্ষা পাবে না। এরসঙ্গে সঙ্গে বিপুল পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। শুধুমাত্র বেনারসিই কেন অন্য ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিয়ে কাজ করছেন না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সবেমাত্র শুরু করেছি। আমাদের ইচ্ছা আছে অন্য যেসব ঐতিহ্যবাহী পোশাক রয়েছে। দিন দিন নানা কারণে এসব পোশাকের কদর কমছে সেগুলোর একটি বাণিজ্যিক দিক সৃষ্টি করা। যাতে মানুষ এসব পোশাকের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে সে জন্যই বাণিজ্যিক দিকটি নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। পোশাক পরিকল্পনায় আধুনিকতার ছোঁয়া থাকলে অবশ্যই নতুন প্রজন্ম ঐতিহাসিক এসব পোশাকের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবেন। আমরা সেই চেষ্টাই করছি। বেনারসি শাড়ি তৈরির মূল উপাদান কাঁচা রেশম সুতা। এর পাশাপাশি ব্যবহৃত হয় জরি সুতা। তবে বর্তমানে দেশী রেশম সুতার দাম বৃদ্ধির কারণে তাঁতিরা রেশম সুতার পাশাপাশি সস্তা চায়না সিল্ক সুতা ব্যবহার করে থাকেন। সুতা কারিগরেরা প্রথমে রং করেন। তারপর সাবান ও গরম পানি দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকান। এরপর চলে তাঁতে নান্দনিক বুননের কাজ। ডিজাইন ও বুনন সহজ হলে একটি শাড়ি তৈরি করতে একজন তাঁতির এক সপ্তাহের মতো সময় প্রয়োজন হয়।
×